সন্তোষের ক্যাম্পাসে নেই কোনো অসন্তোষ

বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের সামনে শিক্ষার্থীদের আড্ডা। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে
বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের সামনে শিক্ষার্থীদের আড্ডা। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে

পার্থ প্রতিম সরকার ২০১২ সালে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ময়মনসিংহ শহরের ছেলে পার্থ। অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আবিষ্কার করলেন, এখানে আবাসন-অবকাঠামোসহ নানা সমস্যা রয়েছে। মন খারাপ হয়ে যায় তাঁর। বন্ধুরা অনেকেই পুরোনো ও প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। তাঁরা হলে থাকেন। অনেক সুযোগ-সুবিধা তাঁদের ক্যাম্পাসে। বন্ধুদের সঙ্গে নিজের তুলনা করে শুরুর দিকে আরও বেশি হতাশ লাগত। কিন্তু কয়েক দিন পরই ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল সব দুঃখ-হতাশা! পার্থ বলেন, ‘অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, সেটা ঠিক। কিন্তু আমাদের ক্যাম্পাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে ভালোবাসা ও আন্তরিকতা আছে, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। আমরা পুরো বিশ্ববিদ্যালয় একটা পরিবার। টাঙ্গাইলের সন্তোষে আমাদের ক্যাম্পাস, সে জন্যই বোধ হয় এখানে অসন্তোষের কোনো জায়গা নেই।’

 ফিরে দেখা

৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মাওলানা ভাসানী আসাম থেকে স্থায়ীভাবে চলে আসেন টাঙ্গাইলে। মজলুম এই নেতা টাঙ্গাইলের সন্তোষে বসেই দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন। রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষার আলো ছড়াতে তিনি এখানে গড়ে তোলেন স্কুল, কলেজ, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাঁর স্বপ্ন ছিল সন্তোষে একটি ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবেন। এর রূপরেখাও প্রণয়ন করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। সন্তোষেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।

মাওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর অনেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সন্তোষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। টাঙ্গাইলের মানুষও আন্দোলন করেছেন এই দাবিতে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় আর হয়ে ওঠেনি। অবশেষে ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওলানা ভাসানীর সমাধি প্রাঙ্গণেই বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০৩ সালের ২৫ অক্টোবর কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি)—এই দুই বিভাগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে পাঁচটি অনুষদের অধীনে ১৫টি বিভাগে ৪ হাজার ৯৯৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন।

চটপটির অপেক্ষায় শিক্ষার্থীর দল
চটপটির অপেক্ষায় শিক্ষার্থীর দল

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে বসবাস

টাঙ্গাইল শহরের মূল কেন্দ্র থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার পশ্চিমে সন্তোষ গ্রামের অবস্থান। এখানে ছিল পাঁচআনীর জমিদার ও ছয়আনীর জমিদারের বাড়ি। টাঙ্গাইলে অনেক স্কুল, হাসপাতালসহ জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন স্থাপনা এই জমিদারেরাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সন্তোষে ৫৭ দশমিক ৯৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসে এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে জমিদার দিনমণি চৌধুরাণী, জাহ্নবী চৌধুরাণী ও বিন্দুবাসিনী চৌধুরাণীর আমলের পুরোনো স্থাপনা, দিঘি, মন্দিরসহ বিভিন্ন কীর্তি। পাশাপাশি এই ক্যাম্পাসেই রয়েছে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর দরবার হল, জাদুঘর, কাগমারী সম্মেলনের স্মারক স্তম্ভ, ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ঐতিহ্যবাহী অনেক কিছু। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এখানে গড়ে তোলা হয়েছে ‘প্রত্যয় ৭১’ নামে একটি ভাস্কর্য, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ ও মুক্তমঞ্চ। তাই ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সঙ্গে এই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের বসবাস।

 ক্যাম্পাসে একদিন

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে ঢুকেই বোঝা গেল, আজ দিনটি আর দশটি দিনের মতো নয়। বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসের ছোঁয়া লেগেছে পুরো ক্যাম্পাসে। ক্লাসের পাশাপাশি এখানে-ওখানে জমেছে শিক্ষার্থীদের আড্ডা। ভাসানীর দরবার হলের সামনে ফুচকার দোকান ঘিরে বসেছিল একটা দল। তাঁদের আড্ডায় গিয়ে নাম-পরিচয় দিয়ে শুরু হলো আলাপচারিতা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মেয়ে জান্নাতুল কোবরা বললেন, ক্যাম্পাস তাঁর ভীষণ আপন। কেন? ‘কারণ এখানে একজনের সাহায্যে অন্যরা সবাই এগিয়ে আসে।’

পাশেই ছিলেন রাঙামাটির ছেলে শুখেন্দু চাকমা। তিনি জানালেন, ৭০ জন আদিবাসী শিক্ষার্থী রয়েছেন ক্যাম্পাসে। তাঁরা আদিবাসী ছাত্রদের একটি সংগঠনও গড়ে তুলেছেন। কম্পিউটারবিজ্ঞান বিভাগের মোশারফ হোসেন বললেন, ‘ক্যাম্পাসে আমাদের দিন ফুরিয়ে আসছে, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাগুলোরও সমাধান হয়ে যাচ্ছে। হল নির্মাণ হচ্ছে। আবাসন-সমস্যা দূর হচ্ছে। আমাদের পরে যারা আসবে, তারা এগুলো ভোগ করতে পারবে।’ কথা বলতে তাঁরা আবার ডুবে যান ‘বাসন্তী আড্ডায়’। প্রশাসনিক ভবনের সামনে, দিঘির পাড়ে গাছের সারির ফাঁকে ফাঁকে দল বেঁধে বসেছিলেন শিক্ষার্থীরা। কয়েকজনকে দেখা গেল সেলফি তুলতে ব্যস্ত।

বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ এলাকায় দেখা গেল, সদ্য ক্লাস শেষ করে এসে বসেছে একদল শিক্ষার্থী। সেখানে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সোহেল রানা জানান, লেখাপড়ার পাশাপাশি এখানকার ছাত্ররা বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী তাসলিমা নুসরাত বললেন, ‘কিছুদিন আগে গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী আশরাফুন্নাহার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে। তার চিকিৎসার খরচ জোগাতে সব বিভাগের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এসেছিল।’

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে টেকনোকালচার ক্লাব, ফিল্ম সোসাইটি, ড্রামাটিক ক্লাব, ফটোগ্রাফি সোসাইটি, আবৃত্তি সংসদ, চারুকলা পরিষদ, রোটারি ক্লাব, লিও ক্লাবসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ক্যাম্পাসে সক্রিয় আছে। অপরাধ তত্ত্ব ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মুক্তার আহমেদ জানান, তাঁরা ফিল্ম সোসাইটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন দিবসে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও কর্মশালার আয়োজন করেন।

শিক্ষার পরিবেশ আরও উন্নত হবে
মো. আলাউদ্দিন
উপাচার্য, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল

মো. আলাউদ্দিন
মো. আলাউদ্দিন

বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ৩৪৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকার প্রকল্প পাস হয়েছে। আগামী তিন বছরে এই টাকায় উন্নয়নকাজ করা হবে। পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য একটি বড় পরিকল্পনা আছে। এ প্রকল্পের আওতায় ১২ তলা একাডেমিক ভবন, ১০ তলা ছাত্রী হল, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের আবাসনসহ প্রয়োজনীয় সব অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। আশা করি, টাঙ্গাইলের মানুষের সহায়তায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত যে সমস্যা রয়েছে তা দূর হবে। পাশাপাশি শিক্ষার পরিবেশ আরও উন্নত হবে।