পড়ালেখা ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ যেখানে বড়

ছুটির পর শুরু হয়েছে নতুন সেমিস্টার। আবার জমে উঠেছে ক্যাম্পাসের আড্ডা। ছবি: খালেদ সরকার
ছুটির পর শুরু হয়েছে নতুন সেমিস্টার। আবার জমে উঠেছে ক্যাম্পাসের আড্ডা। ছবি: খালেদ সরকার

সমুদ্রের ছবি আঁকা কি ঢাকার ক্লাসরুমে বসে শেখা যায়? তাই ছাত্রছাত্রীরা দল বেঁধে চলে যান কক্সবাজারে। এক দিকে ক্লাসরুমের পড়াশোনা আর অন্য দিকে আশপাশের জগৎটা দেখা—দুটোর সামঞ্জস্য রেখে সাজানো হয়েছে ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের (ইউডা) পাঠ্যক্রম। ‘টিচাররা চান না, আমরা শুধু বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকি।’ কারণটা ব্যাখ্যা করলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী নাসিবুর রহমান খান। কক্সবাজারে শিক্ষাসফর শেষে কদিন আগে ঢাকায় ফিরেছেন তিনি। ইউডার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এই আড্ডায় আমাদের সঙ্গে আরও ছিলেন ম্যাথিবু সরকার, নোমান রহমান আর সুমাইয়া আকতার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাসের কাছে, ধানমন্ডি লেকের পাড়ে বসে কথা হচ্ছিল তাঁদের সঙ্গে। এই শিক্ষার্থীরা ইউডার চারুকলা বিভাগে পড়ছেন। রং নিয়ে তাঁদের কারবার। পড়ালেখা শেষে তাঁরা রং ছড়িয়ে দিতে চান গোটা পৃথিবীতে।
পুরো একটা দিন ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কাটিয়ে বোঝা গেল, শুধু চারুকলা নয়, এখানে অন্যান্য বিভাগে যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের স্বপ্নের ক্যানভাসটাও অনেক বড়। বিবিএর শিক্ষার্থী সৈয়দ আল মেরাজুল ইসলাম পড়াশোনা শেষে উদ্যোক্তা হতে চান। তানজিলা মুকুল, সজীব মোল্লাহ, তমাল রহমানেরাও এরই মধ্যে ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। ডিএসএলআর ক্যামেরা হাতে ছোটাছুটি করতে দেখা গেল কমিউনিকেশন ও মিডিয়া স্টাডিজের শিক্ষার্থী আরিফ, সানজিদা আর শবনমকে। ‘ক্লাস প্রজেক্ট’-এর অংশ হিসেবে তাঁদের নাকি একটি তথ্যচিত্র তৈরি করতে হবে।

ল্যাব ক্লাসে নিয়মিত অংশ নিতে হয় শিক্ষার্থীদের
ল্যাব ক্লাসে নিয়মিত অংশ নিতে হয় শিক্ষার্থীদের

বৃত্তি ও গবেষণা
ঢাকার ধানমন্ডিতে ভিন্ন ভিন্ন ভবনে ইউডার বিভিন্ন বিভাগের ক্লাস চলে। ছয়টি ফ্যাকাল্টির বিভিন্ন বিষয়ে সাড়ে ৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন প্রায় ৩৫০ জন শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিজস্ব হলে থাকার সুযোগ আছে। দরিদ্র ও অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের পরিবারের আর্থিক সক্ষমতা অনুসারে বৃত্তি দেওয়া হয় এখানে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগও দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখানে গবেষণার ওপর আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়। ক্যাম্পাসের গবেষণাগারে নিয়মিত ক্লাসে অংশ নিতে হয় ছাত্রছাত্রীদের। প্রথম বর্ষের ছাত্র ইলিয়াস ও সাব্বিরের সঙ্গে দেখা হলো ফার্মেসি ল্যাবে। জানালেন, প্রথম সেমিস্টার থেকেই তাঁদের ল্যাবে আসতে উৎসাহিত করছেন শিক্ষকেরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ল্যাব, ইলেকট্রনিকস ল্যাব, ডিজিটাল ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ল্যাব, ফার্মেসি ল্যাব, মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব, অ্যানিমেল হাউস, টিস্যু কালচার ল্যাব আর ডিজিটাল স্টুডিও ও ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাবে দিনের অনেকটা সময় কাটে ছেলেমেয়েদের।

সহশিক্ষা কার্যক্রম
সহশিক্ষা কার্যক্রমের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মুজিব খান। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, পড়ার বাইরে শিক্ষার্থীদের দায়িত্বশীল ও সমাজ সচেতন করে তোলা বিশ্ববিদ্যালয়েরই কর্তব্য। আমরা তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বিকাশের সব সুযোগই করে দিচ্ছি।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান ও তওসিফ জানালেন ইউডার অন্য রকম এক আয়োজনের খবর। মেহেদী বলেন, ‘প্রতিবছরই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় পরিসরে একটি আয়োজন করা হয়। নাম “ইউডা উইক”। এ সময়ে আমাদের ক্যাম্পাসে সপ্তাহব্যাপী খেলাধুলা, বিতর্ক, ছবি আঁকা আর ক্লাবের বিভিন্ন আয়োজন থাকে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ক্লাব, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া ক্লাবসহ অন্যান্য ক্লাবের কার্যক্রম চোখে পড়ল দেয়ালিকা আর পোস্টারে। প্রথম বর্ষের রোকনুজ্জামান রোমান, শামসুজ্জামান সামস আর ইব্রাহিম ফাহাদ আড্ডা দিচ্ছিলেন ক্যাম্পাসের সামনের করিডরে। সামস বললেন, ‘কোন ক্লাবে যুক্ত হব, সেটাই ভাবছি। সামনে অনেকগুলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আছে। ফেব্রুয়ারি আর মার্চে ক্লাবগুলো বেশি সরব থাকে।’ চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মেরাজুল বলেন, ‘স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের রাস্তায় আমরা প্রতিবছর আল্পনা আঁকি। চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরাই এই আঁকাআঁকির নেতৃত্বে থাকে। ২৫ মার্চ সারা রাত ধরে চলে এই কর্মযজ্ঞ।’

ইউডার পাঠাগার
ইউডার পাঠাগার

অনুজদের অনুপ্রেরণা
অনুপ্রেরণা পেতে ইউডার শিক্ষার্থীদের খুব বেশি দূরে তাকাতে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রজেরাই তাঁদের পথ দেখান। ইউডার সাবেক ছাত্র এম নুরুন্নবী যেমন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলে গবেষণায় নিযুক্ত আছেন। ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে কাটাছেঁড়া না করেই কীভাবে হার্টের ব্লক দূর করা যায়, এটাই তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু। ইউডার আরেক প্রাক্তন মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম। বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র ছিলেন তিনি। এখন ন্যানো টেকনোলজি ও জিন থেরাপি নিয়ে কাজ করছেন এই গবেষক।

সবার জন্য সমতা
ছিন্নমূল ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য চালু হয়েছিল সমতা স্কুল ও কলেজ। ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের (ইউডা) শিক্ষক আর শিক্ষার্থীরাই এই স্কুল পরিচালনা করেন। শিক্ষকতা থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কার্যক্রমগুলোও পরিচালিত হয় ইউডা থেকে। জোবাইদা আক্তার যেমন ইউডার ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী, তিনিই আবার সমতা স্কুলের শিক্ষক। প্রতিদিন নিজের ক্লাস শেষ করে ছোটেন ক্লাস নিতে। জোবাইদা বলেন, ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই আমরা সুবিধাবঞ্চিত এই শিক্ষার্থীদের পড়াই। যে অভিজ্ঞতা হচ্ছে, নেতৃত্বের গুণাগুণ শিখছি, এটা অনেক বড় পাওয়া।’ জোবাইদার মতোই আরেক শিক্ষার্থী রতন মিয়া। তিনিও সমতার শিক্ষক। রতন বলেন, ‘আমি বিবিএ শেষ করে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়ার পাশাপাশি শিক্ষকতা করছি। আমাদের দায়িত্ব হলো এই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সামনে একটা সুন্দর ভবিষ্যতের পথ তৈরি করে দেওয়া।’

সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করছি
অধ্যাপক মুজিব খান
প্রতিষ্ঠাতা, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ
বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আমরা সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কাজ করার চেষ্টা করছি। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন গবেষণা খাত ও পেশা জগতে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিচ্ছে। আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা যেন দেশের বাজার ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাজের সুযোগ পায়, শিক্ষকেরা সেভাবেই তাদের গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। সে জন্য আমরা সব সময় শিক্ষকদের মান উন্নয়নে জোর দিই। সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা স্কুল ও কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গেও যুক্ত আছেন। আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে এখানে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন রকম বৃত্তি ও আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়, যেন দরিদ্র ছেলেমেয়েরা পড়ালেখার সুযোগ পায়।