স্বপ্নেরা ডানা মেলে...

স্থাপত্য বিভাগের দেয়ালে চোখে পড়ে শিক্ষার্থীদের তৈরি শিল্পকর্ম। ছবি: খালেদ সরকার
স্থাপত্য বিভাগের দেয়ালে চোখে পড়ে শিক্ষার্থীদের তৈরি শিল্পকর্ম। ছবি: খালেদ সরকার

ধরুন, এক ছুটির দিনে আপনি হাজির হলেন স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এসইউবি) ক্যাম্পাসে। ক্লাস বন্ধ। শিক্ষক নেই, শিক্ষার্থী নেই। চারদিক সুনসান, নীরব। তবু দর্শনার্থীর মতো ঘুরেফিরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগুলো দেখলেই সম্ভবত ক্যাম্পাসটির পরিবেশ সম্পর্কে আপনার একটা ধারণা হয়ে যাবে। দেয়ালে কত রকম পোস্টার, নোটিশ, দেয়ালিকা, ছবি, শিল্পকর্ম...বোঝা যায়, এখানে শিক্ষার্থীরা সব সময় সরব।

কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের নোটিশ বোর্ডে সাঁটানো গ্রেডের তালিকা দেখে কোনো ছাত্র যদি ঘাবড়ে যান, চাইলে স্বস্তি খুঁজতে পারেন পাশেই ঝোলানো পোস্টারে। যেখানে লেখা আছে, ‘ছোট বড় ভাই বোন, মিলেমিশে যাব বনভোজন’। ক্লাসের নোটিশ দেখে কেউ দম ফেলার ফুসরত পাচ্ছেন না? তাঁকে একটুখানি আশ্বস্ত করতে পারে গিটার আর তবলার ছবি আঁকা একখানা পোস্টার; লেখা আছে, ‘কনসার্ট—গেট রেডি ফর দ্য ব্লাস্ট’। সাংবাদিকতা বিভাগের দেয়ালে চোখে পড়ল নানা রকম দেয়ালিকা, ইতিহাস, ঐতিহ্যের চিত্র। সেখানে পাশাপাশি শোভা পাচ্ছে আমাদের দেশের শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হান ও যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ উইলবার শ্র্যামের ছবি। স্থাপত্য বিভাগে ঢুঁ মারলে আপনি চমকে যাবেন নিশ্চিত। ভাববেন, ভুল করে কোনো চিত্রকলার প্রদর্শনীতে চলে এলাম না তো! শিক্ষার্থীদের তৈরি রঙিন শিল্পকর্মগুলো আপনাকে বিভ্রান্ত করতেই পারে।

গত বুধবার আমরা যখন স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ধানমন্ডি ও কলাবাগান ক্যাম্পাস ঘুরে দেখছিলাম, তখন অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় খোলাই ছিল। গিটারের টুংটাং থেকে শুরু করে টেবিল টেনিসের টুকটাক, ক্লাসের ভেতর মাপা আলোচনা কিংবা ক্লাসের বাইরের চাপা হইচই—সবই আমাদের কানে এল।

 আমরা সবাই রাজা

‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগই সেরা।’

ফার্মাসি বিভাগের এথিনা রহমান, মীর জুবায়ের হোসেন ও উর্মি হালদার যেভাবে জোর গলায় এই দাবি করলেন, আমরা মোটামুটি মেনে নিয়েছিলাম, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে বোধ হয় ফার্মাসি বিষয়ের পড়ালেখাই সবচেয়ে ভালো হয়। কিন্তু বিভ্রান্তিতে ফেলে দিলেন বিবিএর শিক্ষার্থী উর্মি দাস, সাব্বির হোসেন ও কুহিলী ইসলাম। কলাবাগান ক্যাম্পাসের লিফট দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে তাঁরা দাবি করলেন, ‘এখানে বিবিএ-ই সবচেয়ে ভালো।’ এথিনারা বলেছিলেন অত্যাধুনিক গবেষণাগারের কথা। অন্যদিকে উর্মিদের ট্রাম্পকার্ড—ভালো শিক্ষক। ফার্মাসির ক্লাস হয় ধানমন্ডিতে আর বিবিএর ক্লাস কলাবাগানে। নইলে দুই দলকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে একটা বিতর্কের আয়োজন করা যেত!

এসইউবিতে মোট ১০টি বিভাগে পড়ার সুযোগ আছে। স্থাপত্য, ব্যবসায় শিক্ষা, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল, ইংরেজি, পরিবেশবিজ্ঞান, খাদ্য প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, আইন, ফার্মাসি, গণস্বাস্থ্য এবং সাংবাদিকতা, যোগাযোগ ও গণমাধ্যম শিক্ষা। সবগুলো বিভাগের শিক্ষার্থীরাই বোধ হয় নিজেদের সেরা বলে দাবি করবেন। অন্তবিভাগ বিতর্ক কিংবা খেলাধুলার প্রতিযোগিতায় এই শিক্ষার্থীরা অবশ্য নিয়মিত নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সুযোগ পান।

ধানমন্ডি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা
ধানমন্ডি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা

পড়ালেখায় ছাড় নেই

স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বিশেষায়িত স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজ চলছে কাঞ্চনে, জায়গাটা রাজধানীর পূর্বাচলের কাছাকাছি। এ বছরের শুরু থেকে সেখানে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল। কর্তৃপক্ষ জানাল, বিভিন্ন জটিলতার কারণে তাদের ‘নতুন ক্যাম্পাসযাত্রা’ একটু বিলম্বিত হচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে, আগামী সেমিস্টার থেকে সেখানে ক্লাস শুরু হবে।

ক্যানটিন, সিঁড়ি, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে চানু মামার চায়ের দোকান...আপাতত এসব জায়গায় আড্ডা জমে শিক্ষার্থীদের। শহরের কোলাহলের মাঝখানে, ইট-কাঠ-পাথরের এই ক্যাম্পাসের সঙ্গে অনেকটা মায়া জড়িয়ে আছে। তবু শিক্ষার্থীরা নতুন ক্যাম্পাসের বিশাল খেলার মাঠ আর অত্যাধুনিক ক্লাসরুমগুলো বরণ করে নেওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির উপাচার্য মো. সাঈদ সালাম। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের কিছু সীমাবদ্ধতার কথা মেনে নিয়েই বললেন, ‘পড়ালেখার মান আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা।’ জানালেন, অভিজ্ঞ শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে এখানে প্রতিটি বিভাগের পাঠ্যক্রম সাজানো হয়েছে। বিভাগীয় প্রধানের পাশাপাশি প্রতিটি বিভাগের একজন করে উপদেষ্টা আছেন। ক্লাসের পাশাপাশি নিয়মিত সভা, সেমিনার, কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। গবেষণাকে উদ্বুদ্ধ করতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় জার্নাল।

স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, স্থাপত্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বিভাগটি বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের স্বীকৃতি পেয়েছে। হাতে-কলমে শিক্ষার ওপরই বেশি জোর দেওয়া হয় স্থাপত্যের পড়ালেখায়। পড়ালেখার অংশ হিসেবেই শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘুরে দেখেন। অন্যদিকে সাংবাদিকতার ছাত্রছাত্রী যাঁরা, তাঁরাও এখন থেকেই কর্মজীবনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন পুরোদমে। শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত বের হচ্ছে দুটি পত্রিকা—বিজয় ও পঞ্চম। নতুনকিছু ডটকম নামে একটি অনলাইন পত্রিকাও পরিচালিত হচ্ছে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের সাংবাদিকতা, যোগাযোগ ও গণমাধ্যম বিভাগের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে।

সামনে ফার্মা ফেস্ট, তাই নিয়ে চলছে ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষার্থীদের আলোচনা
সামনে ফার্মা ফেস্ট, তাই নিয়ে চলছে ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষার্থীদের আলোচনা

সরব সারাক্ষণ

বিভাগগুলোর মধ্যে যে নিজেদের সেরা প্রমাণ করার একটা প্রতিযোগিতা আছে, সে কথা আগেই বলেছি। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাঁরা সারা বছর ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন। কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ কদিন আগে আয়োজন করেছিল আন্তবিশ্ববিদ্যালয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা। ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২০টি দল অংশ নিয়েছিল সেখানে।  আমরা যখন ক্যাম্পাস ঘুরে দেখছি, তখন চোখে পড়ল, চলছে ফার্মাসি বিভাগের ‘ফার্মা ফেস্ট’-এর প্রস্তুতি। বিতর্ক, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাচ-গান, খেলাধুলা...বিশ্ববিদ্যালয়ের  বিভিন্ন বিভাগ ও ক্লাবগুলোর নেতৃত্বে একের পর এক আয়োজন চলছেই। সম্প্রতি ‘শ্রুতি’ নামে একটি প্রকল্প চালু হয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের গান ও গিটার শেখাবেন সংগীতশিল্পী আগুন। এ ছাড়া উচ্চারণ ও আবৃত্তির প্রশিক্ষণ দেবেন আবৃত্তিশিল্পী শিমুল মুস্তাফা।

এত সব আয়োজন আছে বলেই হয়তো স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের সাবেক শিক্ষার্থীরা এখনো তাঁদের ক্যাম্পাস-জীবন মিস করেন। সাবেকেরা মিলে এরই মধ্যে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তুলেছেন। যেখানে সদস্যসংখ্যা প্রায় ১২ হাজারের বেশি। অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারি মো. ইব্রাহীম ভূঁইয়া একটি ওষুধ প্রতিষ্ঠানের ‘হেড অব প্রোডাকশন’-এর দায়িত্বে আছেন। কাজের চাপের মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেন সব সময়। বলছিলেন, ‘দুটো কারণে আমরা অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন করেছি। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা যেন থাকে। দ্বিতীয়ত, স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের যেন একটা কমিউনিটি গড়ে ওঠে। আমরা এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করি। গরিব ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি দিই। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাইবোনদের চাকরি বা ব্যবসার ক্ষেত্রেও আমরা সব রকম সাহায্য করতে চেষ্টা করি।

শিক্ষার্থীরা যেন বড় স্বপ্ন দেখে