চিত্ত যেথা ভয়শূন্য

সময়ের সঙ্গে প্রযুক্তির দিক দিয়েও এগিয়েছে ৬১ বছরের পুরোনো এই শিক্ষাঙ্গন। ছবি: কবির হোসেন
সময়ের সঙ্গে প্রযুক্তির দিক দিয়েও এগিয়েছে ৬১ বছরের পুরোনো এই শিক্ষাঙ্গন। ছবি: কবির হোসেন

এখনো শহরের অনেক রাস্তায় মেয়েরা চলে ভয় নিয়ে। ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে গেলে কত কিছু ভেবেই না পথ চলতে হয়। আধুনিক এই সময়ে এসেও এই ভয় কাটে না। তাহলে ভাবুন তো আজ থেকে ৬০ বছর আগের পরিস্থিতি। কতটা সংশয়, শঙ্কা আর দ্বিধা নিয়েই না মেয়েদের পথ চলতে হতো। মেনে চলতে হতো কত নিয়মকানুন। সেই সব মেনেই নারীশিক্ষার প্রসারে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন অধ্যাপক আবদুল মতিন ও তাঁর স্ত্রী বেগজাদী মাহমুদা নাসির। তাঁরা সেই ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেশের প্রথম বেসরকারি মহিলা কলেজ—সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ।

বর্তমানে ঢাকার টিকাটুলীতে বিশাল পরিসরে ছড়িয়ে থাকা এই কলেজের যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলাবাজার গার্লস স্কুলের কয়েকটি কক্ষ নিয়ে। অল্প কয়েকজন তরুণ শিক্ষাবিদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও দুঃসাহসী স্বপ্নের বাস্তবায়ন ছিল কলেজটি, যা আজ মাথা উঁচু করে স্বমহিমায় দাঁড়িয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলে গেলেও বদলায়নি একটি দিক; তা হলো—নারীশিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্য। স্থাপনার উন্নয়ন, ক্যাম্পাসের প্রসার, দক্ষ শিক্ষক দল গড়া—এসবই হচ্ছে শুধু মেয়েদের শিক্ষার প্রসারের কথা মাথায় রেখে। উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে যোগ হয়েছে স্নাতক। এর বিস্তৃতি শিগগিরই স্নাতকোত্তর পর্যন্তও ছড়াবে, এমন আশার কথা শোনালেন কলেজের অধ্যক্ষ ইফতেকার আলী। তিনি বলেন, ‘কলেজে এখন ৪টি বিষয়ে স্নাতকে পড়ার সুযোগ আছে। আগামী বছর নাগাদ ১৫টি বিষয়ে স্নাতক ও ৪টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়ার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। তা ছাড়া দারুণ প্রতিযোগিতামূলক এই সময়ে আমরা শিক্ষার্থীদের আভিধানিক ও নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি পেশাজীবনের জন্যও তৈরি করতে চাই। এ জন্য আমাদের পরিকল্পনা কিছু স্বল্পমেয়াদি প্রফেশনাল কোর্স চালুর পরিকল্পনা করছি। এগুলো শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনে সফল ও সাহসী হতে সাহায্য করবে।’

কলেজেই আছে হ্যান্ডবল খেলার মাঠ, যেখানে নির্বিঘ্নে অনুশীলন করতে পারে মেয়েরা
কলেজেই আছে হ্যান্ডবল খেলার মাঠ, যেখানে নির্বিঘ্নে অনুশীলন করতে পারে মেয়েরা

সুবিশাল ক্যাম্পাসটিতে পা রাখলেই ছাত্রীদের কোলাহল কানে আসে। বাস্কেটবল ও হ্যান্ডবল খেলার জন্য নির্ধারিত জায়গায় চলে অনুশীলন। টেবিল টেনিসের ঘরটাও অবসর সময়ে ফাঁকা থাকে না। আবার ক্লাসের সময় এলে মেয়েরা মনোযোগী হয় পড়ায়। নতুন করে সাজানো কম্পিউটার ল্যাব আর পাঠাগারের পাশে সংযুক্ত রিডিংরুমও এখন শিক্ষার্থীদের সময় কাটানোর প্রিয় জায়গা। তবে এসবের ফাঁকেও আড্ডা তো শিক্ষাজীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কলেজ ক্যাম্পাসে সেটার অবাধ সুযোগ। সুসজ্জিত ক্যানটিন আর খোলা বারান্দা ছাত্রীদের প্রিয় আড্ডাস্থল। মোদ্দাকথা, মেয়েদের সংকোচহীনভাবে ঘোরাফেরার জায়গা এই ক্যাম্পাস। এখান থেকেই তো তাদের সাহসী হয়ে চলতে শেখার শুরু। নিজের সাংস্কৃতিক ভাবনাকেও মেলে ধরার কত সুযোগ আছে, তা কলেজের মূল ফটক পেরিয়ে বাস্কেটবল কোর্টের দিকে এগোলেই বোঝা যায়। কারণ বাস্কেটবল কোর্টের দেয়াল ঘেঁষেই টাঙানো আছে কয়েকটি রঙিন বোর্ড। সেই বোর্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের লেখা কবিতা, ছড়া, গল্প, অনুগল্প আর তাদের আঁকা ছবি দিয়ে সাজানো। এটা সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজের নিয়মিত দেয়ালপত্রিকা কাকলি। ত্রৈমাসিকভাবে এই দেয়ালপত্রিকা বেরোয়। পুরোটাই সাজানো হয় কলেজের শিক্ষার্থীদের লেখা ও আঁকা দিয়ে। শিক্ষকদের সহায়তায় ছাত্রীরা বের করে একটি বার্ষিক সাময়িকীও। লেখা, আঁকা, খেলা—এর বাইরে গান, আবৃত্তি, নাচের মতো মননের বিকাশেও কলেজের বিভিন্ন ক্লাব শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করে। কোনো ভাবনাকে দাবিয়ে রাখাকে প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই। জড়তাকে কাটিয়ে ওঠার তাগিদ এই কলেজ প্রাঙ্গণেই দেওয়া হয় প্রতিনিয়ত। মেয়েরা বেড়ে উঠবে, নিজেদের মেলে ধরবে সংকোচহীনভাবে—মূল বার্তা এটাই।