প্রথম পুরস্কার বাংলাদেশের নিশাতের

নিশাত তাসনিম, পেছনে তাঁর প্রকল্পের নকশা। ছবি: খালেদ সরকার
নিশাত তাসনিম, পেছনে তাঁর প্রকল্পের নকশা। ছবি: খালেদ সরকার

থিসিস পেপারের শুরুতে নিশাত তাসনিম যা লিখেছেন, তার বাংলা অনুবাদ অনেকটা এমন—এই কবিতা এক বহু পুরোনো নদীর। যে নদীর জলে ভেসে আসত পলিমাটি, গড়ে উঠত উর্বর ভূমি। হাজারো মানুষ নদী পেরিয়ে পৌঁছাত তাদের গন্তব্যে। কিন্তু একদিন নদী এই মানুষগুলোকে তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলো। নদীর জলে ভেসে এল বহু মৃতদেহ আর রক্ত...

ভাবছেন থিসিস পেপারে তো গুরুগম্ভীর গবেষণার তথ্য-উপাত্ত আর হিসাব-নিকাশ থাকার কথা, নদীর গল্প কেন? ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের (ইউএপি) স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক পেরোনো নিশাত তাসনিম তাঁর শেষ বর্ষের প্রকল্পের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এক ঐতিহাসিক পটভূমি। তাঁর প্রকল্পে উঠে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড, চুকনগর গণহত্যার কথা। ১৯৭১ সালে খুলনার চুকনগরে এক দিনে আট হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই ঘটনার স্মরণে চুকনগর বাজারের কাছে একটি গবেষণাকেন্দ্র, স্মৃতিস্তম্ভসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের প্রকল্প উপস্থাপন করেছিলেন নিশাত। আর সেই প্রকল্প জিতে নিয়েছে তামায়ুজ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ২০১৭।

স্নাতক প্রকল্পে শিক্ষার্থীদের করা স্থাপত্য, নগর-পরিকল্পনা ও ল্যান্ডস্কেপ নকশার কাজগুলো এই প্রতিযোগিতায় জমা পড়ে। সেখান থেকে বাছাই প্রক্রিয়ার পর কয়েকটি প্রকল্পকে পুরস্কৃত করা হয়। এ বছর নিশাত তাসনিম পেয়েছেন প্রথম পুরস্কার। ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক থেকে স্নাতক শেষ করে তিনি নিজ বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন।

এ বছর তামায়ুজ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডের জন্য ৪২টি দেশের ১১৮টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪৬৮টি প্রকল্প জমা পড়েছিল। বিজয়ী হওয়ার পুরস্কার হিসেবে নিশাত ইরাকি বিজনেস কাউন্সিলের অর্থায়নে ইতালির পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটি অব মিলানে স্নাতকোত্তর করতে পারবেন। তামায়ুজ ইন্টারন্যাশনালের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে দেখা গেল, নিশাতের কাজটি সম্পর্কে বিচারকদের বক্তব্য, ‘বিষয়টির গুরুত্ব ও সংবেদনশীলতার কথা মাথায় রেখে চমৎকার সমন্বয় করা হয়েছে এ প্রকল্পে। এটি গতানুগতিক স্মৃতিস্মারকের ধারণা থেকে আলাদা। প্রকল্পটির নকশা একই সঙ্গে শিল্পমানসম্পন্ন, স্নিগ্ধ এবং শক্তিশালী।’

স্নাতক প্রকল্পের জন্য কেন এমন একটি বিষয় নির্বাচন করলেন? প্রশ্নের উত্তরে নিশাত বলেন, ‘অতীত সম্পর্কে জানা আমাদের দায়িত্ব। জানতে হবে আমরা কোথা থেকে, কীভাবে এসেছি। আমাদের ভিতটা শক্ত না হলে, স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলে একসময় আমরা হারিয়ে যাব। আমরা ’৭১ নিয়ে কথা বলি। আমরা আমাদের বীরত্বকে সব সময় সামনে রাখি। বীরত্বের পাশাপাশি আমাদের ত্যাগের গল্পও কিন্তু কম নয়। নির্বিচারে, নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে একাত্তরে। সেসব ইতিহাস কতখানি স্বীকৃত, কতটুকু জানে বর্তমান প্রজন্ম, এসব ভাবনা থেকেই বিষয়টি নির্বাচন করেছিলাম।’ জানালেন, তাঁর প্রকল্পের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন ইউএপির স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক মুহতাদিন ইকবাল, জিয়াউল ইসলাম, মাশরুর মামুন ও উদয় শংকর দত্ত।

পোয়েম, প্রেয়ার অ্যান্ড প্রমিজেস—এই ছিল প্রকল্পটির শিরোনাম। নিশাত তাসনিমের চাওয়া, এই গণহত্যা নিয়ে আরও বেশি গবেষণা হোক। নিজের আগ্রহেই তরুণ প্রজন্ম জানুক তাঁর অতীতের ইতিহাস।