ছুটিতে ক্যাম্পাসের কী মিস করি?

>কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস যখন ছুটি থাকে, কী সবচেয়ে বেশি মিস করেন? জানতে চেয়ে আমরা লেখা আহ্বান করেছিলাম শিক্ষার্থীদের কাছে। আজ তাঁদের লেখা নিয়েই স্বপ্ন নিয়ের বিশেষ আয়োজন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

আমার পথচলা

লামিয়া হাসান

বুয়েট অনেকের কাছে যেমন স্বপ্নের জায়গা, আমার কাছেও তা–ই। ভর্তিপরীক্ষার দিনই বুয়েটে প্রথম পা রাখা, এর আগে কখনো আসা হয়নি। প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছিল, যেমন করেই হোক, এই সুন্দর, ছিমছাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে চান্স পেতেই হবে। অবশেষে চান্স পেলাম। ক্যাম্পাস বন্ধ হলেই মিস করতে থাকি প্রিয় প্রাঙ্গণ, প্রিয় বন্ধুদের।

ক্লাস চলাকালে প্রায়ই বন্ধুরা মিলে একেকজনকে ‘পচানি’ দিই। বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, সেই একজনটা আমি! তখন বন্ধুদের এই খেপানোতে মন খারাপ হলেও ছুটিতে এটাই বেশি মিস করি। অদ্ভুত অদ্ভুত সব নামে ডাকা, দলবেঁধে খাওয়াদাওয়া, ঘুরতে যাওয়া, ক্যাম্পাসে দলবেঁধে হেঁড়ে গলায় গান গাওয়া...সবকিছুই মিস করি খুব। বুয়েটে মিস করার মতো অনেক কিছুই আছে—হাফওয়াল, ক্যাফেটেরিয়া, স্থাপত্য অনুষদ, স্টাফ ক্যানটিন, পুরকৌশল ভবন...কিন্তু আমি সবচেয়ে বেশি মিস করি ক্যাম্পাসের সরু, সুনসান রাস্তাটা। রাস্তার দুই ধারে ঘন সবুজ গাছপালা আর পাখির ডাকে সব সময় এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে। গাছের আড়াল থেকে ঝপ করে নামা সন্ধ্যা দেখে মনের কোণ থেকে সব দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়। হঠাৎ কোনো কারণে মন খারাপ হয়ে গেলে মন ভালো করার সঙ্গী ওই রাস্তাই। বিকেলের মিষ্টি রোদে ক্যাম্পাসের রাস্তায় একাকী হাঁটলে মনের মধ্যে একটা স্বর্গীয় আনন্দ ভর করে। কোলাহলমুখর এই নগরজীবনে রাস্তাটা আমার কাছে খুব আপন, স্বস্তিদায়ক। হলে থাকার সুবাদে যখনই আমার ইচ্ছে হয়, তখনই ছুটে চলে যাই এই রাস্তায়। শান্ত, পরিপাটি পথটা ঘিরে আমার চার বছরের বুয়েটজীবনে অনেক সুন্দর স্মৃতি রচিত হবে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

প্রথম বর্ষ, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের রাতদুপুরের আড্ডাগুলো

জুবায়ের শাওন

ক্যাম্পাস আমার অন্য এক জীবন, অন্য এক অনুভূতি!

মাঝেমধ্যে ভাবি! খুব ভাবি। পড়াশোনার শেষে যখন এই ক্যাম্পাসটা ছাড়ব, যখন পাশে এই পাগলাটে বন্ধুগুলো থাকবে না, তখন বুকের ভেতর কত হাহাকার খেলে যাবে! কতটা শূন্য লাগবে আমার দুনিয়া আর একা লাগবে নিজেকে! একসময় আর ভাবতে পারি না। বুকের বাঁ পাশটায় ব্যথা করে। কেমন চিনচিনে একটা ব্যথা!

আমাদের ক্যাম্পাসটা ছোট। একেবারেই ছোট। কিন্তু যেন সাজানো-গোছানো এক পরিবারের আঙিনা! সে আঙিনা শত প্রাণের পদচারণে মুখর।

ঈদের ছুটি, পুজো বা গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি ফেরা হয় কিছুটা লম্বা সময় হাতে নিয়ে। বাড়ি ফিরলে সবার মতো আমারও ভালো লাগে। কিন্তু সেই ভালো লাগার ভেতরেও কোথাও একটা বিষণ্নতা লুকোনো। রাতগুলো যেন একা, খুব আলসেমিতে কাটে। বিশেষ করে, আমার মতো রাতজাগা পাখির জন্য এই রাতগুলো খুব কঠিন।

ক্যাম্পাসের মানুষগুলো পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকে। ক্লাসের শেষে সবার চোখেমুখে কেমন একটা ক্লান্তি, একটা অবসাদ চোখে পড়ে। তারপরও যখন রাত বাড়তে থাকে, নিশ্চুপ ক্যাম্পাসটা কেমন যেন জেগে উঠে। সে এক অদ্ভুত জাগরণ! রাত যখন গভীর, দূর থেকে হঠাৎ ভেসে আসে সম্মিলিত কণ্ঠের গান, কখনোবা একসঙ্গে সবার অদ্ভুত অট্টহাসি! তাতে মিশে থাকে প্রাণের ছোঁয়া।

ছুটি হলে মিস করি এগুলোই। ধরুন, রাতে পড়তে বসেছি। হঠাৎ বন্ধু এসে বলল, ‘কী করবি এত পড়ালেখা করে, আয় গান গাই।’ ব্যস! শুরু হয়ে গেল গান। সে গানে সুর থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বেসুরো গলাতেই জমে ওঠে আমাদের মধ্যরাতের গানের আসর। কখনোবা গান বাদ দিয়ে আড্ডা। আমাদের আড্ডাগুলো জমে শহীদ মিনারে খোলা আকাশের তারা বা টিভি রুমে মধ্যরাতে ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে। কখনো মনে হলো তো ক্যাম্পাসের পাশের চা–দোকানটায় জমল চা-পার্টি! সঙ্গে গিটার থাকলে তো কথাই নেই!

শুধু ছুটিতে কেন, যখন এই প্রাণের ক্যাম্পাসটাতে থাকব না; প্রতিটা মিনিট, প্রতিটা সেকেন্ড মিস করব। বন্ধুরা, মিস করব তোদের, তোদের আড্ডা আর বেসুরো গানের জমজমাট আসরটাকে!

তৃতীয় বর্ষ, মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বন্ধুরাই সব

দিশিকা জামান

প্রাণের বন্ধুদের সঙ্গে লেখক (বাঁ থেকে চতুর্থ)
প্রাণের বন্ধুদের সঙ্গে লেখক (বাঁ থেকে চতুর্থ)

সকালের ক্লাসে ঘুম-ঘুম চোখে যেই মুখগুলো দেখি, যাদের কারণে সকালের ‘ঘুম হরণকারী’ ক্লাসটাও সহনীয় মনে হয়, ক্যাম্পাস বন্ধ হলে সবচেয়ে মিস করি তাদেরই। তাদের সঙ্গেই আড্ডা, ঘোরাঘুরি...ক্লাস শেষেও এই মানুষগুলোকে ছেড়ে আসতে ইচ্ছা হয় না। কখনো আড্ডা বসে টিএসসিতে, কখনো-বা মলচত্বরের ঘাসের ওপর অথবা শহীদুল্লাহ হলের পাশের পুকুরপাড়ে।

এই বন্ধুগুলোর সঙ্গেই ক্লাসের ফাঁকে চলে যত দুষ্টুমি, হাসাহাসি। সে জন্য টিচারের কাছে বকাও খেতে হয় কখনো। তখন বকা দেওয়ার জন্য ক্লাসে দাঁড় করালে সবচেয়ে বেশি হাসে এই বন্ধুরাই। পরীক্ষার আগের রাতে প্রস্তুতি নিয়ে কান্নাকাটির চেয়ে হাসাহাসি করে রাত পার করে দেওয়া, ক্লাসের মধ্যে দীর্ঘ বিরতিতে নীলক্ষেতে মামার দোকান বা লালবাগের রেস্তোরাঁয় দল বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়া, রিকশায় যত দূর ইচ্ছা চলে যাওয়া অথবা কারও জন্মদিনে লুকিয়ে কেক এনে কাটার মধ্যে যে অসামান্য আনন্দ, সব তো এই বন্ধুদের জন্যই।

প্রিয় ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেলে তাই মিস করি বন্ধুদের। ঈদের ছুটিতে সবাই যার যার বাড়ি চলে গেলে, এই মুহূর্তগুলো তখন বারবার মনে পড়ে। সামনাসামনি বসে আড্ডাতে যেই আনন্দ, ভার্চু্যয়াল দুনিয়ায় সেটা অনেকটাই ফিকে হয়ে যায়।

তৃতীয় বর্ষ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ

‘মেডিকেলীয়’ ভালো লাগা

আয়েশা আলম

মেডিকেল কলেজে এত পড়ালেখার চাপ...তবু সত্যি বলছি, যখনই ছুটি হতো, খুব বেশি দিন ভালো লাগত না। কারণ, ছুটি হলেই প্রচণ্ড মিস করি কলেজের লেকচার গ্যালারিতে বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি।

কিছু ক্লাস খুব মন দিয়ে করি, আবার কিছু ক্লাস ফাঁকিবাজি-দুষ্টুমিতে কেটে যায়। কেউ যদি ভুলেও ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়ে, সেদিন তার খবর আছে! ক্লাসে ঘুমানোর ছবি মুহূর্তে ছড়িয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে, তৈরি হয় ট্রল। বেচারার পুরো দিনটা মাটি করতে আমাদের মতো একটা দস্যুবাহিনীই যথেষ্ট।

প্রতিদিন সকালে মিস করি কলেজের সামনের টংয়ের শিঙাড়া, পরোটা-ভাজি। আর মামার চা, সেটা তো দুনিয়ার সেরা! মিস করি কলেজ লাউঞ্জে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা। মাঝেমধ্যে ক্লাস বাদ দিয়েও আড্ডা চলতে থাকে। মিস করি লাইব্রেরিতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়া বা পড়ার মধ্যে জোরে কথা বলার দায়ে লাইব্রেরিয়ানের ঝাড়ি। কত দিন কত রাত এই লাইব্রেরিতে বসে কঠিন থেকে কঠিনতম প্রফের পড়া পড়েছি! মাঝেমধ্যে পড়ার ফাঁকে টেবিলের ওপর হাবিজাবি লেখাগুলো পড়তাম, কত যে উদ্ভট কথা লেখা থাকে!

কলেজের মিলনায়তন আর তিন তলায় মহড়ার জায়গাটাও মিস করি। প্রথম বছর থেকেই নাচ-গান করে আসছি কলেজের মঞ্চে। মঞ্চই আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা।

কলেজ ক্যান্টিনের কফি আমার কাছে যেকোনো দামি কফিশপের কফির চেয়েও বিশেষ কিছু। মিস করি দলবেঁধে স্যারদের কাছে আইটেম (ভাইভা পরীক্ষা) দেওয়া। কেউ স্যারের সামনে গিয়ে তোতলায়, কেউ ভয়ে জানা উত্তর ভুলে যায়, কেউ বা পছন্দের ম্যাডাম অথবা স্যারের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে আর পড়া বলতে পারে না! আমি আইটেম দেওয়ার ভয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে লুকিয়ে থাকতাম। বান্ধবী মনি, প্রিতম জোর করে নিয়ে যেত। ছুটি শেষে যখন মেডিকেলে ফিরি, প্রিয় মানুষগুলোকে দেখলে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে।

শিক্ষার্থী, শেষ বর্ষ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আড়িয়াল বাস

আতিক বিন হাবিব

মাওয়া ঘাট থেকে যারা নিত্যদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করেন, আড়িয়াল বাস তাদের কাছে একটা পরিচিত নাম।

ক্যাম্পাস খোলা থাকলে মুন্সিগঞ্জের নিমতলা থেকে আমি আড়িয়ালের যাত্রী হই। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বাসে যাওয়া-আসা করতে করতে ‘ক্লাসমেটদের’ পাশাপাশি অনেক ‘বাসমেটও’ জুটে গেছে। খুব সকালে ক্যাম্পাস বাসে ওঠার পর দেখা হয় ঘুমকাতুরে বন্ধু একরামের সঙ্গে। বাস ছুটে চলে, বাসের ঝাঁকুনির সঙ্গে আমরাও ঘুম ঘুম চোখে এক ছন্দে দুলতে থাকি। কেউ কেউ আছে ব্যতিক্রম। তারা বই পড়ে, পাশের বন্ধুর সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়। একসময় সবাই একসঙ্গে পৌঁছে যাই প্রাণের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।

ক্লাস শেষে আবার এক হই আমরা আড়িয়াল বাসের যাত্রীরা। কেউ কেউ বাসের গেটে দাঁড়িয়ে হেলপারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বাবুবাজার ব্রিজের ওপর দিয়ে বুড়িগঙ্গা পার হয়েই আমরা ঢাকা শহরকে গুডবাই জানাই। শহরের জ্যাম আর কোলাহল পেছনে ফেলে আশ্রয় নিই প্রকৃতির কোলে। প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে চলতে থাকা আড়িয়াল হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। শুরু হয় গান। কখনো দেশের গান, কখনো লালন, কখনো পুরোনো দিনের বাংলা গান, কখনো বা আধুনিক।

এভাবে কখন যে ধলেশ্বরী সেতু পার হয়ে বাসায় পৌঁছে যাই, টের পাই না। অনেক সময় অন্য বন্ধুরাও আড়িয়াল বাসে আমাদের সঙ্গী হয়। আমরা পদ্মার তীরে রাত্রি যাপন করি, ফুটবল খেলি, কিংবা পদ্মার পাড়ে বসে ইলিশ ভাজা খাই। কিন্তু যখন ক্যাম্পাস ছুটি থাকে, তখন সবচেয়ে মিস করি লাল বাস আড়িয়ালকে। মিস করি বাসে ফেরিওয়ালা সেজে সবাইকে ভড়কে দেওয়া কিংবা চিৎকার করে গান গাওয়ার আনন্দগুলো। মিস করি ড্রাইভার মামা আর আমার বাসমেট বন্ধুদের।

চতুর্থ বর্ষ, ইতিহাস বিভাগ

আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

এক প্লেট ফুচকা আর একটা পরিবার

তাহমিনা ইসলাম

বন্ধুদের সঙ্গে লেখক (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)
বন্ধুদের সঙ্গে লেখক (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)

আমাদের ছোট্ট একটা ক্যাম্পাস। তবু কোনো কিছুর কমতি নেই। ক্লাসের ব্রেকে জমে আড্ডা, আর এখানকার ব্রেক মানেও তো দুই-তিন ঘণ্টা। আড্ডা দেওয়ার বেশ কয়েকটা জায়গা আছে। রেডেক্স, হাওয়া ভবন, ক্যানটিন। বন্ধুরা মিলে প্রায়ই আড্ডা দিই রেডেক্সে। মজা করে জায়গাটার নাম দিয়েছি অফিস। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতে গিয়ে মাঝেমধ্যে কখন যে বিকেল হয়ে যায়, টেরও পাই না। খেলা হয়—মনোপলি, উনো।

ক্যানটিনের সামনে আড্ডা মানেই সেলফি তোলা। চেয়ার, টেবিল, আমাদের মুখ, ফুচকা বা শিঙাড়া—কোনো কিছুই বদলে যায় না, তবু কেন যেন প্রতিদিন সেলফি তুলতে ভালো লাগে। গল্পের ফাঁকে হয় খাওয়াদাওয়া, ফুচকার টক নিয়ে কাড়াকাড়ি। এক প্লেট ফুচকায় ভাগ বসাই সবাই। বন্ধু মহলে একটা মোটা ছেলে আছে। আদর করে সবাই গোগু ডাকে। সব সময় সে ব্যাগে ক্যামেরা নিয়ে ঘোরে। সুযোগ পেলেই ছবি তুলতে থাকা তাঁর অভ্যাস।

মাঝেমধ্যে সুযোগ পেলে চলে যাই ক্যাম্পাসের পাশে হাতিরঝিলে, সেখানে জমে গান আর আড্ডা। আমরা খুব একটা বন্ধ পাই না। সেমিস্টার ব্রেকে লম্বা একটা ছুটি থাকে প্রায় এক মাসের। কুইজ, ল্যাব, ক্লাসের ঝক্কি থেকে এক মাস মুক্তি পেলেও দীর্ঘ এক মাসে ক্যাম্পাসের আড্ডা, প্রিয় মুখগুলোকে মিস করি খুব। আর মিস করি ক্যানটিনের ফুচকা।

প্রথম বর্ষ, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল

সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল

প্রিয় ক্যাম্পাস, প্রিয় মুখ

মেহেনাজ রাওফিন

প্রাণপ্রিয় কলেজের সবুজ মাঠ, মুক্ত মঞ্চের পাশের পুকুরপাড় কিংবা শহীদ মিনারের সামনে বটতলায় সেই চেনা মুখগুলো—ছুটির দিনে এসবই তো মিস করি। ছুটির সময় সুখ-দুঃখ, পাওয়া না-পাওয়া, জানা-অজানার কত কথা জমে যায়! বন্ধুদের সামনে সেসব না বলা পর্যন্ত স্বস্তি নেই।

আড্ডার মধ্যে মামুন ভাইয়ের চা, পরোটা কিংবা শিঙাড়া আমাদের নিত্যদিনের রুটিন। ঝালমুড়ি, ফুচকা, চটপটি, আচার—সবাই মিলে এসব খাওয়ার আনন্দ ছুটির দিনগুলোয় অধরা থেকে যায়। প্রিয় মুখ মেঘলা, মুক্তা, ইশা, স্বপ্না, সর্বজিৎ, সঞ্জয়, মেহেদীর মতো বন্ধু সঙ্গে থাকলে গোমড়া মুখে বসে থাকা প্রায় অসম্ভব। ছুটির দিনগুলোয় অপেক্ষায় থাকি, কবে ক্যাম্পাস খুলবে, আবারও প্রাণ খুলে হাসব।

চতুর্থ বর্ষ (সম্মান), হিসাববিজ্ঞান

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাড়ে সাত কিলোমিটার ভালোবাসা

ফাহিম প্লাবন

ক্লাস শেষ হলো। নাজমা ম্যাম সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলেন। চারতলার বারান্দায় আসতেই শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়ানো চিরচেনা লাল ডাবল ডেকারগুলো চোখে পড়ল। ঠিক বেলা একটার সময় বাস ক্যাম্পাস ছেড়ে যাবে। নিচে নেমেই ব্যাগটা হাবিবকে দিয়ে বললাম, ‘বাসের দোতলায় জানালার পাশে রাখিস।’

সিনিয়র ভাইদের সঙ্গে ঈদের প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলতে বলতে যখন ক্যাম্পাসের মিলনায়তনের পথ ধরেছি, ঠিক তখনই দেখি বাস চলতে শুরু করেছে। ছুটে গিয়ে বাস ধরলাম। ক্লান্ত শরীরে জানালার পাসে বসতেই বাস ক্যাম্পাসের প্রধান ফটক পেরিয়ে বাঁয়ে মোড় নিল।

শীতল বাতাস, বৃষ্টি আসবে আসবে ভাব। বাসটা সেলিম মামার চায়ের ঢিবি পার হতেই নিচতলার দরজায় দাঁড়ানো ভাইয়ারা গান ধরলেন, ‘আকাশ এত মেঘলা যেও নাকো একলা, এখনই নামবে অন্ধকার...’। মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকলাম। লাল-সবুজ ডাবল ডেকারগুলো একটার পর একটা ছুটছে মাইজদির দিকে। জেড মোড় পার হতেই ডান পাশের খালটায় একদল হাঁসের আপন মনে ভেসে বেড়ানো চোখে পড়ল। সোনাপুর জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত খালটি বয়ে চলবে আমাদের সঙ্গে। খাল সরু হলেও বর্ষার পানিতে টলমল করছে আর দুই পাশ থেকে ছাউনির মতো হয়ে গাছগুলো খালটা ঢেকে রেখেছে। নিচতলা থেকে তখনো গানের গলা শোনা যাচ্ছে, ‘চলো না ঘুরে আসি আজানাতে/ যেখানে নদী এসে থেমে গেছে’। দিন শেষে যখন ক্লান্ত শরীর-মন নিয়ে এই ডাবল ডেকারগুলোতে চেপে বসি, মনটা ভালো হয়ে যায়।

একসময় সিনেমা হলের সামনে নেমে মেসের পথে হাঁটা শুরু করলাম। ঈদের লম্বা ছুটির পর আবার প্রিয়মুখগুলোর সঙ্গে দেখা হবে, মিস করব এই সাড়ে সাত কিলোমিটারের মনোমুগ্ধকর পথচলা। পেছনে ফিরে আরও একবার ডাবল ডেকারটা দেখলাম। কত রং, ভালোবাসা, হাসি-ঠাট্টা, অনুপ্রেরণা, বন্ধুত্ব, স্মৃতি জড়িয়ে আছে বাসগুলোতে। ক্যাম্পাসের দোতলা বাসও আমাদের বড্ড আপন।

প্রথম বর্ষ, পরিসংখ্যান বিভাগ

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ফিরে ফিরে দেখি

মো. জাহিদুল হক

ছুটি মানেই মজা, আনন্দ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে শব্দটা বড় দুর্লভ। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন থাকি, মনে হয় কবে ছুটি পাব! কিন্তু এই আনন্দ কেন যেন বাসায় যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্তই টেকে। বাসায় পা রাখার পর মনে হয়, কী যেন একটা নেই, কিছু একটা যেন পেছনে ফেলে এসেছি। প্রথমেই মনে পড়তে থাকে রুমমেটদের কথা। যাদের সঙ্গে খুনসুটি সারা দিন লেগেই থাকত। রাতদুপুরে হুটহাট সিদ্ধান্ত—ব্যস, মাঝরাতে চা খেতে বেরিয়ে পড়া। আড্ডা, রুমের ভেতর নাচানাচি, চিৎকার করে গান ধরা...! মিস করি ক্লাসের বন্ধুদেরও। ওরাও তো একেকটা ভালোবাসা! এর–ওর পেছনে লাগা, এটা-ওটা লুকিয়ে রাখা, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাওয়া...বাঁদরামি কোনোটা বাদ পড়ে না।

ক্লাস চলাকালে ভাবতে থাকি, কীভাবে শিক্ষকদের হাত থেকে বাঁচা যায়। অথচ ছুটির দিনে এই স্যার-ম্যাডামদের কথাগুলোই খুব মিস করি। আমরা কী করি না করি, সব তাঁরা জানেন-বোঝেন। যে মানুষগুলো সব সময় আমাদের ভালো চান, তাঁদের কি ভোলা যায়?

আর বেশি দিন নেই। ক্যাম্পাস ছেড়ে যাব। কিন্তু মিস করব সবাইকে। মিস করব টংয়ের দোকানে মারামারি করে খাবার কেনা, ভালোবাসার ক্লাসরুম আর হলে নিজেদের রুমে আমাদের চারজনের ‘সংসার’।

তৃতীয় বর্ষ, গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিং

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

চেনা ক্যাম্পাস, অচেনা ঘর

ফাতেমা আফরিন

শুনেছিলাম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্টের তেমন চাপ নেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে প্রবেশ করা মাত্র সেই ধারণা এক নিমেষে উড়ে গেল। প্রথম বর্ষে প্রথম যেবার ছুটি পেলাম, মনে হয়েছিল ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, হোমওয়ার্ক, ফিল্ড ওয়ার্কসহ হলে থাকা নামক নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলাম। ছুটি পেয়েই কোনোমতে হল থেকে নিজের তল্পিতল্পা নিয়ে বাসার দিকে দে ছুট! তখন হলের গণরুমে থাকতাম, এত মানুষের মধ্যে থাকতে থাকতে যে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি, টের পাইনি। অতঃপর বাসায় যাওয়ার পর বাসাটাকে মনে হলো, ‘আরে! এ তো বন্দীশালা!’

তখন গণরুমের সবাই মিলে খাবার কাড়াকাড়ি করে খাওয়া থেকে ঢালাওভাবে মাটিতে শুয়ে থাকাটাও মিস করতাম। কথাগুলো প্রথমবারের ছুটির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকলেই বেশ হতো, বাসায় থেকে স্কুল-কলেজের মতো ছুটিটা উপভোগ করা যেত। তবে তা আর হয়নি। বাসায় গেলেই ক্লাস, বন্ধু, ফিল্ডওয়ার্ক সবকিছু বেশি বেশি করে মিস করা শুরু করি। সবচেয়ে বেশি মিস করি আমাদের ডিপার্টমেন্টের খন্দকার হাসান মাহমুদ স্যারের ক্লাস। তিনি সকাল সাড়ে আটটায় ক্লাস নেন। এক সেকেন্ড দেরিতে গেলে ক্লাসে ঢুকতে দিতে চান না। ছুটির দিনগুলোতে যখন অবচেতন মনের অ্যালার্মে ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠি, তখন মনে হয় ছুটির ছলে বাসা নামের এই বন্দীশালার চেয়ে স্যারের ভয়ে ক্লাসে দৌড়ানোই বোধ হয় ভালো।

ফিল্ডওয়ার্কে শামসুল আলম স্যারকে ফাঁকি দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে গাছে উঠে সেলফি তোলা, রাত ১০টা পর্যন্ত সব বন্ধুবান্ধব মিলে ক্যাম্পাসের মধ্যে বড় রুটির মতো গোল চাঁদ দেখতে দেখতে আড্ডা, ভ্যানের মধ্যে চিৎকার করে বেসুরে গান গাইতে গাইতে ক্যাম্পাসের এক মাথা থেকে আরেক মাথা ঘুরে বেড়ানো, পিঠা চত্বরের পুকুর পাড়ে বসে রাতের ঠান্ডা শীতল বাতাসে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া কিংবা বটতলায় খেতে গিয়ে, ‘মামা...গেটিস... গেটিস, হাফ ভাত...দাও...’ বলে চিৎকার করে ডাকাডাকি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ‘খালি মামা...খালি মামা’ বলে রিকশা খোঁজার চিৎকারগুলোও ভীষণ মিস করি। মিস করার পরিমাণটা দ্বিগুণ হয় যখন মনে হয় আর মাত্র তিনটা বছর, তারপর ছুটি শেষে প্রিয় ক্যাম্পাসে ফেরার অপেক্ষায় আর থাকব না। ছুটির ছলেবলে আমি আর কিছুদিনের জন্য প্রিয় ক্যাম্পাসকে বিদায় জানাব না, তখন ক্যাম্পাসই আমাকে পুরোপুরি বিদায় জানিয়ে দেবে!

দ্বিতীয় বর্ষ, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

ক্যাম্পাসের রসায়ন

জান্নাতুল ফেরদৌস

রসায়নে পড়ার সুবাদে সপ্তাহের পাঁচ দিনই আমাকে ক্লাস করতে হয়, তা–ও বেশির ভাগই নয়টা থেকে পাঁচটা। দল বেঁধে ঘুরতে যাওয়ার কিংবা আড্ডা দেওয়ার সময় কোথায়! সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্লাসে যাও, দৌড়ে বাস ধরো, ঝুলে ঝুলে বাসায় ফেরো, এরপর টিউশনি কিংবা পড়তে বসা। তবু আমরা এই ব্যস্ততাকেই নিজেদের মতো উপভোগ্য করে নিয়েছি, সাজিয়ে নিয়েছি।

আমাদের বিভাগটা সবার পেছনে এবং পাহাড়ের ওপর হওয়ায় কষ্টটা হয় বেশি। দল বেঁধে ওঠার সময় প্রায়ই অর্ধেক উঠে মাটিতে বসে পড়ে কেউ কেউ। কেউ আবার কাউকে টেনে টেনে তোলে। এরপর আবার তিনতলায় ওঠো, বেশ একটা ব্যায়াম হয়ে যায়! আশপাশের অন্য ডিপার্টমেন্টের সবাই যখন চলে যায়, আমরা তখনো ক্লাস করি। অন্যরা প্রায়ই ঘুরতে যায়, আমাদের সেই সময় কোথায়! তবু একটা ক্লাস না হলে দৌড়ে চলে যাই শালবন কিংবা পেছনের পাহাড়টায়, শহীদ মিনার বা ক্যাফেতে। আর সঙ্গে কাঁঠালতলা, বন্ধু চত্বর তো আছেই।

আমরা যখন একত্র হই, আমাদের চেঁচামেচিতে আশপাশের মানুষ বিরক্ত হবেই। ছুটিতে তাই কথা বলার মানুষ নেই। লাফালাফি করার কেউ নেই। কোনোদিন যদি বাসে সিট পাই, সেদিন আমাদের ঈদের দিন। খাতা, বই, কলম যা পাই, সব দিয়ে বাসের সিট দখল রেখে দিই। সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে, গান গেয়ে বাসায় ফিরি।

ছুটিতে রাস্তায় কোথাও লাল বাস দেখলেই ক্যাম্পাসটার কথা মনে পড়ে। দুপুরে খেতে দৌড়ে গিয়ে সবার জন্য জায়গা রাখা, মামা এটা দেন–ওটা দেন বলে দোকান মাথায় তুলে রাখা, মিস করার বিষয়ের অভাব নেই। ছুটিতে ক্যাম্পাসের ধূলিকণাগুলোও মনে পড়ে। একসময় এই ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাব ভাবতেই কেমন লাগে! যতই কঠিন লাগুক রসায়ন, তবু প্রতিটা মুহূর্ত ভালো লাগার, ভালোবাসার। তাই তো সারা বছর বলি, কখন ছুটি শুরু হবে আর ছুটি শুরু হলে বলি, কবে ক্যাম্পাস খুলবে!

তৃতীয় বর্ষ, রসায়ন বিভাগ

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

খুব ভালোবাসার খুবি

শেখ রেহনুমা রহমান

প্রথম যেদিন আব্বার সঙ্গে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে (খুবি) ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম, ক্যাম্পাসে পা রাখার পর অন্যরকম এক ভালো লাগা কাজ করেছিল। এত শান্ত, ছায়াঘেরা আর গোছানো পরিবেশ দেখে শান্তি লাগছিল। তারপর যখন চান্স পেলাম, ভালো লাগাটা আরও অনেক গুণ বেড়ে গেল এই ভেবে যে এখন থেকে আমিও এই ক্যাম্পাসের অংশ। আজ চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী হিসেবে বলতে গেলে ক্যাম্পাস আমার ‘সেকেন্ড হোম’। ক্যাম্পাসের প্রতিটি জায়গা—যেমন কটকা, হাদী চত্বর, পুকুরপাড়, ক্যাফেটেরিয়া, অদম্য বাংলা—সবই অদ্ভুত সব স্মৃতিমাখা।

তবে আমার একটা অন্যরকম টান আছে ক্যাম্পাসে তপনদা, হুমায়ুন ভাই, সাইদুল ভাইদের দোকানগুলোর প্রতি। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত টানা ক্লাস করার পর তপনদা বা হুমায়ুন ভাইয়ের এক কাপ ধোঁয়া ওঠা লাল চা আর গরম-গরম শিঙাড়া ক্লান্তি ধুয়ে দেয়। স্বতঃস্ফূর্ত আড্ডায় মেতে ওঠেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই। এই আড্ডা-গানই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের প্রাণ। এখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কঠিন সম্পর্কটা সহজ হয়ে আসে, বন্ধুত্বগুলো আরও গাঢ় হয়।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ‘ঘোষিত’ টিএসসি নেই। এতে কিন্তু আমাদের কোনো আফসোস নেই। কারণ, আমাদের আছে তপনদা, হুমায়ুন ভাই, সাইদুল ভাইদের দোকান। আর এটাই আমাদের অঘোষিত টিএসসি। যখন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকে, মিস করি আমাদের টিএসসিকে।

চতুর্থ বর্ষ, ভাস্কর্য ডিসিপ্লিন

গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ

ক্যাম্পাসের ঘ্রাণ

জামিয়া রহমান খান

‘পিথাগোরাস বলেছেন, “তিন খুব শক্তিশালী সংখ্যা।” তিনে আছে আমি, তুমি এবং সর্বশক্তিমান তিনি। সে জন্যই ত্রিভুবন, ত্রিকাল, ত্রিসত্যি। কবুল বলতে হয় তিনবার। তালাক বলতে হয় তিনবার। পৃথিবীতে রংও মাত্র তিনটি। লাল, নীল, হলুদ। বাকি সব রং এই তিনের মিশ্রণ।’

আজহিমুরবিয়ে বইতে হ‌ুমায়ূন আহমেদ এমনটাই লিখেছেন। আমার ধারণা, আমাদের তিনজনের সঙ্গে দেখা হলে হ‌ুমায়ূন আহমেদ এই তিনের পাঁচালিতে আমাদের নামও যোগ করে দিতেন। কেমন করে আমরা তিন মূর্তি এক হয়েছিলাম সেই সুবিশাল ইতিহাসের খাতা আজ খুলব না। আজ না হয় বন্ধুত্বের সঙ্গে ক্যাম্পাসের যোগসূত্রটাই বলি। ক্যাম্পাসেই আমাদের পরিচয়। তিনজনই খুব অলস বলে ক্যাম্পাসের বাইরে আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে। তিনজনের বাড়ি শহরের তিন প্রান্তে। তাই আমাদের একমাত্র ভালোবাসাবাসি এবং মারামারি করার জায়গা এই ক্যাম্পাস। আসলে আমাদের ভালোবাসা, রাগ, অভিমান কিংবা খুনসুটির গল্প সব এই ক্যাম্পাসেই ছড়িয়ে আছে। ভবিষ্যতের স্বপ্ন বা প্রিয়জনের বিরহে কাতর হতে চাইলে এই ক্যাম্পাসের পুকুরপারের বেঞ্চিতেই আমরা বসি। তিনজন মিলে কথার তুবড়ি ছোটাই। প্রতি পরীক্ষার শেষে লাইব্রেরিতে বসে ভালো মতো পড়ার প্রতিজ্ঞা করি এবং চিরাচরিত নিয়মে সেই প্রতিজ্ঞা ভুলে যাই।

জাদুর শহরের মতো ক্যাম্পাসেরও একটা জাদু আছে। একটা ঘ্রাণ আছে। তিন দিনের বেশি ছুটি হলে সেটা আমরা ভালো মতো টের পাই। ঘ্রাণের জন্য আকুল লাগে।

তৃতীয় বর্ষ, শিশুবিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

প্রিয় প্রতীক্ষা

তন্ময় বড়ুয়া

বর্ষপঞ্জি মেনে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো ছুটি হয় প্রিয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেও। স্বাভাবিকভাবেই তখন প্রিয় প্রাঙ্গণের সবকিছু ভীষণ মিস করি। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে শহরের স্টেশনে ট্রেন ধরার তাড়া, ট্রেনে উঠে বন্ধুদের জন্য সিট ধরে রাখা, তাঁদের ফোন করে খুঁজে বেড়ানো, পাশে বসে আড্ডা...নিত্যদিনের এই রুটিন মিস করতেই হয়। ক্যাম্পাস ছুটির সময় ভীষণ মিস করি হেলেদুলে সবুজ ধানখেতের মধ্য দিয়ে চলতে থাকা প্রিয় শাটল ট্রেনকে। ক্যাম্পাসের স্টেশনে পৌঁছেই ক্লাসে পৌঁছানোর তাড়া, দেরিতে ক্লাসে প্রবেশের জন্য অ্যাটেনডেন্স মিস কিংবা প্রিয় স্যারদের আচ্ছা বকুনি...

ক্যাফেটেরিয়ায় এক কাপ চায়ের সঙ্গে দুটো সমুচা-শিঙারা আর টেবিল চাপড়িয়ে মন-মাতানো গান, ক্লাসের ফাঁকে সেমিনারে বসে গ্রুপ স্টাডির সঙ্গে খুনসুটি, পড়াশোনা, ডিপার্টমেন্টের করিডরে দাঁড়িয়ে হাসি-ঠাট্টা...আহা! বৃষ্টির দিনে হঠাৎ কাকভেজা হয়ে ছুটতে ছুটতে ট্রেন ধরা, তারপর ভেজা কাপড়ে পুরোটা পথ পাড়ি দেওয়া—এসব তো আছেই। হঠাৎ ঘুরতে যাই অন্য কোনো বিভাগ কিংবা অনুষদে। ক্যাম্পাসের আরেক মুখরিত জায়গার নাম কলা ঝুপড়ি। কলা ঝুপড়ির প্রাকৃতিক আবহে সম্পূর্ণ বাঙালিয়ানায় দুপুরের খাবারের এমন স্মৃতি কে না মিস করে। এরই মধ্যে সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সময় আসে বাড়ি ফেরার। ক্লান্ত শরীরে আবার যার যার বাড়ি ফেরা। অপেক্ষায় থাকি কবে ছুটি শেষ হবে, আবার কবে সবুজ ক্যাম্পাসে ফিরব। এই প্রতীক্ষাও আনন্দের।

দ্বিতীয় বর্ষ, ফাইন্যান্স বিভাগ