শীতের সঙ্গে সন্ধি

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সকালবেলা ক্লাসে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ছবি: মঈনুল ইসলাম
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সকালবেলা ক্লাসে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ছবি: মঈনুল ইসলাম

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, এ বছরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা গত ৬৮ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। জেঁকে বসেছে শীত। রাজধানীর শিক্ষার্থীরাই যেখানে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সকালের ক্লাস ধরছেন, সেখানে উত্তরবঙ্গের ক্যাম্পাসগুলোর ছেলেমেয়েদের কী হালচাল? চলুন, শোনা যাক

সালমান মাহী রুহুল কাওসার যখন দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন, তখনো তিনি জানতেন না ‘শীত’ কী জিনিস! ঢাকা সিটি কলেজে পড়তেন। ক্লাস হতো দুপুরবেলায়। সকালে কোচিংয়ের পড়া থাকলেও লেপের নিচে মোটামুটি আটটা-নয়টা নাগাদ গুটিসুটি মেরে থাকা যেত। দিনাজপুর মেডিকেলে (নতুন নাম এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ) ভর্তি হওয়ার পর তিনি আবিষ্কার করলেন, ঢাকার শীত আর উত্তরবঙ্গের শীতের মধ্যে বিস্তর ফারাক। দিনাজপুর মেডিকেলের এই ইন্টার্ন চিকিৎসক তাঁর শুরুর সময়টার স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন, ‘স্বাভাবিক নিয়মে ক্লাস শুরু হয় সকাল সাড়ে সাতটায়। শীতের সময় এত সকালে কিছুই দেখা যায় না। তাই ক্লাসের সময়টা আধঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়। এই আধঘণ্টায় আর কীই-বা আসে যায়? আমাদের ঠিকই ঘুম থেকে সাতটার সময় উঠে পড়তে হতো। হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে হতো দ্রুত। কারণ, একটু দেরি করলেই বাথরুম সিনিয়রদের দখলে চলে যাবে। কোনোমতে হাতে-মুখে পানি ছুঁইয়ে বের হতাম। বের হওয়ার প্রস্তুতিও কম না। প্রথমে টি-শার্ট, তার ওপর শার্ট, হাফহাতা সোয়েটার, ফুলহাতা সোয়েটার, জ্যাকেট আর সবশেষে অ্যাপ্রোন—তাতে যদি শীত কিছুটা মানে!’

গত ৮ জানুয়ারি ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা যখন ৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তেঁতুলিয়ায় সেটি ছিল ২.৬! সৈয়দপুরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, দিনাজপুরে ৩.২। এবারের শীতে ঢাকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে শিক্ষার্থীরা সকালের ক্লাস ধরতে হিমশিম খাচ্ছেন, উত্তরবঙ্গের শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে সাহস সঞ্চয় করতে পারেন। শীতের সময় রংপুর, দিনাজপুর, সৈয়দপুরসহ উত্তরবঙ্গের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাম্পাস-জীবন আসলে একেবারেই অন্য রকম।

তবু প্রিয় শীত

‘সুয্যি মামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে’—কবিতার পঙ্‌ক্তির মতোই প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙে দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের। কুয়াশা ঠেলে সূর্যটা উঁকি দিতে দিতে প্রায় দুপুর হয়ে যায়, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের তো আলসেমি করার সুযোগ নেই। হাবিপ্রবির রসায়ন বিভাগের ছাত্র নাসিম আহমেদ বলছিলেন, ‘আমাদের শীতকালীন ছুটি ছিল ডিসেম্বরের শেষ দিকে। কিন্তু বেশি ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে ক্লাস শুরু হওয়ার পর। আর এখন শীতের যা অবস্থা! তাপমাত্রা দেখি কমতে কমতে আমার সিজিপিএর চেয়েও কমে গেল। (হাসি)’

বাসায় থেকে যাঁরা পড়ালেখা করছেন, গোসল করার সময় গরম পানির বন্দোবস্ত হয়তো তাঁদের হয়েই যায়। কিন্তু উত্তরবঙ্গের ক্যাম্পাসগুলোতে যাঁরা হলে থাকেন, তাঁদের কথা ভাবুন! পাঠক, আবারও সালমানের বক্তব্য থেকেই আপনাদের শোনাই। ‘এখন আমরা গরম পানির একটা না একটা ব্যবস্থা করতে পারি। প্রথম বর্ষে পড়ার সময় দুপুরের দিকে বালতি নিয়ে হলের ছাদে উঠে যেতাম। কিছুক্ষণ লাফালাফি করে শরীরটা গরম করে নিয়ে তারপর গোসল করতাম। আমাদের অনেক বন্ধু আছে, যারা সপ্তাহে একবার গোসল করত।’

বিকেলে দলবেঁধে পিঠা খেতে বের হয়েছেন হাবিপ্রবির ছাত্রছাত্রীরা
বিকেলে দলবেঁধে পিঠা খেতে বের হয়েছেন হাবিপ্রবির ছাত্রছাত্রীরা

প্রচণ্ড শীতের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিক্ষার্থীদের অবশ্য সময় লাগে না। ছোট ছোট আনন্দের উপলক্ষ খুঁজে বের করে শীতকে তাঁরা উপভোগ করেন। রংপুর মেডিকেল কলেজে তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন ইসরাত জাহান। বললেন, ‘সকাল সাড়ে সাতটা থেকে ক্লাস। এত সকালে ক্লাসে যেতে কষ্ট হয়, কিন্তু শীতকালের মজাটা শীতের পিঠায়। ক্যাম্পাসের আশপাশে যেসব জায়গায় ভাপা পিঠা পাওয়া যায়, সেখানে আড্ডা বসে। সঙ্গে নিয়মিত চায়ের দোকানের আড্ডা তো আছেই। এসবের মজা আলাদা।’ হাবিপ্রবির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাকিব হাসান ভালোবাসেন ব্যাডমিন্টন খেলতে। শীতকাল তাই তাঁর খুব প্রিয়। রাকিব বলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পাসে প্রতি শীতে ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট হয়। এ বছরও হয়েছে।’ এভাবেই চায়ের কাপের উত্তাপ, ভাপা পিঠার ধোঁয়া কিংবা ব্যাডমিন্টন খেলার আনন্দ এই তরুণদের হৃদয়টাকে উষ্ণ করে। শীত তাঁদের কাবু করতে পারে না।

শীত বাড়ে, দায়িত্বও বাড়ে

উত্তরবঙ্গে শীতকালে যখন দরিদ্র মানুষ ঠান্ডার কষ্টে ভোগে, সেখানকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই তখন সবার আগে এগিয়ে যান। নিজেদের কষ্ট থেকেই তাঁরা অন্যের কষ্টটা বুঝতে পারেন।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের ছাত্র মাহফুজুল ইসলাম বললেন, ‘আমরাও প্রতিবছর শীতবস্ত্র বিতরণ করি। শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে টাকা তুলে এরপর নির্দিষ্ট দিনে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে সাহায্য করি। এ বছর টাকা তোলার কাজ শেষ হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই শীতবস্ত্র বিতরণের কাজ শুরু হয়ে যাবে।’

 ‘শীতবস্ত্র সংগ্রহের কাজ মোটামুটি হয়ে গেছে। আগামী ১৫ তারিখ আমরা আশপাশের এলাকাগুলোতে ২০০ কম্বল বিতরণ করব।’ বলছিলেন হাবিপ্রবি বন্ধুসভার সভাপতি মো. আশিকুর রহমান। উত্তরবঙ্গের মেডিকেল কলেজগুলোর ছাত্রছাত্রীদের দায়িত্বটা আরও বড়। শুধু শীতবস্ত্র বিতরণের মধ্য দিয়েই তাঁদের কার্যক্রম শেষ হয় না। এ সময়টাতে মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে অসংখ্য অগ্নিদগ্ধ রোগী ভর্তি হয়। তাই আশপাশের এলাকা ঘুরে মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করেন। যেন আগুন পোহাতে গিয়ে কেউ দুর্ঘটনার শিকার না হন।