প্রাণের টানে নিজের স্কুলে

>

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দুটি বিদ্যালয়। দুটি বিদ্যালয়ই বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্মৃতিবিজড়িত। ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের বয়স ১১০ এবং অপর্ণা চরণ সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের বয়স ৯০ বছর। ১২ ও ১৩ জানুয়ারি আলাদাভাবে দুটি স্কুলেরই পুনর্মিলনী উৎসব উদ্‌যাপিত হয়। প্রাক্তন ছাত্রীদের পদচারণে মুখরিত হয় এই দুই বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ। দুটি পুনর্মিলনী উৎসবের কথা থাকছে এই প্রতিবেদনে। লিখেছেন প্রণব বল

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়ের পুনর্মিলনী উৎসবে প্রাক্তন ছাত্রীরা মেতে উঠেছিলেন আনন্দে, যেন খুঁজে পেয়েছিলেন নিজেদের শৈশব। ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় উৎসব। ছবি: অধুনা
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়ের পুনর্মিলনী উৎসবে প্রাক্তন ছাত্রীরা মেতে উঠেছিলেন আনন্দে, যেন খুঁজে পেয়েছিলেন নিজেদের শৈশব। ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় উৎসব। ছবি: অধুনা

ডা. খাস্তগীর বিদ্যালয়ের ১১০ বছর

ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্রনেত্রী দীপা দত্ত। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে ছিলেন মিছিলের সামনের সারিতে। কাছ থেকে দেখেছেন আসাদের মৃত্যু। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোর সাক্ষী। বয়স বেড়েছে। কিন্তু স্মৃতি এখনো জাগ্রত। সেই স্মৃতি খুঁজতে প্রাণের টানে তিনি ঢাকা থেকে ছুটে যান তাঁর পুরোনো বিদ্যালয়ে। ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের এই প্রাক্তন শিক্ষার্থী যোগ দেন বিদ্যালয়টির পুনর্মিলনী উৎসবে।

বিদ্যালয়টির ১১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১২ ও ১৩ জানুয়ারি স্কুল প্রাঙ্গণে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। উৎসবে যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দীপা দত্তের মতো পুরোনো অনেক শিক্ষার্থী ছুটে যান প্রিয় স্কুল প্রাঙ্গণে। অতঃপর বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্তদের উত্তরসূরিরা ফিরে যান সেই পুরোনো দিনে।

হ্যাঁ, এই বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী ছিলেন প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্ত। এ ছাড়াও কত গুণীর পা পড়েছে এই বিদ্যাপীঠে। সাহিত্যিক মৈত্রেয়ী দেবী, ভাস্কর নভেরা আহমেদ, লেখিকা ফাহমিদা আমিন, রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী মায়া সেন, রাজনীতিক সাজেদা চৌধুরীসহ অনেকেই এই বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন।

সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছেন এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পড়েছে এই বিদ্যালয়ে। এই যেমন দীপা দত্ত ১৯৬২ সালে এই বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। তাঁর মাসি (খালা) প্রণতি দস্তিদারও এখানকার শিক্ষার্থী। প্রণতি দস্তিদারের মেয়ে মহুয়া দস্তিদার একই বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৮৩ সালে।

দীপা দত্ত বলেন, ‘অনেক কিছুই বদলে গেছে, তবে স্কুল ভবনটি এখনো রয়ে গেছ। সেসব স্মৃতি খুঁজে ফিরছি। এই বিদ্যালয় নারীশিক্ষার জন্য অনন্য। ৫৫ বছর আগের সেই দিনগুলো খুব মনে পড়ছে আমার।’ বলতে বলতে দীপা দত্তের চোখের কোণে আবেগের জল। আক্ষেপও রয়েছে তাঁর, ‘প্রীতিলতা, কল্পনা দত্তের আবক্ষ মূর্তি কিংবা স্মৃতিচিহ্ন থাকতে পারত এ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। কিন্তু নেই।’

রোকেয়া খানম ১৯৫৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। তাঁরা তিন প্রজন্ম এখানে পড়েছেন। রোকেয়ার পাঁচ মেয়ে নাহিদা খানম (১৯৭৯), নাজমা বেগম (১৯৮৩), জাকেরা বেগম (১৯৮৪), সাঈতা বেগম (১৯৮৯) ও জাহিদা বেগম (১৯৯০) এই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। আবার জাকেরা বেগমের মেয়ে সামিহা নাওয়ার ২০১২ সালে একই বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন।

রোকেয়া খানম বলেন, ‘তখন নারীদের শিক্ষার বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহ ছিল না। তবু আমরা পড়েছি। পরে আমার মেয়ে, নাতনিও এখানে পড়েছে। তারও আগে আমার খালা জোবেদা খাতুনও এখানে পড়েছেন। দীর্ঘদিন পর আবার বিদ্যালয়ে এসে কী যে ভালো লাগছে!’ একইভাবে দিল আফরোজ ও তাঁর দুই মেয়ে তাহমিনা পারভিন এবং আমেনা শাহিনও এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরাও অংশ নিয়েছে পুনর্মিলনী উৎসবে। ২০১৭ সালে এসএসসি পাস করা শাহনাজ সুলতানা, নাফিসা নওরোজ ও সাঈদা জাহান এসেছিল পুনর্মিলনী উৎসবে। নাফিসা বলল, ‘বিদ্যালয়ে যখন ছিলাম তখন বুঝিনি আসলে এটি কত প্রিয় জায়গা। এখন প্রতিমুহূর্তে বিদ্যালয়ের স্মৃতিগুলো মিস করি। বন্ধুদের সান্নিধ্যও খুব মনে পড়ে।’

১৯০৭ সালে দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনের পিতা যাত্রামোহন সেন তাঁর শ্বশুর ডা. অন্নদা চরণ খাস্তগীরের নামে এই অঞ্চলের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তবে তার আগে ১৮৭৮ সালেই ব্রাহ্ম সমাজের কর্তা চরণ অন্নদা খাস্তগীর চট্টগ্রামে বার্নাকুলার মাধ্যমিক স্কুল নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পরে জামালখানের সাত একর জমি দান করে যাত্রামোহন সেন ওই স্কুলকেই ডা. খাস্তগীর স্কুল নামকরণ করেন। ১৯০৭ সালে মাত্র তিনজন ছাত্রী নিয়ে এই স্কুলটি তার যাত্রা শুরু করে।

পুনর্মিলনী উৎসবে অতিথি হিসেবে যোগ দেন অন্নদা চরণ খাস্তগীরের উত্তরসূরি চিকিৎসক গৌতম খাস্তগীর। তিনি বলেন, ‘এই বিদ্যালয় এই অঞ্চলে নারীশিক্ষায় অনন্য ভূমিকা রেখে আসছে। এই বিদ্যালয়ের জন্য আমরাও গর্বিত।’

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়ের পুনর্মিলনী উৎসবে প্রাক্তন ছাত্রীরা মেতে উঠেছিলেন আনন্দে, যেন খুঁজে পেয়েছিলেন নিজেদের শৈশব। অপর্ণা চরণ সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের উৎসব। ছবি: অধুনা
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়ের পুনর্মিলনী উৎসবে প্রাক্তন ছাত্রীরা মেতে উঠেছিলেন আনন্দে, যেন খুঁজে পেয়েছিলেন নিজেদের শৈশব। অপর্ণা চরণ সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের উৎসব। ছবি: অধুনা

৯০ বছরের অপর্ণা চরণ বিদ্যালয়

অপর্ণা চরণ সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সঙ্গেও বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নামটি জড়িত। প্রীতিলতা ছিলেন এই বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক। এরপর প্রণতি সেন দীর্ঘ ৩৯ বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।

বিদ্যালয়টির ৯০ বছর পূর্তিতে প্রাক্তন ছাত্রীদের পুনর্মিলনীতে এই দুটি নাম ঘুরেফিরে এসেছে। এসেছে অন্য দিদিমণিদের (শিক্ষক) কথাও। ১২ ও ১৩ জানুয়ারি দুই দিনব্যাপী পুনর্মিলনী উৎসব হয়ে গেল। প্রথম দিন স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে শোভাযাত্রা বের হয়। দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান হয় লাভ লেইনের স্মরণিকা কমিউনিটি সেন্টারে।

বর্ণিল পোশাক পরা বিভিন্ন বয়সী প্রাক্তন ছাত্রীরা যেন হঠাৎ করে সেই শৈশবে ফিরে গেলেন। মাথায় ফুলের মুকুট পরে ঢোলের তালে তালে নাচছেন, গাইছেন, আনন্দ করছেন। ক্যাম্পাসের এদিক-সেদিক খুঁজছেন স্মৃতিচিহ্ন। খুঁজে ফিরেছেন সহপাঠীদের।

নাড়ির টানে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এই উৎসবে যোগ দেন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। শোভাযাত্রা, স্মৃতিচারণা, আড্ডা আর নেচেগেয়ে আনন্দে মেতেছিলেন তাঁরা।

গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পারভীন মাহমুদও যোগ দেন পুনর্মিলনী উৎসবে। তিনি বলেন, ‘এ স্কুল থেকে অনেক গুণী বের হয়েছেন। এখানে শিক্ষকতা করেছেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও প্রণতি সেনের মতো বিখ্যাত নারীরা। সেদিক থেকে আমরা ধন্য। আমাদের স্কুলের সুন্দর একটি মাঠ ছিল। কিন্তু এখন সেখানে ভবন উঠে গেছে। এটা খুব কষ্ট লাগে। তবে পুরোনো বন্ধুদের পেয়ে অনেক ভালো লাগছে। খুব আনন্দ হইচইয়ে কেটে যাচ্ছে সময়।’

১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি এবার প্রথমবারের মতো পুনর্মিলনী উৎসবের আয়োজন করেছে। উৎসবে ১৯৪৭ সালের ম্যাট্রিকুলেশন ব্যাচ থেকে শুরু করে ২০১৭ সালের এসএসসি পাস করা প্রায় ১ হাজার ২০০ প্রাক্তন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন।

১৯৫৭ ব্যাচের খদিজা হোসেন আক্তার বলেন, এ এক অন্য রকম আনন্দ। আবার যেন সেই শৈশবে ফিরে যাওয়া। বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী অধ্যাপক শুক্লা ইফতেখার আনন্দে মেতেছিলেন নিজের সহপাঠীদের সঙ্গে। আরেক অধ্যাপক রীতা দত্তও ছিলেন এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এ ছাড়া অভিনেত্রী তরু মোস্তফা, চিত্রলেখা গুহও প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

তরু মোস্তফা ১৯৭১ সালে এসএসসি পাস করেন। তিনি সেই স্মৃতিচারণা করলেন। ‘তখন আমরা দুবার পরীক্ষা দিয়েছিলাম। বইপত্র সব ছিল না। অনেক কষ্ট করে পরীক্ষা দিয়েছি। এত দিন পর স্কুলে এসে খুব ভালো লাগছে। তবে স্কুলের অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। এটা দেখে খারাপ লাগছে।’

অভিনেত্রী চিত্রলেখা গুহ শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সবখানে ছিলেন সাবলীল। নেচেগেয়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন নিজের সহপাঠীদের। আরেক প্রাক্তন সুমি খানের কণ্ঠেও নস্টালজিয়া, ‘অনেক বন্ধুকে পেয়েছি। আবার অনেকে আসেনি। তবে ভালো লাগছে।’ একই ধরনের কথা বললেন প্রাক্তন ছাত্রী রচিতা দে।

১৯৯১ ব্যাচের পুরশ্রী মজুমদার, আসমা আজিম, জেসমিন আক্তার, আমাতুল খায়ের, সাফিয়া রহমানেরা মেতেছিলেন বাঁধভাঙা উল্লাসে। সমস্বরে বলেন, ‘যদি আবার সেই দিনগুলো ফিরে পেতাম। আমাদের সোনালি শৈশব-কৈশোর।’

প্রাক্তন ছাত্রী জোবায়েদা আক্তার, শাহীন, মিলি, জ্যোৎস্না কায়সার, সীমারা সবাই একই ধরনের শাড়ি পরে পুনর্মিলনীতে অংশ নিয়েছেন। কম যাননি ১৯৯৬ ব্যাচের উমা দত্ত, আসমা খানমেরাও। আরও অনেকের মতো ২০০১ ব্যাচের শারমিন মৃত্তিকা পুনর্মিলনীতে অংশ নিতে ছুটে আসেন ঢাকা থেকে।

এভাবে আনন্দ-আড্ডায় কেটে গেছে দুটি দিন। অনুষ্ঠান শেষে গত শনিবার রাতে ফেরার সময় সবার চোখ ছলছল করে উঠছিল। বিদায়বেলায় অনেকের কণ্ঠে ছিল সেই গান, ‘দেখা হবে বন্ধু কারণে-অকারণে...।’