প্রাণোচ্ছল পঁচিশ

গত ২৫ বছরে নিজেদের একটা অবস্থান তৈরি করেছেন এনএসইউ–এর শিক্ষার্থীরা। ছবি: খালেদ সরকার
গত ২৫ বছরে নিজেদের একটা অবস্থান তৈরি করেছেন এনএসইউ–এর শিক্ষার্থীরা। ছবি: খালেদ সরকার

‘নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির কোনো ছেলেমেয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেই আমি বুঝতে পারি, সে আমাদের ছাত্র।’ বলছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য আতিকুল ইসলাম। শুধু উপাচার্যের কাছেই নয়; বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানে, শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়, ভিন দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে—সর্বত্রই নিজেদের একটা অবস্থান তৈরি করেছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) শিক্ষার্থীরা। ১৯৯২ সালে দেশের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ছোট্ট পরিসরে যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২৫ বছর পেরিয়ে এখন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এনএসইউয়ের একটি দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস আছে। সেখানে পড়ছেন প্রায় ২২ হাজার শিক্ষার্থী। গলায় পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে নিয়মিত তাঁরা ক্যাম্পাসে হাজির হচ্ছেন। উপাচার্যের কথা থেকে বোঝা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন শেষে এই পরিচয়পত্র না থাকলেও ‘পরিচয়’ তাঁরা ঠিকই বহন করবেন।

ক্যাম্পাসের জীবন

এনএসইউয়ের ক্যাম্পাস সব সময় সরব, উচ্ছল, রঙিন। গ্যালারিতে কেউ হয়তো গিটার বাজিয়ে গান গাইছেন, ওদিকে ক্যানটিনে জমেছে তুমুল আড্ডা। ক্যারম, টেবিল টেনিসে মেতে আছেন কেউ কেউ। অনেকে ক্যাম্পাসের জিমে গিয়ে ঘাম ঝড়াচ্ছেন। নিচতলায় ক্লাবরুমগুলোতে সংগঠনের ছেলেমেয়েরা কোনো না কোনো আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। মেঝেতে আঁকা আলপনা, দেয়ালে সাঁটানো পোস্টার, সিলিংয়ে ঝোলানো রঙিন ফেস্টুন সারা বছর এখানে উৎসবের আমেজ ছড়ায়। শিক্ষার্থীদের প্রাণোচ্ছলতা দেখে বোঝার উপায় নেই, আদতে প্রতি সেমিস্টারেই তাঁরা মিড-অ্যাসাইনমেন্ট-প্রেজেন্টেশনের চাপে জবুথবু হয়ে থাকেন।

‘আমাদের ক্যাম্পাসের বৃষ্টি খুব সুন্দর!’ দাবি করলেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী তাসনিয়া আফরিন। ‘বিকেলে যখন ঝুমবৃষ্টি হয়, গ্যালারিতে বসে থাকলে বৃষ্টির হালকা ছাঁট এসে গায়ে লাগে। কেউ কেউ চিৎকার করে গান গাইতে থাকে। খুব ভালো লাগে। এখন অবশ্য ক্যাম্পাসের বাইরে বৃষ্টি খুব একটা দেখাও হয় না। সারা দিন তো এখানেই থাকি!’ বলেই হেসে ফেললেন তিনি। সারা দিন ক্যাম্পাসে পড়ে থাকার একটা কারণ অবশ্য আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনের ট্রেজারার তাসনিয়া। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাস সরব রাখার দায়িত্ব এই সংগঠনের। আরও নানা দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এনএসইউতে কাজ করছে শিক্ষার্থীদের মোট ২২টি সংগঠন।

গ্যালারিতে বসে জমে আড্ডা
গ্যালারিতে বসে জমে আড্ডা

এত সুন্দর একটা ক্যাম্পাস যাদের আছে, তাদের জন্য নতুন নতুন অনুষ্ঠান আয়োজন করা একটা চ্যালেঞ্জও বটে। গ্যালারি, ক্যানটিন, সাউথ একাডেমিক বিল্ডিং (স্যাক) আর নর্থ একাডেমিক বিল্ডিংয়ের (ন্যাক) মধ্যে সংযোগ করে দেওয়া ব্রিজ, ভবনগুলোর মাঝখানে খোলা জায়গা (প্লাজা), একাধিক মঞ্চ—সবকিছু মাথায় রেখে নিত্যনতুন পরিকল্পনা আঁটেন সংগঠনের কর্মীরা।

ফার্মাসি বিভাগের ছাত্রী ফারহানা মোহাম্মদ জানালেন, কুয়েত থেকে উচ্চমাধ্যমিকের পাট চুকিয়ে এসে ক্যাম্পাসের টানেই তিনি ভর্তি হয়েছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে। বললেন, ‘তা ছাড়া ফার্মাসির জন্য এখানকার ল্যাবগুলো বেশ ভালো।’ কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র আবদুল্লাহ্‌ আল শাফীর বক্তব্যও ফারহানার মতোই। উন্নত ল্যাবের পাশাপাশি তিনি বললেন শিক্ষকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের সুবিধার কথা, ‘ক্লাসের বাইরে টিচাররা আমাদের যথেষ্ট সময় দেন। ই-মেইলের মাধ্যমেও আমরা যেকোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়তলা পাঠাগার ভবনে পা রাখলে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। ৫০ হাজারের বেশি বই ও অনলাইন জার্নাল, লাখের বেশি ই-বুক, নানা ধরনের পত্রিকা-সাময়িকী, কী নেই সেখানে!

চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষার জন্য এনএসইউতে আছে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট। ২০১৬ সালে বিশ্বের ৫০০টি কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের মধ্যে এনএসইউ ‘বেস্ট কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট অ্যাওয়ার্ড’ পায়। এ ছাড়া শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের জন্য আইকিউএসি, গবেষণার উন্নত মান নিশ্চয়তার জন্য আইডিইএসএস (ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট, এনভায়রনমেন্ট ও স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ), ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্লেসমেন্ট সেন্টার, এনএসইউ গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউটসহ বেশ কয়েকটি ইনস্টিটিউট আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ব্যবহারিক ক্লাসে
ব্যবহারিক ক্লাসে

এনএসইউ কেন আলাদা?

এনএসইউয়ের স্লোগান হলো ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স ইন হায়ার এডুকেশন’। কীভাবে এখানে উচ্চশিক্ষার সঠিক মান নিশ্চিত করা হয়? প্রশ্নের উত্তরে ইলেকট্রিক্যাল ও কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক কে এম এ সালাম বলেন, ‘আমরা বলি লং লাইফ এডুকেশন। এখানে শিক্ষার্থীরা যে প্রোগ্রামিং শিখছে, পাঁচ বছর পর নিশ্চয় আরও উন্নত সংস্করণ আসবে। এটা মাথায় রেখে আমরা ওদের ভিতটা শক্ত করার চেষ্টা করি, যেন নতুন নতুন উদ্ভাবনের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা মানিয়ে নিতে পারে।’

পরিবেশবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বাস করবী ফারহানার মতে, পরিবেশবিষয়ক শিক্ষার মান অনেকটা নির্ভর করে মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমের ওপর। বলছিলেন, ‘প্রতিটি কোর্সের প্রয়োজন বিবেচনা করে আমরা শিক্ষার্থীদের মাঠপর্যায়ে বা গবেষণাগারে নিয়ে যাই। যেমন প্রাকৃতিকভাবে বিপর্যস্ত এলাকা, এনভায়রনমেন্টাল হট স্পট, বিভিন্ন কারখানার দূষণ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, সেগুলো ক্লাসরুমের বাইরে শিক্ষার্থীরা শেখার সুযোগ পাচ্ছে।’ ইতিহাস ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক শরীফ উদ্দিন আহমেদ শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত আছেন ১৯৬৭ সাল থেকে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির কোন বিষয়টি তাঁকে মুগ্ধ করে জানতে চাইলে বলেন, ‘খুব নিয়ম মেনে এখানকার কর্মকাণ্ডগুলো পরিচালনা করা হয়। পড়াশোনার জন্য যেসব বই বা গবেষণার জন্য যে জার্নালগুলো দরকার, সবই এখানকার গ্রন্থাগারে পাওয়া যায়।’

ক্লাসের ফাঁকে শিক্ষার্থীরা খেলছেন টেবিল টেনিস
ক্লাসের ফাঁকে শিক্ষার্থীরা খেলছেন টেবিল টেনিস

এমবিএ বিভাগের পরিচালক এবং ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক তাজউদ্দীন আহমেদ জানালেন, তাঁর প্রতিটি কোর্সেই ছাত্রছাত্রীদের পুরোদস্তুর ‘ফরমাল’ পোশাকে ক্লাসে হাজির হতে হয়। উদ্দেশ্য, পেশাজীবনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অভ্যস্ত করে তোলা। তাঁর ভাষ্য, ‘প্রতিটি কোর্সের সিলেবাস শুধু পাঠ্যবইয়ের ওপর নির্ভর করে না। সাম্প্রতিক নানা ঘটনার উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে হয়। কেস স্টাডি, প্রেজেন্টেশনের ওপরও অনেক জোর দেওয়া হয়।’

শিক্ষকদের এই পরিশ্রম বৃথা যায় না। নাসা, গুগল, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন, ইউনিসেফ, ইউএনএইডসহ বিশ্বের স্বনামধন্য বহু প্রতিষ্ঠানে এনএসইউয়াররা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করছেন। ২০১৫ সালে অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল ফর বিজনেস স্কুল অ্যান্ড প্রোগ্রামসের (এসিবিএসপি) স্বীকৃতি পেয়েছে নর্থ সাউথের বাণিজ্য ও অর্থনীতি বিভাগ। অ্যাক্রেডিটেশন ফর ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনিক্যাল এডুকেশনের (বিএইটিই) স্বীকৃতিও আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝুলিতে।

আতিকুল ইসলাম  উপাচার্য, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি
আতিকুল ইসলাম উপাচার্য, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি
ভালো ব্যবস্থাপনা, শিক্ষক ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজ—এসবই হলো নর্থ সাউথের শক্তি। আমাদের শিক্ষকেরা বিশ্বের ভালো মানের সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তাই তাঁদের চিন্তাভাবনা ও পড়ানোর নিয়মকানুন বিশ্বমানের। বাইরের দেশের নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আমরা সেই অনুযায়ী আমাদের মান উন্নয়নের চেষ্টা করি। সম্প্রতি আমাদের পাবলিক হেলথ বিভাগ নাসার সঙ্গে কাজ শুরু করেছে। এ বছর পরিবেশ বিষয়ে গবেষণার কাজে আমরা সরকারি অনুদান পেয়েছি। নেপালের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এনএসইউয়ের কাছে কিছু উন্নত প্রশিক্ষণ চেয়ে আবেদন করেছে। জার্মানি থেকে অধ্যাপকদের একটি দল এসেছে। প্রতিনিয়ত আমরা বিভিন্ন অর্জনের খবর পাচ্ছি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অর্জন যখন নর্থ সাউথকে গর্বিত করে, তখন উপাচার্য হিসেবে নিজেকে সার্থক মনে হয়।