গল্পের নাম 'র‍্যাগ১৭'

২৪টি ট্রাক আর ১০টি বাসের বিশাল বহর নিয়ে শিক্ষার্থীরা বেরিয়েছিলেন খুলনা শহরে। ছবি: সাজজিদ আহমেদ
২৪টি ট্রাক আর ১০টি বাসের বিশাল বহর নিয়ে শিক্ষার্থীরা বেরিয়েছিলেন খুলনা শহরে। ছবি: সাজজিদ আহমেদ

মুহূর্তের মধ্যে হাদি চত্বরে থাকা মানুষগুলোর চেহারা যেন পাল্টে গেল! কেউ নীল, কেউ গোলাপি রঙে রাঙা; কেউ আবার হয়ে গেলেন ‘কাদামানব’! পরিচিত কাউকে পেলেই শিক্ষার্থীরা ছুড়ে দিচ্ছিলেন মুঠোভর্তি আবির। অন্যদিকে চার-পাঁচজন মিলে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন কোনো সিনিয়র ভাইকে। উদ্দেশ্য? কাদার মধ্যে তাঁকে নাকানিচুবানি খাওয়ানো! এভাবেই শুরু হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) ‘র‍্যাগ ২০১৭’।

‘অভিযাত্রিক অস্তিত্বের প্রোজ্জ্বল চিহ্ন’ স্লোগানে গত ২১ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর ছিল খুবির ১৩ ব্যাচের র‍্যাগ ডে বা শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠান। সে তো কাগজে-কলমের হিসাব। উত্তেজনার কমতি ছিল না মাসের শুরু থেকেই। ১০ দিন আগে থেকে ‘কাউন্টডাউন’ চলছিল, সঙ্গে জমে উঠেছিল গান, নাচ, কবিতার মহড়া। ক্লাস করেই দে ছুট র‍্যাগ ডের কাজে! সবার মুখে মুখে রটে গেল ‘কাপঝাপ হচ্ছে’। এসব অভিধানবহির্ভূত শব্দের ভাবার্থ কেবল শিক্ষার্থীরাই জানেন!

রং আর কাদায় মাখামাখি!
রং আর কাদায় মাখামাখি!

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাজসজ্জায়ও কোনো কমতি থাকা চলবে না। তাই কিছু ছেলেমেয়ে নিয়ে নিল সেই দায়িত্ব। র‍্যাগ ডের আগের দিন খুবি যেন আলোয় উদ্ভাসিত অচেনা কোনো জায়গা! আগের রাত থেকেই অনানুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে গিয়েছিল উৎসব। জুনিয়র-সিনিয়রদের রং খেলা, হাসি, আড্ডায় হলগুলো মাতোয়ারা ছিল রাতভর।

২১ তারিখ সকাল সকাল গাঢ় গোলাপি রঙের শাড়ি পরে ফিটফাট হয়ে ক্যাম্পাসে চলে এলেন বিদায়ী ব্যাচের ছাত্রীরা। ছাত্ররা এলেন টি-শার্ট পরে। অন্যান্য ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও কি কম যান? তাঁরাও সবাই রঙিন। উদ্দেশ্য, সারা খুলনা শহর চক্কর দিয়ে এই উৎসবের কথা জানান দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান বেলা ১১টায় উৎসবের উদ্বোধন করেন বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে। এরপরই ২৪টা ট্রাক আর ১০টা বাস নিয়ে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে পড়েন ক্যাম্পাস থেকে।

শহর ঘুরে বাস-ট্রাকগুলো ক্যাম্পাসে ঢুকতেই শুরু হয়ে গেল ‘কালার ফেস্ট’। ক্যাম্পাসের কালো পিচঢালা রাস্তা বিভিন্ন রঙে রঙিন হয়ে উঠল। আর সবার শরীর? সে আর বলতে! রং-কাদা মেখে একেকজন ঝাঁপ দিলেন ‘খাবা’র (খান বাহাদুর আহসানুল্লাহ হল) পুকুরে। অথচ বিকেল হতে না হতেই ক্যাম্পাস ধুয়েমুছে পরিচ্ছন্ন! শুরু হলো শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

র‍্যাগ ডে উপলক্ষে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
র‍্যাগ ডে উপলক্ষে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

দ্বিতীয় দিনে ছিল আলোচনা সভা ও স্লাইড শো। প্রধান অতিথি হিসেবে উপাচার্য ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে ট্রেজারার সাধন রঞ্জন ঘোষ ১৩ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। শুভকামনা জানিয়ে তাঁদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন। সেদিন বিকেলে মুক্তমঞ্চে পরিবেশিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যদের গান, নাচ, কবিতা আবৃত্তি। উৎসবমুখর আমেজে কেটে যায় রাতটা।

র‍্যাগের তৃতীয় দিন, অর্থাৎ ২৩ তারিখ হলো কনসার্টের রাত। আসবে বাংলাদেশের বিখ্যাত দুটো ব্যান্ড—নেমেসিস আর নগরবাউল। ক্যাম্পাসজুড়ে দুপুর থেকেই চুলচেরা নিরাপত্তার ব্যবস্থা। সন্ধ্যার মধ্যেই মঞ্চের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তো বটেই, চলে এল পুরো খুলনার এদিক-ওদিক থেকে আসা মানুষজন। আটটার দিকে মঞ্চে হাজির হলো নেমেসিস। ঘণ্টাখানেক মাতিয়ে রাখল তাদের নতুন-পুরোনো গান দিয়ে। জেমস স্টেজে উঠলেন ১০টার দিকে। মাইকে ‘কবিতা’ বলে ‘পদ্ম পাতার জল’ গান শুরু করতেই সবাই ‘গুরু’ বলে হই-হুল্লোড় শুরু করল। ‘হেডব্যাং’ দিতে দিতে সবাই যখন ক্লান্ত, তখন ‘হামারি আধুরি কাহানি’ গানটি দিয়ে জেমস ইতি টানলেন কনসার্টের। সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেল খুবির আকাশে আতশবাজির খেলা। চারদিকে এত আলো, অথচ ১৩ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এর মধ্যেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। চারটি বছরের সুখ-দুঃখের সাথি ছিলেন যাঁরা, এমন কোনো উৎসবে আবার তাঁদের সঙ্গে দেখা হবে তো? প্রশ্নের উত্তর জানা নেই বলেই তাঁদের মুখে অন্ধকার।

বিদায় বেলায় কান্নায় ভেঙে পড়েন ১৩ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা
বিদায় বেলায় কান্নায় ভেঙে পড়েন ১৩ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী জান্নাত নাদিয়া বলেন, ‘শুনেছিলাম আমাদের ভার্সিটির র‍্যাগ ডেতে একটু অন্য রকম আনন্দ হয়। কিন্তু এতটা আনন্দ হবে, সেটা বুঝতে পারিনি। ক্লাসমেট আর সিনিয়রদের সঙ্গে যা মজা করেছি তিন দিন, তা কল্পনাতীত।’ ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ধীমান রায়ের কণ্ঠেও একই সুর, ‘র‍্যাগ ডের প্রতিটা পর্ব সফল করার জন্য কত রাত জেগে কাজ করেছি। আবার তো এই সুযোগ পাব না। আনন্দের সঙ্গে শূন্যতাটাও প্রবলভাবে কাজ করছে।’