জয়ধ্বনির জয়জয়কার

জয়ধ্বনির পরিবেশনায় গান
জয়ধ্বনির পরিবেশনায় গান

চট্টগ্রাম শহর থেকে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) ক্যাম্পাসের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। আজ থেকে আঠারো বছর আগে যোগাযোগব্যবস্থার অসুবিধা, ধীরগতির ইন্টারনেট—সব মিলিয়ে এই দূরত্বটা বলতে গেলে এর সংখ্যামানের চেয়েও বেশি মনে হতো। শহর থেকে দূরে বলেই হয়তো চুয়েটের ছাত্রছাত্রীরা বঞ্চিত হচ্ছিলেন নানা রকম উৎসব-পার্বণের আনন্দ থেকে। সংস্কৃতির চর্চাটাও যেন ঠিকঠাক হচ্ছিল না। প্রকৌশলবিদ্যায় পড়তে এসে শুধু সংখ্যা আর হিসাব-নিকাশে ডুবে থাকলে বুঝি মনের ক্ষুধা মেটে? অতএব, চুয়েটের শিক্ষার্থীদের কয়েকজন মিলে খুললে ফেললেন একটা সংগঠন। নাম জয়ধ্বনি। এরপর থেকে ক্যাম্পাসের প্রায় চার হাজার শিক্ষার্থীকে উৎসব, আয়োজনে মাতিয়ে রাখার দায়িত্ব জয়ধ্বনির কর্মীদের কাঁধে।

বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ দিবস, পয়লা ফাল্গুন, পয়লা বৈশাখসহ সব ধরনের পালাপার্বণেই টের পাওয়া যায় জয়ধ্বনির সরব উপস্থিতি। ‘আমাদের এই ক্লাবটাকে আপনি যদি আর দশটা সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন, তাহলে কিন্তু ভুল হবে। জয়ধ্বনিতে আমরা সংস্কৃতির প্রতিটা শাখার শুদ্ধ চর্চায় বিশ্বাসী,’ একটু গম্ভীর স্বরেই বললেন জয়ধ্বনির সাধারণ সম্পাদক লিউক তপু মণ্ডল। আরেকটু বিস্তারিত জানার আশায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকাই তাঁর দিকে। তপু ব্যাখ্যা করলেন, ‘নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয়, আলোকচিত্র, চিত্রকলা...’। তাঁর কথায় বোঝা গেল, জয়ধ্বনির কাজকর্মের ক্ষেত্রটা অনেক বড়, অনেক অনেক বড়।

চুয়েটের ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখার দায়িত্ব তো তাঁদেরই!
চুয়েটের ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখার দায়িত্ব তো তাঁদেরই!

যাঁরা নাচ, গান, অভিনয় জানেন না, তাঁদের কি জয়ধ্বনিতে জায়গা হবে না? প্রচার সম্পাদক শারদ চৌধুরী বললেন, ‘প্রতিটি প্রোগ্রামের আগে আমাদের গ্রুপিংয়ের আয়োজন থাকে। সেটা হোক নাটকের, গানের কিংবা ফটোগ্রাফির। কেউ যদি আমাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হন, আমরা তাঁকে সাহায্য করতে চেষ্টা করি। আমাদের বেশির ভাগ সদস্যই কিন্তু আগে থেকে কিছু শিখে আসেননি।’ শারদ তাঁর কথা শেষ না করতেই পাশ থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের (সিএসই) তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অন্তর মাহমুদ বলেন, ‘চুয়েটে আসার পর প্রথম প্রথম একটু আঁতেল গোছের ছিলাম। কিন্তু এই জয়ধ্বনি আমাকে এখন পাল্টে দিয়েছে। যেই আমি মানুষজনের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পেতাম, এখন আমি মূকাভিনয় করি। কয়েক শ মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে পারফর্ম করতে পারি।’ একটু বিরতি নিয়ে শারদ যোগ করলেন, ‘আমরা কিন্তু কয়েক দিন পরপরই আমাদের ক্লাব থেকে এখানে-ওখানে ঝটিকা সফরের আয়োজন করি। আমাদের ক্লাবের সব সদস্যের মাঝে বোঝাপড়াও অনেক ভালো।’

সিএসইর প্রথম বর্ষের ছাত্রী সাদিয়া তাসনুভা সংগঠনের নবীন সদস্য। তাঁর বক্তব্য, ‘অল্প কিছুদিন হলো জয়ধ্বনিতে আছি। এতটুকু বলতে পারি, আমি কেবল নিজেকে একজন ক্লাবের সদস্য বলি না, বরং একটি পরিবারের সদস্যই বলি। সিনিয়র ভাইয়া, আপুরা অনেক বেশি ভালো। আশা করি, বাকি তিন বছরও এই ক্লাবটার সঙ্গে থাকব।’

ইদানীং খুব ব্যস্ত সময় কাটছে জয়ধ্বনির সদস্যদের। গত মাসে প্রায় পাঁচটি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হয়েছে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘মিথ্যের মঞ্চে জ্বলে উঠুক সত্যের গল্প’ স্লোগানে আয়োজিত নাট্যোৎসব। ক্লাবের অর্জনও কম নয়। কনফিডেন্স সিমেন্ট তারুণ্য উৎসব ২০১৭ তে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন কিন্তু চুয়েটের জয়ধ্বনিই।

সংস্কৃতির শুদ্ধ চর্চায় বিশ্বাসী এই সংগঠনটি
সংস্কৃতির শুদ্ধ চর্চায় বিশ্বাসী এই সংগঠনটি

সুকান্ত বলেছিলেন, ‘তবু আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি...।’ এদিকে জয়ধ্বনিরই আঠারো বছর বয়স হতে চলেছে। আঠারো বছর বয়স মানে—ভয়হীন, আরও দুর্বার। জয়ধ্বনিও হয়তো তেমন হয়ে উঠবে।

ক্লাবটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হলো না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একেকজন একেক ক্ষেত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তবে ২০০৬ সালের কার্যকরী কমিটির সভাপতি তাকবীর রাসেলকে পাওয়া গেল। তিনি বললেন, ‘আমাদের সময় প্রতি সোমবারের সাপ্তাহিক মিটিংয়ে থাকতাম আমরা অল্প কয়েকজন।

কিন্তু এখন দেখি সংখ্যাটা অনেক বেড়েছে। বর্তমান সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছে, এ নিয়ে কিছু বলার নেই। সামনে এই ক্লাব আরও অনেক দূর যাবে। সবচেয়ে ভালো লাগে যখন জয়ধ্বনির নাম অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের মুখে শুনি। যখন বাইরের কেউ জিজ্ঞেস করে, জয়ধ্বনির অনুষ্ঠান দেখতে আসতে পারবে কি না। আমি তখন হাসি হাসি মুখ করে, গর্বে বুক ফুলিয়ে তাঁকে অনুষ্ঠান দেখতে নিয়ে আসি।’