কাজের পরিবেশ উন্নয়ন করতে হবে নিজেদেরই

এম এম আকাশ
এম এম আকাশ

প্রথম আলো: রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় গঠিত একটি কমিটিতে আপনি আছেন। কমিটি কী করছে?
এম এম আকাশ: রানা প্লাজার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের পদ্ধতি নির্ণয়ে সশস্ত্র বাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসির নেতৃত্বে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। মূল কমিটির অধীনে ‘ক্ষতিপূরণের হার ও ক্ষতিগ্রস্তের প্রকার নির্ধারণে’ গঠিত উপকমিটির প্রধান হিসেবে আমাকে সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের গুরুত্ব বিবেচনায় ক্ষতির মাত্রা নির্ণয়ের একটি স্থায়ী পদ্ধতি বের করা হবে আমাদের প্রধান কাজ। এত দিন অস্থায়ী পদ্ধতিতে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও এখন সময় এসেছে ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ের স্থায়ী একটি পদ্ধতি খুঁজে বের করার। কারণ, এ ধরনের ঘটনায় ক্ষতি হয় বিভিন্ন রকম। যেমন নিহত, শনাক্তহীন নিহত, স্থায়ী পঙ্গু, দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসাধীন, মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও চাকরি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। তাঁদের সবার ক্ষতি এক রকম নয়, ক্ষতিপূরণও এক রকম হবে না।
প্রথম আলো: রানা প্লাজার ঘটনা আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
এম এম আকাশ: রানা প্লাজা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি অপরাধ। যাঁরা ওই ভবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাঁদের সবাই নিজ নিজ দায়িত্বে অবহেলা করেছেন। বহুমুখী অবহেলার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। তাই এ ঘটনার জন্য প্রথমত দায়ী ভবনটিতে অবস্থিত পোশাকশিল্পের মালিকেরা, যাঁরা জেনেশুনে শ্রমিকদের আপত্তি সত্ত্বেও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। তারপর ভবনমালিক, এরপর যাঁরা ওই ভবনটি তৈরির সময় সরকারি প্রতিষ্ঠানের হয়ে নজরদারির দায়িত্বে ছিলেন—তাঁরা।
প্রথম আলো: পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নের বিষয়টি এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনায়। এ জন্য ক্রেতাদের সহায়তার কথাও বলা হচ্ছে।
এম এম আকাশ: চাপ প্রয়োগ করে দাম বাড়িয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকে পাওয়া টাকায় কর্মপরিবেশ উন্নয়নের নীতি বা দাবির সঙ্গে আমি একমত নই। কারণ, এটা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কম। কর্মপরিবেশ উন্নয়নের কাজটি আমাদের দিক থেকেই শুরু করতে হবে। পোশাকশিল্পের মালিকেরা যে মুনাফা করেন, তা থেকে ১০ শতাংশ ছাড় দিলেই বড় একটি তহবিল গঠন করা সম্ভব। ২০০৭ সালেই হিসাব দিয়েছিলাম যে মালিকেরা মুনাফার মাত্র ১০ শতাংশ ছাড় দিলে এক বছরে ৬০০ কোটি টাকার একটি তহবিল হয়। এখন যে আইন আছে, সেই অনুযায়ী ৫ শতাংশ দিলেও অনেকখানি কাজ হতো। এই তহবিল দিয়ে শ্রমিককল্যাণ ও কর্মপরিবেশ উন্নয়নের কাজটি অনায়াসে করা সম্ভব। সেটি যদি করা হতো, তাহলে রানা প্লাজার মতো ঘটনা ঘটত না।
প্রথম আলো: নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের শ্রমিকপক্ষের দাবির সঙ্গে আপনি কি একমত?
এম এম আকাশ: পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি আট হাজার ১০০ টাকা করার দাবিকে আমি পুরোপুরি যৌক্তিক মনে করি। বর্তমান বাজারে একজন পোশাকশ্রমিককে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে হলে এর চেয়ে কম অর্থে তা সম্ভব নয়। পুঁজিবাদের নিয়মে শ্রমশক্তির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের খরচ হিসেবে হলেও এই অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। শ্রমিকের স্বাভাবিক উৎপাদন-প্রক্রিয়া ধরে রাখার স্বার্থেও মালিকদের এটি করা প্রয়োজন।
প্রথম আলো: মালিকেরা তো রাজি হচ্ছেন না।
এম এম আকাশ: আট হাজার ১০০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। অনেক পোশাক কারখানার পক্ষে তখন হয়তো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা মুশকিল হবে। কোনো কারখানা বন্ধ হয়ে যাক, সেটি কাম্য নয়। তাই অন্য পদ্ধতি খুঁজে বের করতে হবে। যেসব কারখানার পক্ষে নিম্নতম এই মজুরি দেওয়া সম্ভব হবে না, সেসব কারখানার শ্রমিকদের জন্য রেশন ও আবাসন-সুবিধা চালু করা যেতে পারে। সরকার ও মালিকদের সংগঠনকে মিলে এই ব্যবস্থা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আর্থিক মজুরি কিছুটা কম দিলেও তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। আর সবার জন্য তা করাটাই হবে আদর্শ সমাধান। তখন কম আর্থিক মজুরি পরিপূরক প্রকৃত সুবিধা দিয়ে পুষিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। এতে মজুরিবৃদ্ধিজাত মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কাও কম থাকবে।
প্রথম আলো: দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এম এম আকাশ: দেশে যে পদ্ধতিতে প্রবৃদ্ধি বণ্টন করা হয়, তাতে সমতা নেই। এই অসাম্যের কারণে জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশেরই শ্রম, শ্রমের পরিমাণ, গুণ বাড়িয়ে বাড়তি আয়ের সুযোগ নেই। আরেকটি অংশ শ্রম, মেধা ও গুণ ছাড়াই বিপুল আয় করছে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল জনগোষ্ঠীর বড় অংশকে বাদ দিয়ে ধনী ও লুটেরা শ্রেণীর দিকে ঝুঁকে আছে। বর্তমান সরকার অবশ্য প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সেসব ইতিবাচক পদক্ষেপ শেয়ারবাজার, হল-মার্ক, ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, রেলওয়ের নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, মাস্তানির নিচে চাপা পড়ে গেছে।
[সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুজয় মহাজন]