বিকল্প পরিকল্পনাও থাক

মডেল: আমিন ছবি: কবির হোসেন
মডেল: আমিন ছবি: কবির হোসেন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষার্থী বিসিএস ক্যাডার হওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু সবার এই স্বপ্ন যে পূরণ হবে না, সেটাও তো সত্য। এই বাস্তবতা মেনে কোনো বিকল্প পরিকল্পনা কি তাঁদের আছে?


গত রোববারের কথা। ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একদল শিক্ষার্থীর সঙ্গে আমরা তখন গোল হয়ে বসেছি। কে কী পড়ছেন, কী করছেন, কেমন কাটছে ক্যাম্পাস-জীবন...এই নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। একসময় সেই বহুল পরিচিত প্রশ্নটা তাঁদের করলাম, যেটা সম্ভবত তাঁরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছেন। ‘আপনার জীবনের লক্ষ্য কী?’

আশ্চর্য ব্যাপার! বৃত্তের ভেতর বসে থাকা ১২ জন, তাঁদের সবার লক্ষ্য একটাই—বিসিএস। এই চিত্র অবশ্য শুধু আনন্দমোহন কলেজের নয়, সারা দেশেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর একমাত্র লক্ষ্য থাকে বিসিএস। আমরা যাঁদের সঙ্গে আড্ডায় বসেছিলাম, সবাই চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। পড়ালেখার পাশাপাশি এখন থেকেই তাঁরা বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। শিক্ষার্থীদের স্বপ্নীল চোখগুলো দেখে আশার সঙ্গে মনে আশঙ্কাও জাগল। কঠিন এক যুদ্ধ অপেক্ষা করছে তাঁদের জন্য। ৩৮তম বিসিএসের কথাই ধরা যাক। এ বছর প্রতিটি পদের জন্য লড়বেন ১৯১ জন। একজনের স্বপ্নপূরণের অর্থ হলো ১৯০ জনের স্বপ্নভঙ্গ!

আনন্দমোহন কলেজ ঘুরে আরও কয়েক দল শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হলো। বাংলা বিভাগের এক ছাত্র তো এমনটাও বললেন, ‘আমাদের আসলে সরকারি চাকরি ছাড়া যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই।’ সত্যিই কি তা-ই? রূঢ় শোনালেও কয়েকজনকে প্রশ্নটা করেই ফেললাম, ‘যদি বিসিএসে না টেকেন, তাহলে কী করবেন?’ স্বপ্নীল চোখগুলো মুহূর্তেই শূন্য দেখাল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেকের কাছেই বিসিএস পরীক্ষাই প্রথম এবং শেষ সম্বল। কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে অবিচল হতে হবে এটা যেমন সত্যি, তেমনি লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার বাস্তবতা মেনে নেওয়ার কিংবা বিকল্প লক্ষ্য ভেবে রাখার মতো কৌশলী হওয়ার মানসিকতা কি আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে?

প্রশ্নটা তুলেছিলাম আনন্দমোহন কলেজের অধ্যক্ষ মো. জাকির হোসেনের কাছে। স্যার জানালেন, তিনিও এই সমস্যা সম্পর্কে অবগত। বলছিলেন, ‘একাডেমিক পড়ালেখার বাইরে ক্লাসে ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলার খুব একটা সুযোগ হয় না। আমরা আসলে শিক্ষার্থীদের বিসিএসের জন্যই অনুপ্রেরণা দিই।’ শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা কাজে লাগছে, সেটা অনস্বীকার্য। আনন্দমোহনের শিক্ষার্থীরা জানালেন, গত বছর শুধু তাঁদের কলেজেরই ৫৮ জন বিসিএসে টিকেছেন। কিন্তু যাঁরা টেকেননি, তাঁরা কে কোথায় আছেন? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর মিলল না।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষার্থী বিসিএসের ‘সোনার হরিণ’-এর পেছনে ছুটছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেরই দ্বিতীয় কোনো পরিকল্পনা নেই। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো কোনো কোনো শিক্ষার্থী বিশ্বাস করেন, তাঁদের দ্বিতীয় কোনো পথও নেই। এই ‘বিশ্বাস’ একই সঙ্গে তাঁদের শক্তি ও দুর্বলতা। লক্ষ্যে অটল থাকছেন বলেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষার্থী বিসিএস ক্যাডার হচ্ছেন, আবার বিসিএস ক্যাডার হতে না পেরে অনেকেই ধরে নিচ্ছেন—সামনে এগোনোর বুঝি আর কোনো পথ নেই।

ইংরেজিতে একটা কথা আছে: ‘অলওয়েজ হ্যাভ আ প্ল্যান বি।’ অর্থাৎ সব সময় একটা বিকল্প পরিকল্পনা রেখো। বিশ্বখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় সেরেনা উইলিয়ামস তো একবার এমনটাও বলেছিলেন, ‘যদি প্ল্যান “এ” কাজ না করে, আমার কাছে প্ল্যান বি, সি এমনকি ডি-ও আছে।’ অর্থাৎ এক নয়, একাধিক বিকল্প পরিকল্পনা থাকা উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেনের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে কথা হলো। তিনি মনে করেন, শুধু একটাই লক্ষ্য সামনে রেখে প্রস্তুতি নেওয়াটা অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। ‘বিসিএসের প্রস্তুতির সঙ্গে আরেকটু চেষ্টা করলেই কিন্তু ব্যাংক কিংবা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির প্রস্তুতিটাও নেওয়া যায়। যত বেশি পথ তৈরি করা যায়, তত ভালো। ছোট-বড় সব ধরনের চাকরির জন্যই অন্তত চেষ্টা করতে পারেন, তাতে আত্মবিশ্বাস বাড়বে,’ বলছিলেন তিনি।

আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থীর একটা সমস্যার কথাও বললেন বি এম মইনুল হোসেন। ‘আমরা টিমওয়ার্কে খুব ভালো নই। একেকটা মানুষের মধ্যে একেক দক্ষতা থাকে। কয়েকজনের দক্ষতা এক করে একটা উদ্যোগ নিতে পারেন, উদ্যোক্তা হতে পারেন। বিদেশে কিন্তু এই ব্যাপারটা এখন খুব প্রচলিত। আমরা সবকিছু একা একা করতে চাই। অনলাইনে এখন আলু, কলা থেকে শুরু করে কী না বিক্রি হচ্ছে? কত সুযোগ আছে সামনে! কিছু “সফট স্কিল” বা সাধারণ দক্ষতা নিজের মধ্যে গড়ে তুললেই কিন্তু অনেক সম্ভাবনার পথ তৈরি হয়। যেমন মানুষের সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলা, দলবদ্ধভাবে কাজ করার মানসিকতা গড়ে তোলা, এগুলোও একেকটা দক্ষতা।’

চাঁদপুর সরকারি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র মোহাম্মদ শাহাদাৎ হোসেন যেমন ছাত্রবস্থায়ই শিক্ষকতা করার দক্ষতা নিজের মধ্যে গড়ে তুলেছিলেন। অনেকগুলো টিউশনি করতেন, পরিশ্রম করতেন। পরীক্ষায় ভালো ফল ছিল। স্নাতক শেষ করেই বিসিএসের জন্য চেষ্টা করেছেন, হয়নি। তাই বলে শাহাদাৎ কিন্তু হারিয়ে যাননি। সেই যে নিজের মধ্যে শিক্ষকতার দক্ষতা গড়ে তুলেছিলেন, সেটাই তাঁর কাজে এসেছে। মোহাম্মদ শাহাদাৎ হোসেন এখন ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক। জানালেন, বেশ আছেন। স্বপ্নের বিসিএসে টেকার জন্য তিনি অবশ্য এখনো চেষ্টা করছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত না হলেও তাঁর আফসোস নেই। জীবন কখনো থেমে থাকে না, এই সত্যটা তিনি জেনে গেছেন।