খেলায় সেরা শ্রীকৃষ্ণ

জগন্নাথ হলের অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মহড়ায় মশাল হাতে শ্রীকৃষ্ণ। ছবি: দিপু মণ্ডল
জগন্নাথ হলের অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মহড়ায় মশাল হাতে শ্রীকৃষ্ণ। ছবি: দিপু মণ্ডল

ছেলে শ্রীকৃষ্ণ হালদারকে নিয়ে বাবা নারায়ণ হালদারের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। যে ছেলে স্কুলে প্রায় প্রতি ক্লাসেই ‘ফার্স্ট’ হয়, তার কিনা মন পড়ে থাকে মাঠে! ছোটবেলা থেকে কৃষ্ণ ভালো ক্রিকেট খেলে। এপাড়া-ওপাড়ায় তার খেলার ডাক আসে। নারায়ণ হালদার কখনো খেলতে নিষেধ করেননি। কিন্তু মুশকিল হলো তখন, যখন নবাবগঞ্জের শিকারি পাড়া টি কে এম উচ্চবিদ্যালয় ছেড়ে শ্রীকৃষ্ণ বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) পড়বে বলে গোঁ ধরল। কৃষ্ণের দাদারাও চেয়েছিলেন, সে বিকেএসপিতে পড়ুক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবার একগুঁয়েমির জয় হয়। কৃষ্ণের কোথাও যাওয়া হয় না।

এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র শ্রীকৃষ্ণ হালদার। বলছিলেন তাঁর শৈশবের দিনগুলোর কথা। ‘ছোটবেলা থেকে ফুটবল-ক্রিকেট খেলতাম। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় উচ্চ ও দীর্ঘ লম্ফ ছিল আমার প্রিয় ইভেন্ট। এই দুটোতে সব সময় পুরস্কার পেয়েছি। উচ্চমাধ্যমিকে ঢাকার সরকারি বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হলাম। কলেজের বিশাল মাঠ দেখে মন ভালো হয়ে গেল। কলেজে আমরা এক বেলা পড়তাম, এক বেলা খেলতাম। কখনো কখনো এক বেলা পড়া হয়তো বাদ যেত, কিন্তু খেলাধুলা বাদ পড়েনি কখনো!’

কলেজে বিজয় দিবসের টুর্নামেন্টে ক্রিকেট-ফুটবল দুই দলেরই অধিনায়ক ছিলেন। কিন্তু বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় কৃষ্ণ দেখেন, তাঁর পছন্দের দুটি ইভেন্টের একটিও এখানে নেই। আছে গোলক নিক্ষেপ আর দৌড়। একটু হতাশ হলেও কী ভেবে যেন গোলক নিক্ষেপে নাম লেখালেন, বিশাল ব্যবধানে হলেন প্রথম। পুরস্কার পাওয়ার আনন্দে দৌড় প্রতিযোগিতায়ও নাম দিলেন, সেখানেও পেলেন প্রথম পুরস্কার। ‘আসলে তখন ফিটনেস ভালো ছিল...আর ওই যে বললাম মাঠটার কথা, মাঠটাই আমাকে চাঙা রাখত,’ লাজুক হেসে বলছিলেন কৃষ্ণ। উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম, দ্বিতীয় দুই বর্ষেই কলেজের অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন তিনি।

২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর জগন্নাথ হলে তাঁর জায়গা হলো ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখে। ১৩ তারিখ থেকে হলের অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতা শুরু। কৃষ্ণ তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের হালচাল ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি, তাই দর্শক হিসেবে গিয়েছিলেন খেলা দেখতে। এক পূর্বপরিচিত সিনিয়র হঠাৎ বললেন, ‘এই কৃষ্ণ, তুই না কলেজে খেলায় নাম দিতি? যা, দৌড় প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে আয়।’ কৃষ্ণের পরনে তখন জিনসের প্যান্ট। এক বন্ধুর কাছ থেকে হাফপ্যান্ট ধার করে নাম দিলেন ৮০০ ও ৪০০ মিটার দৌড়ে। যথারীতি পেলেন পুরস্কার, একটাতে প্রথম, আরেকটাতে দ্বিতীয়। সেবার গোলক নিক্ষেপেও পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। বড় ভাইয়েরা এসে হলের এই নতুন বাসিন্দার পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন। এরপর একে একে কত যে পুরস্কার যোগ হয়েছে তাঁর ঝুলিতে!

২০১৫ সাল। জগন্নাথ হলে ৪০০, ৮০০, ১৫০০ ও ৫০০০ মিটারের চারটি দৌড়ের ইভেন্টেই অংশ নেন কৃষ্ণ। যেখানে একসঙ্গে চারটা দৌড়ের ইভেন্টে অংশ নিতে অনেকের সাহসেই কুলায় না, সেখানে চারটাতেই হয়েছিলেন প্রথম। এরপর দেখা গেল, আন্তহল প্রতিযোগিতায়ও ১৫০০ ও ৫০০০ মিটার দৌড়ে প্রথম অবস্থান তাঁর। এই সাফল্যের কারণে শ্রীকৃষ্ণ হালদার ও জগন্নাথ হল, খেলোয়াড় ও হল হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাথলেটিকসে রানারআপ খেতাব জিতেছিল। সেদিন রাতে প্রভোস্ট ড. অসীম সরকার জরুরি তলব করেন কৃষ্ণকে। নিজ রুমে ডেকে এনে নর্থ হলে একটা আলাদা রুমে তাঁর একা থাকার ব্যবস্থা করে দেন। কৃষ্ণের জন্য সেটা ছিল অনেক বড় উপহার।

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সব সময়ই আমাকে খেলাধুলার পাশাপাশি পড়ালেখায়ও উৎসাহ দিয়েছেন। তাঁদের উৎসাহ পেয়ে আমি পড়ালেখাটাও ঠিকমতো চালিয়ে যেতে পেরেছি, ভালো রেজাল্ট করে অনার্স শেষ করে মাস্টার্স করছি, আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ,’ বলছিলেন কৃষ্ণ। অ্যাথলেটিকস ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ক্রিকেট আর ফুটবল নিয়মিত খেলেন। গতবার আন্তবিভাগ ক্রিকেট টিমের চ্যাম্পিয়ন দলের দুর্দান্ত অলরাউন্ডার তিনি, আন্তবিভাগ ফুটবলেও তাঁর পারফরম্যান্স অনবদ্য। অ্যাথলেটিকসটা ভালোবাসেন কৃষ্ণ। সুযোগও পেয়েছিলেন জাতীয় পর্যায়ে খেলার, কিন্তু ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে সে পথে যাওয়া হয়নি। আর কদিন পরই শিক্ষাজীবন শেষ হবে। এরপর চাকরির পাশাপাশি খেলাধুলাটা চালিয়ে যেতে চান।

জগন্নাথ হলের অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতা সামনেই। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মহড়ায় তাঁকে মশাল বহন করার সম্মান দেয় হল কর্তৃপক্ষ। কে জানে, এবারের প্রতিযোগিতায়ও হয়তো শ্রীকৃষ্ণ হালদার অতীতের মতো বগলদাবা করে নেবেন একগাদা পুরস্কার!