রোবট নিয়ে পড়ালেখা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ছবি: খালেদ সরকার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ছবি: খালেদ সরকার

শহীদ মিনারের উল্টো দিকে কাজী মোতাহার হোসেন ভবনের তিনতলা। উত্তর–পূর্ব দিকে ছোট্ট একটি গবেষণাগার—মেকাট্রনিকস ল্যাবের কাছে যখন পৌঁছলাম, ততক্ষণে বিকেল। ল্যাবের ভেতর তখনো গুটিকয়েক শিক্ষার্থী ছোট ছোট দলে বসে আপন মনে কাজ করে যাচ্ছেন। কাজ বলতে ছোট ছোট রোবট তৈরি করা হচ্ছে। তাঁদের সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো বটেই, সারা দেশের জন্যই এই বিভাগটি নতুন। বিভাগের চার শিক্ষার্থী রাগীব আমিন, মনীষা মুস্তারী, নওয়ারা মাহমুদ এবং তাসিন জুলকারনাইন এগিয়ে এসে জানালেন, দুই বছর হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং চালু হয়েছে। তাঁরা এই বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। এখন পড়ছেন দ্বিতীয় বর্ষে।

শুরুর গল্পটা জানালেন রাগীব। ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জানালেন, জার্মানি গিয়ে তিনি মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যাপকতা দেখেছেন। তখনই তাঁর মাথায় আসে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ের ওপর কিছু করা যায় কি না। দেশে এখন পর্যন্ত যাঁরা মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস, কম্পিউটার প্রকৌশল কিংবা প্রকৌশলের অন্যান্য শাখায় পড়ছেন, তাঁরাই শখের বশে রোবটিকস নিয়ে কাজ করেন। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবটিকস ক্লাবও আছে। কিন্তু বিশেষায়িতভাবে রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের বিশেষত্ব কী? মনীষা বললেন, ‘ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল, কম্পিউটার প্রকৌশল—সব জ্ঞানই রোবট তৈরির কাজে লাগে। তাই যাঁরা এগুলোর কোনো একটা বিভাগে পড়ছেন, নিজ আগ্রহে তাঁরা বাকি বিভাগের কাজ শিখে এত দিন রোবটিকসের কাজ করে আসছেন। কিন্তু আমাদের এখানে কারিকুলাম এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রোবটিকসেই আমাদের মূল ফোকাস থাকবে।’

রোবটিকস নিয়ে কেন পড়ছেন? প্রশ্নের জবাবে তাসিন বলেন, ‘আমাদের দেশে এখনো দেখা যায়, বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিতে অটোমেশনে অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারের জন্য বাইরের দেশের প্রকৌশলীদের ওপর নির্ভর করতে হয়। কারণ, আমাদের দেশে পুরোপুরি এই বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা নেই। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল এই বিষয়ে পড়ব। যখন শুনলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকাট্রনিকস বিভাগ চালু হবে, তখন আর দ্বিতীয় চিন্তা করিনি।’ ওদিকে নওয়ারা মাহমুদের বক্তব্য, ‘আমার অবশ্য ইচ্ছা ছিল তড়িৎ কৌশল নিয়ে পড়ার। ভর্তির আগে যখন দেখলাম এই বিভাগের নাম, তখন মাথায় এল, এখানে পড়লে তো শুধু ইলেকট্রিক্যালই নয়, মেকানিক্যাল কিংবা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বাদটাও পাওয়া যাবে।’

দুই বছরের এই যাত্রা প্রসঙ্গে শিক্ষার্থীরা জানালেন, শুরুর দিকে মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশোনা হয় বলে তাঁরা নিজেরাই শিক্ষকদের সহায়তায় বিভিন্ন সময়ে কর্মশালার আয়োজন করেছেন। কর্মশালায় রোবটিকসের খুঁটিনাটি বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই কম্পিউটার কৌশলের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আকাশ। যিনি ইতিমধ্যেই বেশ কিছু রোবটিকস প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতে এসেছেন। এরপর থেকে এখন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরাই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মশালার আয়োজন করেন। নিজেদের মধ্যে সখ্য বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য কর্মশালা শেষে থাকে কিছু প্রতিযোগিতার ব্যবস্থাও।

ইতিমধ্যে শুধু এ বিভাগের জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি আধুনিক গবেষণাগার চালু হয়েছে বলে জানালেন শিক্ষার্থীরা। ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস, মেকাট্রনিকস, ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং এবং কম্পিউটার ল্যাব। প্রক্রিয়াধীন আছে রোবটিকস ল্যাব এবং কন্ট্রোল সিস্টেমস ল্যাবের কার্যক্রম।

নতুন বিভাগ, শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের হৃদ্যতাটাও অন্য রকম। ছাত্রছাত্রীরা তাই বারবার ঘুরেফিরে শিক্ষকদের কথা বললেন। ‘এমনও দেখা গেছে যে আমাদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা দরকার, তখন বিভাগীয় চেয়ারপারসন লাফিফা ম্যাডাম ব্যক্তিগতভাবে অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন, যেন আমরা ঠিকঠাকমতো কাজ করতে পারি।’ তাসিন বললেন। শুধু তা–ই নয়, সকাল থেকে প্রয়োজনে রাত পর্যন্ত ল্যাবের কাজে ও অন্য যেকোনো দরকারে শিক্ষকেরা সব সময় ছাত্রছাত্রীদের পাশে থাকেন।

গত ১৪ জুলাই ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া একটি প্রতিযোগিতায় এই নতুন বিভাগের নতুন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা তৃতীয় পুরস্কার জিতেছেন। তবে শুধু প্রতিযোগিতায় পুরস্কার প্রাপ্তিই নয়, এই বিভাগে পড়ে দেশের জন্যও অবদান রাখতে চান শিক্ষার্থীরা।

মুঠোফোনে কথা হলো বিভাগীয় প্রধান চেয়ারপারসন লাফিফা জামালের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং মূলত একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি বিষয়। তাই এর চাকরি ক্ষেত্রটাও ব্যাপক। দেশে অনেক অটোমেটেড ইন্ডাস্ট্রি আছে, যেগুলোতে কাজ করার জন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসতে হয়, ফলে প্রতিবছর দেশ থেকে প্রচুর অর্থ দেশের বাইরে চলে যায়। আমাদের দেশে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ থাকলে অনেক খরচ কমে যেত এবং দেশের মুদ্রা দেশেই থাকত।’ তাঁর মতে, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র তৈরি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োমেকানিক্যাল সিস্টেম ডিজাইন, স্মার্ট ভেহিকেল ডিজাইন, ন্যানো টেকনোলজি সিস্টেম ডিজাইন, হিউম্যানয়েড রোবট ডিজাইন—সব ক্ষেত্রেই এ বিষয় থেকে কাজ করার সুযোগ আছে।