বন্ধুত্ব ও বন্ধনে গড়া

ক্যাম্পাসে ছোট–বড় সবার মধ্যেই সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ। ছবি: সংগৃহীত
ক্যাম্পাসে ছোট–বড় সবার মধ্যেই সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ। ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষার্থীদের একেকজন এসেছেন একেক এলাকা থেকে। কেউ ঢাকায় বড় হয়েছেন, কারও বাড়ি উত্তরবঙ্গে, কেউ আবার সাগরপাড়ের বাসিন্দা। একজন হয়তো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পাঁড় ভক্ত, পাশেই খুঁজে পাবেন বার্সেলোনার জার্সি পরা কাউকে। কেউ শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন, কেউ আবার কথায় আঞ্চলিক টান এড়াতে পারেন না। একেকজন একেক রকম। তবু সবার মধ্যে একটা জায়গায় মিল—এই শিক্ষার্থীরা সবাই চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। এই স্বপ্নই তাঁদের এক করেছে। এখন তাঁরা গর্ব করে বলেন, ‘আমরা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে (এমএমসি) পড়ি।’

ভাবতে পারেন, এত বৈচিত্র্য যেখানে, সেখানে হয়তো বন্ধুত্বটা জমে উঠতে একটু বেশি সময় লাগে। সেক্ষেত্রে আপনাকে ঠাকুরগাঁও থেকে আসা সালমান হায়দারের ঘটনাটা বলি। তিনি চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন। জানতে চেয়েছিলাম, এখন পর্যন্ত মেডিকেলজীবনের সবচেয়ে মধুর স্মৃতি কোনটা? প্রশ্ন শুনে ভাবনায় পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে সালমান বললেন, ‘অনেক স্মৃতিই তো আছে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ক্যাম্পাসে আসার পর আমার প্রথম জন্মদিনটার কথা।’ কী হয়েছিল সেদিন? ‘তখন তো মাত্র প্রথম বর্ষে পড়ি। হলে মাত্রই উঠেছি। খুব বেশি বন্ধু ছিল না। ক্লাস শেষে বের হয়ে দেখি ক্যাম্পাসের কুক হাউসের সামনে সবাই জড়ো হয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে ঘিরে গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে সবাই “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ” গাওয়া শুরু করল। আমি একটু লজ্জাই পাচ্ছিলাম। আগে তো কখনো এত মানুষ মিলে জন্মদিন করিনি।’ সেই দিন থেকেই সম্ভবত সালমানের সব জড়তা কেটে গিয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই নতুন ‘পরিবার’টিকে আপন করে নিতে খুব একটা সময় লাগে না।
এমএমসির পরিবার যে শুধু বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে, তা নয়। প্রাক্তনদের সঙ্গে এখনো সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে যায়নি। কদিন আগেই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ৫৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান হলো। খবর পেয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন বহু প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। এখন তাঁরা পুরোদস্তুর চিকিৎসক। পেশাজীবনের ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও একটু সময় বের করে চলে এসেছিলেন; যদি পুরোনো দিনগুলোর ঘ্রাণ কিছুটা পাওয়া যায়, সেই আশায়!

৫৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে শিক্ষার্থীদের র‍্যালি
৫৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে শিক্ষার্থীদের র‍্যালি

বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের কথা বলছিলেন মো. আল আমীন। এমএমসিতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সন্ধানীর প্রেসিডেন্ট তিনি। অনেক দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। অনুষ্ঠানের ঝক্কিঝামেলাগুলোর খবর তাঁরই ভালো জানা। বলছিলেন, ‘শুরুতে বলা হয়েছিল, বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান হবে ঢাকায়। আমরা সেটা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। আমাদের বর্ষপূর্তি আমাদের ক্যাম্পাসেই হবে, ঢাকায় হবে কেন! আয়োজন, স্পনসর পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে নানা ঝামেলা হচ্ছিল। কলেজের সবাই ৫০ টাকা করে চাঁদা দিয়ে অনুষ্ঠান করে ফেলব, সেই প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিকই ব্যবস্থা হয়ে গেল। মাত্র ১৮ ঘণ্টার মধ্যে আমরা পুরো আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছি।’ শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানের জাঁকজমক কম ছিল না। ৫৫টি ফানুস ওড়ানো হয়েছে। ৫৫ পাউন্ডের কেক কাটা হয়েছে। আনন্দ শোভাযাত্রা, রং খেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আতশবাজিসহ সবই ছিল আয়োজনে।
স্বপ্ন নিয়ের পক্ষ থেকে আমরা যখন এমএমসির ক্যাম্পাসে পা রেখেছি, বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাস্তায় আঁকা আলপনার দাগ তখনো মুছে যায়নি। কথা হলো এই নকশার পেছনের কারিগরদের একজনের সঙ্গে। নাম মৌমিতা আহমেদ। ঢাকার মেয়ে। অনেক অভিজ্ঞতাই তাঁর জন্য নতুন। বলছিলেন, ‘বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত আলপনা এঁকেছি। খুব ভালো কেটেছে সময়টা। অথচ মেডিকেলে শুরুতে মানিয়ে নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। পড়ালেখার চাপ, তার ওপর নতুন পরিবেশ। মনে হতো, কেন যে এলাম!’ আরেক শিক্ষার্থী নুসরাত আমিনের বক্তব্যটাও একই রকম। বলছিলেন, ‘এখন যতটা দাবি নিয়ে বলি “আমাদের এমএমসি”, স্কুল-কলেজও এত বেশি নিজের মনে হতো না।’
এমএমসিতে সংগঠন আছে বেশ কয়েকটি। সন্ধানী, মেডিসিন ক্লাব, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, সাংস্কৃতিক সংগঠন বৃত্ত ও স্পন্দন। প্রতিটি সংগঠনের আলাদা কমিটি আছে, তবে শিক্ষার্থীরা মিলেমিশেই সব কটি সংগঠন পরিচালনা করেন। সন্ধানীর রুমে যেমন দেখা গেল দেয়ালে ফটোগ্রাফিক সোসাইটির তোলা বেশ কয়েকটি ছবি টানানো। অনেকেই আসছেন রক্তের খোঁজে। সম্ভব হলে সন্ধানীর কর্মীরা তাৎক্ষণিকভাবে রক্তের বন্দোবস্ত করে দিচ্ছেন। আবার কাউকে বলছেন, ‘এখন তো নেই। আপনি রাতে আসেন। এর মধ্যে দেখি ব্যবস্থা করতে পারি কি না।’
কখনো কখনো রোগীরাও এমএমসি পরিবারের অংশ হয়ে যান। তেমন একজনের কথা বললেন মো. আল আমীন, ‘ছেলেটার নাম আফজাল। ১৭-১৮ বছর বয়স হবে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অনেক দিন ধরে আমাদের হাসপাতালে পড়ে আছে। প্রতি মাসে রক্ত দিতে হয়, খরচার ভয়ে পরিবার ওকে নিতে চায় না। সে-ও বাসায় যায় না। আমরাই নিয়মিত রক্তের ব্যবস্থা করি। কখনো আমরা কিছু টাকাপয়সা দিই, স্যারেরাও দেন। আফজাল এখন সবার পরিচিত হয়ে গেছে। আজ রাতেও আমি ওর জন্য রক্ত দেব।’