নাট্যকলা পড়তে রাশিয়ায়

রাশিয়ান স্টেট ইনস্টিটিউট অব পারফরমিং আর্টস বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। ছবি: মারকাস মেসকুইটা
রাশিয়ান স্টেট ইনস্টিটিউট অব পারফরমিং আর্টস বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। ছবি: মারকাস মেসকুইটা

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে রাশিয়ার প্রখ্যাত নাট্যদল ‘চেখভ স্টুডিও’ ঢাকা সফর করে। সাত দিনের ওই সফরে শিল্পকলা একাডেমির মুক্ত আঙিনা এবং জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় চেখভ ও গাংচিল। রুশ শিল্পীদের নান্দনিক পরিবেশনা ঢাকার দর্শকদের প্রশংসা কুড়ায়। 

রাশিয়ার রাজধানী মস্কো শহরকে অনেকেই থিয়েটারের শহর বলে থাকেন। এ শহরে অন্তত দেড় শ থিয়েটার রয়েছে। ১৮৫৬ সালে মস্কোর প্রাণকেন্দ্র থিয়েটার স্কয়ারে গড়ে ওঠে বিশ্বখ্যাত বলশই থিয়েটার। পর্যটন মৌসুমে এই থিয়েটার প্রাঙ্গণজুড়ে থাকে দর্শনার্থীদের ভিড়। রুশ জাতির গৌরবের প্রতীক এই বলশই থিয়েটার।
থিয়েটার বা নাট্যকলা বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য রাশিয়াতে রয়েছে নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ‘রাশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব থিয়েটার আর্টস’, ‘রাশিয়ান স্টেট ইনস্টিটিউট অব পারফরমিং আর্টস’ কিংবা ‘বরিস স্কুকিন থিয়েটার ইনস্টিটিউট’-এর যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে। প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে বিদেশি শিক্ষার্থীরা এসব প্রতিষ্ঠানে পড়তে আসেন।

উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯৭২ সাল থেকে রাশিয়া যাওয়া শুরু হয় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের। রাশিয়ায় পড়তে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের পছন্দের বিষয়ের তালিকায় থাকে চিকিৎসা, প্রকৌশল, স্থাপত্য ও ফলিত বিজ্ঞান। তবে গত কয়েক বছর ধরে এ দেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে কলা অনুষদের বিভিন্ন বিষয়, বিশেষ করে নাট্যকলায় রাশিয়ায় পড়ার আগ্রহ বাড়ছে।

‘স্তানিস্লাভস্কি, দানচেনকো, ভাখতানগভ, শেপকিন, শুকিন, মায়ারহোল্ড, মায়াকোভস্কি, আন্তন চেখভ—এ রকম অসংখ্য নাম যে ভূখণ্ডের সঙ্গে জড়িত, সেই ভূখণ্ডে নাট্য শিক্ষা তাঁদেরই স্বপ্নের প্রতিরূপায়ণ। শুধু নাট্যবিদ্যালয়গুলো নয়; মস্কোর রাস্তায়, থিয়েটারে প্রতিদিন যে শিক্ষা মেলে একজন নাট্যশিক্ষার্থীকে তা নতুন পথের সন্ধান দেয়।’ কথাগুলো বলছিলেন মহসীনা আক্তার।

নাট্যকলায় স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) পর্যায়ে অধ্যয়ন করতে ২০১৫ সাল রুশ সরকারের বৃত্তি নিয়ে রাশিয়ায় যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের প্রাক্তন এই শিক্ষার্থী। বর্তমানে তিনি ‘রাশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব থিয়েটার আর্টস’-এর শেষ বর্ষের ছাত্রী। রাশিয়ায় এ বিশ্ববিদ্যালয় ‘গিতিস’ নামে সুপরিচিত। গিতিস শুধু রাশিয়াতে নয়, বিশ্বে নাট্য শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।

গিতিসে কীভাবে একজন নাট্যশিল্পী গড়ে তোলা হয়, জানতে চাইলে প্রথম আলোকে মহসীনা আক্তার বলেন, ‘গিতিসে চার বছর স্নাতক করার আগেই একজন অভিনেতাকে আঙ্গিক-বাচিক অভিনয়, নৃত্য ও সংগীত সব বিষয়ে প্রশিক্ষিত হতে হয়। পারদর্শী শিক্ষার্থীই একজন শিক্ষকের (যিনি রাশিয়া এবং অন্য দেশে নিজের কাজের জন্য স্বীকৃত, যাঁর নিজস্ব থিয়েটার এক্সপেরিমেন্ট ল্যাবরেটরি রয়েছে) তত্ত্বাবধানে সব মিলিয়ে পাঁচ বছর নাট্য শিক্ষার সুযোগ পান। তারপর কঠিন পরিশ্রম শুরু হয় দুই ভাগে। এক দল প্রশিক্ষক শারীরিকভাবে তৈরি করেন, অন্য দল যে বিষয়ে স্পেশালিস্ট হবেন সেই বিষয়ে। প্রচুর মনো-দৈহিক চাপের মধ্য দিয়ে একজন নাট্যশিল্পী নিজেকে তৈরি করেন। গিতিস-এর কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়, এটা একটা কারখানা, যেখানে নিখুঁতভাবে তৈরি হয় সূক্ষ্ম মানবিক অনুভূতি সম্পূর্ণ শিল্পীযন্ত্র।’

সহপাঠীদের সঙ্গে মহসীনা আক্তার (বাঁয়ে)
সহপাঠীদের সঙ্গে মহসীনা আক্তার (বাঁয়ে)

২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের জন্য রুশ সরকারের বৃত্তি পেয়ে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের মেধাবী দুই শিক্ষার্থী ধীমান চন্দ্র বর্মণ ও মো. ইলিয়াস। দুজনই পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছেন পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো থিয়েটার প্রতিষ্ঠান ‘রাশিয়ান স্টেট ইনস্টিটিউট অব পারফরমিং আর্টস’-এ। ১৭৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘রাশিয়ান স্টেট ইনস্টিটিউট অব পারফরমিং আর্টস’ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দুই শতাধিক থিয়েটার বিষয়ে অধ্যয়ন করার সুযোগ রয়েছে।

তিন বছর মেয়াদি এই শিক্ষা কারিকুলামের প্রথম বছরে শুধু রুশ ভাষা শিখবেন ধীমান চন্দ্র বর্মণ ও মো. ইলিয়াস। মূল কোর্সে তাঁদের থিয়েটার স্টাডিজ বিষয়ে অভিনয়ের ওপর উচ্চতর পড়াশোনা, গবেষণা ও ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ থাকবে। ধীমান বলেন, ‘থিয়েটারের সব বিষয় আমার ভালো লাগে। কিন্তু অভিনয় আমার প্রথম ভালো লাগার নাম। মূলত অভিনয়ের প্রতি এই ভালোবাসার জন্যই রাশিয়াকে বেছে নিয়েছি।’ ওদিকে ইলিয়াসের বক্তব্য, ‘আমাদের দেশে থিয়েটারের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত প্রফেশনালিজম অর্জিত হয়নি। অথচ রাশিয়ায় শতভাগ পেশাদারি থিয়েটার চর্চা হচ্ছে। রাশিয়াতে পড়তে যাওয়া আমার জন্য অনেক বড় সুযোগ।’

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ইসরাফিল শাহীন বলেন, ‘রাশিয়া থিয়েটারের দেশ। রাশিয়ার থিয়েটার স্কুলগুলো অনেক বছরের পুরোনো। সেখানে নাট্যকলার খুঁটিনাটি বিষয়গুলো হাতেকলমে শেখানো হয়। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে নাট্যকলার বিভিন্ন কোর্সে পড়তে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ফিরে এসে তাঁদের ভাবনাগুলো যখন যোগ হবে; নিঃসন্দেহে আমাদের নাট্যচর্চায় নতুন মাত্রা যোগ হবে।’