বিশ্ব অর্থনীতি বদলে দেওয়া '৩'

এই বছরটা তিনটি যুগান্তকারী বৈশ্বিক ঘটনার বর্ষপূর্তি। ১০০ বছর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। সেটা ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অক্ষশক্তির ওপর মিত্র বাহিনীর আক্রমণ সূচনাকারী দিবস বা ডি-ডের ৭০ বছর। সেটা ছিল ১৯৪৪ সালের ৬ জুন। আর ২৫ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটেছিল। তার অল্প দিন আগে অবশ্য চীনের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে গণতন্ত্রকামী ছাত্র-জনতার ওপর চীনা কমিউনিস্ট সরকারের সেনা অভিযান চালানো হয়।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এর বিশিষ্ট কলামিস্ট মার্টিন উলফ গত ১০ জুন তাঁর এক নিবন্ধে এ বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন। নিবন্ধের শিরোনাম ‘তিনটি ঘটনা, যা আমাদের পৃথিবীকে আকৃতি দিয়েছে’। তিনি বলেছেন, ১০০ বছর আগে ভঙ্গুর ইউরোপ পুরোপুরি ধসে পড়ে। ৭০ বছর আগে গণতন্ত্রীরা সমগ্রতাবাদী ইউরোপের ওপর আক্রমণ চালায়। আর ২৫ বছর আগে ইউরোপ পূর্ণাঙ্গ ও মুক্ত হয়, যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। একই সময়ে চীন বাজার অর্থনীতি গ্রহণ করে। উলফের মতে, ‘এসব কারণে আমরা এখন সিকি শতাব্দী ধরে বৈশ্বিক পঁুজিবাদে বসবাস করছি। তবে এই সময়কালে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ ক্রমেই বাড়ছে।’
নিবন্ধে বলা হয়েছে, ১৯১৩ সালে পশ্চিম ইউরোপ ছিল বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির কেন্দ্র। বৈশ্বিক উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ এই অঞ্চল থেকেই আসত। ইউরোপীয় সাম্রাজ্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বেশির ভাগ বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করত। ইউরোপীয় বণিকেরাই নিয়ন্ত্রণ করত বৈশ্বিক বাণিজ্য ও অর্থায়ন। বৃহত্তম একীভূত জাতীয় অর্থনীতি হয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল প্রান্তিক অবস্থানে। ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মধ্যে বৈরিতা বিশ্বকে যুদ্ধের মধ্যে টেনে আনে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধই রাশিয়া ও পরবর্তী কমিউনিস্ট বিপ্লবগুলো তাড়িত করে। বৈশ্বিক ক্ষমতার ভার আটলান্টিকের ওপারে স্থানান্তরিত হয়। বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিশীলতাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দয়ার ওপর চলে যায়। দেশটি তখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা। পুরোনো সাম্রাজ্যের শক্তি ক্ষয়ে যায়। ধংস হয় ইউরোপের আত্মবিশ্বাস।
তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যা করতে পারেনি; মহামন্দা, নাৎসিবাদ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তা-ই করেছে বলে উল্লেখ করেছেন মার্টিন উলফ।
তিনি লিখেছেন, ডি-ডের সময় বিশ্ব অর্থনীতি বিচ্ছিন্ন আর ইউরোপ হোলোকাস্টের বিভীষিকায় আচ্ছন্ন। সব দিক দিয়ে বিপর্যয় নেমে আসে।
তবে ডি-ডেতে নরমান্ডি উপকূলে মিত্রশক্তির অবতরণ ও ইউরোপ বিজয়ের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রচ্ছায়ায় একটি মুক্ত ও গণতান্ত্রিক পশ্চিম ইউরোপের আবির্ভাব ঘটায়। কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপের বিভাজন ছিল একটি বেদনাদায়ক অথচ অনিবার্য ঘটনা।
তবে ন্যাটোর মাধ্যমে ইউরোপকে রক্ষা করা এবং মার্শাল পরিকল্পনা, ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা পরিষদ ও গ্যাটের (জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড) মাধ্যমে ইউরোপ ও ট্রান্স আটলান্টিক অর্থনীতিগুলোর মধ্যে পুনঃসংযোগ স্থাপনের কাজ শুরু হয়। ১৯৫১ সালে ছয় সদস্যের ইউরোপিয়ান কোল অ্যান্ড স্টিল কমিউনিটি কালক্রমে আজকে ২৮ সদস্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) হয়েছে।
উলফের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান এবং ইউরোপের নৈতিক ও বস্তুগত পতনের সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ফল হলো বড় বড় সাম্রাজ্যের সমাপ্তি। প্রায় সব নতুন স্বাধীন দেশ আমদানি বিকল্প নীতিতে পরিচালিত হয়ে অভ্যন্তরীণ শিল্পায়নে জোর দেয়। এই দেশগুলো সবাই ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতি বিতৃষ্ণ ও মহামন্দার ক্ষততে উদ্বিগ্ন হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে স্টালিনের আপাত সাফল্য তাদের উৎসাহিত করে। আর ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট শাসনে আসা চীন স্বনির্ভরতার দিকে বেশি জোর দেয়। তবে গণতান্ত্রিক হয়েও ভারত কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ও নিবিড় জাতীয়তাবাদকে আকড়ে ধরে। লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোও একই পথে অগ্রসর হয়।
সময়ের পরিক্রমায় ১৯৮৯ সালে এসে ১৯৪৫-পরবর্তী বিভক্ত বিশ্বের অবসান ঘটে। ইউরোপের শীতল যুদ্ধের বিভাজনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ত্বরান্বিত হয় এই বছরটিতে। ইতিমধ্যে (১৯৭৮ সাল থেকে) দেং জিয়াপেং চীনকে ‘সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের’ পথে হাঁটাতে শুরু করে দেন। চীন নিচের দিক থেকে বাজারমুখী অর্থনীতি এবং ওপরের দিক থেকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ—এ দুইয়ের মিশ্রণে উন্নয়ননীতি গ্রহণ করে বলে উলফ উল্লেখ করেছেন।
বিগত সিকি শতাব্দীকে বিশ্বায়নের কাল হিসেবে উল্লেখ করে মার্টিন উলফ বলছেন, বিশ্বব্যাপী বাজার অর্থনীতির গ্রহণযোগ্যতা ও ডিজিটাল বিপ্লব দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে মানবজাতি এমন একটি বৈশ্বিক অর্থনীতি তৈরি করেছে, যা ১৯১৩ সালের চেয়ে অনেক বেশি পারস্পরিকভাবে সম্পৃক্ত। আর এটি কোনো সাম্রাজ্যের অধীনে নয়, বরং বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমর্থনের মাধ্যমে হয়েছে। একদিকে আছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও ইইউর মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, অন্যদিকে আছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মতো ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। এই সময়কালে চরম দারিদ্র্য কমেছে এবং বিশ্বের ৪০ শতাংশ মানুষ বসবাসকারী চীন ও ভারতের উত্থান ঘটেছে।
তবে মার্টিন উলফ মনে করেন যে রাজনৈতিক সংকটের বিষয়টি অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা ও রাজনৈতিক বিভেদের মধ্যে যে উত্তেজনা বিরাজমান, তা বৈশ্বিক সম্পৃক্ত অর্থনীতির নাজুক জায়গা হয়ে রয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্র সরাসরি সামরিক সংঘাতের সুযোগ কমিয়ে দিলেও পুরোপরি নিঃশেষ করতে পারেনি, বরং পরিণতিকে আরও ভয়াবহ হওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
মার্টিন উলফের মতে, যদি গত ১০০ বছর থেকে একটি শিক্ষা পাওয়া যায়, তাহলে আমরা পছন্দ করি আর না করি, আমাদের সহযোগিতা করতে হবে। আবার আমরা এখনো উপজাতি রয়ে গেছি। সহযোগিতা ও সংঘাতের মধ্যে উত্তেজনা স্থায়ী। গত শতকে আমরা দুটোরই চরম রূপ প্রত্যক্ষ করেছি। আগামী শতকের ইতিহাস তাই নির্মিত হবে আমরা কীভাবে দুইয়ের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হব।