চিটাঙ্গে পুয়া মেডিত ফইল্লে লুয়া...

ইয়াকুব রাসেল। ছবি: সংগৃহীত
ইয়াকুব রাসেল। ছবি: সংগৃহীত

‘একবার একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, “রাসেল, এক মিনিটের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলে তুমি কী করবে?” আমি বললাম, “সবাইকে নুডলস খাওয়াব।” পরদিন আবার তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আর যদি এক সপ্তাহর জন্য প্রধানমন্ত্রী হও?” আমি বললাম, “ধুর, এত নুডলস কে খাবে!”’

এমন অজস্র মজার মজার কৌতুক আছে চট্টগ্রামের ছেলে ইয়াকুব রাসেলের ভান্ডারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তিনি। ভারতের জনপ্রিয় রিয়্যালিটি শো ‘মীরাক্কেল’-এ গিয়ে নিজেকে দুই বাংলার মানুষের কাছে পরিচিত করেছেন কৌতুক অভিনেতা হিসেবে। চট্টগ্রামকে পরিচিত করেছেন বিশ্বের কাছে। মীরাক্কেলের মঞ্চে তাঁর গাওয়া চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গান ‘চিটাঙ্গে পুয়া মেডিত ফইল্লে লুয়া...’ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গান, নাচ, আবৃত্তিতেও সমান পারদর্শী ক্যাম্পাসের এই প্রিয়মুখ।

ছেলেবেলায় রাসেলের স্বপ্ন ছিল ফুটবল খেলোয়াড় হবেন। সেই লক্ষ্যে ২০০৭ সালে ভর্তি হয়েছিলেন বিকেএসপিতে। কিন্তু মায়ের পছন্দ নয় বলে পরিবারের চাপে চার মাস পরই তাঁকে ফিরে আসতে হয় সেখান থেকে। ২০০৯ সালে মার্কস অলরাউন্ডার স্কুলভিত্তিক প্রতিভা যাচাই অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে প্রথম হন তিনি। সেবার এই প্রতিযোগিতার মূল পর্বে তিনি পেয়েছিলেন পঞ্চম স্থান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান, নাচ, আবৃত্তি—যা-ই হোক, রাসেল মঞ্চে আছেন। তাঁর গান শুনে লোকে বলত, ‘এ ছেলে ভালো গায়ক হবে।’ শিক্ষকেরা বলতেন, অভিনয়ই হতে পারে তাঁর ক্যারিয়ার। বন্ধুরা বলত, ‘তুই ক্রিকেটার হ।’ ফুটবলার হওয়ার পরামর্শও দিয়েছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু সব ছাপিয়ে এখন মানুষকে হাসানোই রাসেলের কাজ।

২০১১ সালে মীরাক্কেলে কৌতুক অভিনেতাদের পরিবেশনা দেখে রাসেলের কৌতুকের প্রতি আগ্রহ জাগে। এরপর ২০১২ সালে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হা-শো সিজন-২-এর কৌতুক পরিবেশন প্রতিযোগিতায় অংশ নেন তিনি। এ প্রতিযোগিতায় রাসেল সেরা দশে পৌঁছেছিলেন। এরপর থেকেই কৌতুককে আরও ভালোবেসে ফেলেন। রাসেল বলেন, ‘মানুষকে হাসানো একটা কঠিন কাজ। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাবার স্বপ্ন ছিল ভালো পড়াশোনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হব। কিন্তু কৌতুকই আমাকে টানে।’

২০১৩ সালে তিনিসহ তিনজন মিলে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন চট্টগ্রাম কমেডি ক্লাব। ক্যাম্পাস বা ক্যাম্পাসের বাইরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কৌতুক পরিবেশনের জন্য তাঁর ডাক পড়ে। কিছুদিন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেড় বছর শিক্ষানবিশ সাংবাদিকতাও করেছেন। তবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাল ২০১৫। সে বছর তিনি মীরাক্কেল সিজন-৯-এ অংশগ্রহণ করেন। সেরা আট পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় ছিলেন রাসেল। ওপার বাংলায়ও পৌঁছে দিয়েছেন চট্টগ্রামের ভাষা। তাই চট্টগ্রামের মানুষের কাছে রাসেল ভীষণ প্রিয়। বললেন, এ মাসের ২৭ তারিখে একটি অনুষ্ঠানে কৌতুক পরিবেশন করতে আবার কলকাতায় যাচ্ছেন তিনি।

তিন ভাইবোনের মধ্যে রাসেল দ্বিতীয়। তাঁর বড় বোন ও ছোট ভাইও পড়েন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবা মো. ইউছুফ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে যোগদানের আগে রিকশা চালাতেন তিনি। বাবার মুখে সেই কষ্টের দিনগুলোর কথা শুনেছেন রাসেল। বলছিলেন, ‘আমাদের আদর্শ সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে বাবা চেষ্টার ত্রুটি করেননি।’ প্রথম দিকে রাসেলের কর্মকাণ্ডে বাবার খুব একটা সায় ছিল না। কিন্তু এখন তিনি ছেলেকে নিয়ে খুব খুশি। মা নূর বেগম গৃহিণী। তিনি সব সময়ই ছেলের পাশে ছিলেন। রাসেল বলেন, ‘মা আমার সবচেয়ে আবেগের জায়গা। আমার আজকের অবস্থানের পেছনে সব কৃতিত্ব বাবা-মায়ের।’

ইয়াকুব রাসেল বিশ্বাস করেন, কৌতুক বলা একটা সৃষ্টিশীল কাজ। তিনি চান, বাংলাদেশের আরও তরুণ এর সঙ্গে যুক্ত হোক। বলছিলেন, ‘যান্ত্রিকতার বাইরে এসে মানুষ হাসতে চায়। এখন দেখবেন প্রচুর কমেডিনির্ভর সিনেমা তৈরি হচ্ছে। আমি মানুষকে হাসানোর মাধ্যমে তাদের জীবনকে নির্মল করে তুলতে চাই।’