দক্ষিণের এক বাতিঘর

এই ক্যাম্পাস সত্যিকার অর্থেই শিক্ষার্থীদের প্রাণ। ছবি: মঞ্জুরুল মোর্শেদ
এই ক্যাম্পাস সত্যিকার অর্থেই শিক্ষার্থীদের প্রাণ। ছবি: মঞ্জুরুল মোর্শেদ

মেহগনি আর শিরীষগাছের সারি যে রাস্তাটায়, সেখান থেকে উত্তরের ভবনগুলোর দিকে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছেন সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের কয়েকজন ছাত্র। তাঁদের হাতে সময় খুব কম। দুই ক্লাসের মাঝের বিরতিতে তাঁরা টেবিল টেনিস খেলবেন। তাঁদের মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এস এম বায়জিদ আর হিসাববিজ্ঞানের সালমান খান—দুজনই দুর্দান্ত টেবিল টেনিস খেলেন। কে বেশি ভালো খেলেন, তার একটা হেস্তনেস্ত হবে আজ!

ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ ভবনে খেলা জমে উঠল। প্রথম রাউন্ডে জিতে গেলেন সালমান, দ্বিতীয় রাউন্ডে জয় বায়জিদের। তৃতীয় রাউন্ডে খেলাটা আর দুজনের মধ্যে থাকল না, হয়ে গেল রাষ্ট্রবিজ্ঞান বনাম হিসাববিজ্ঞানের টক্কর। তুমুল উত্তেজনায় খেলা চলল।

কলেজের মূল ভবনের সামনে বড় এক দিঘি। দিঘির পাড় ঘেঁষা গাছগুলো বড় মায়ায় ছায়া দিয়ে রেখেছে। হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সুপান্থ হালদার এখানে দাঁড়িয়ে দিঘিতে ঢিল ছুড়ছিলেন, তিনি বললেন, ‘আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসটা এই জলের মতোই শান্ত। সবাই এখানে মিলেমিশে থাকে। কলেজে মসজিদ যেমন আছে, মন্দিরও আছে। এখানে আমরা শুধু পড়াশোনা করি না, একে অন্যের উৎসবে, একে অন্যের প্রয়োজনে পাশে গিয়ে দাঁড়াই।’

কলেজের দক্ষিণ দিকের মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। দখিনা বাতাসের জোর যে বাড়ছে, এখানে এলে খুব বোঝা যায়। তাঁদের আড্ডাও চলছে বাতাসের বেগে। কয়েক দিন আগে শেষ হওয়া কলেজের ফুটবল টুর্নামেন্ট যে এখনো শেষ হয়নি, আড্ডায় কান পেতে বোঝা গেল। এই টুর্নামেন্ট নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক মো. রাব্বি ইসলামের আফসোস কিছুতেই যাচ্ছে না। সামান্য কিছু ভুলের জন্য সেমিফাইনাল থেকে তাঁদের এবার বাদ পড়তে হয়েছে। রাব্বি জানালেন, ‘আমাদের কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি সব ধরনের খেলাধুলা হয় নিয়মিত।’ আগামীবার চ্যাম্পিয়নের ট্রফিটা যে হাতছাড়া করতে রাজি নন, কথার শেষে সেই প্রত্যয়ও জুড়ে দিলেন।

১৯৫৭ সালে পিরোজপুর সদরে স্থাপিত এই কলেজটি সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়েছে। শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট যেমন দিনে দিনে ভালো হয়েছে, তেমনি সমৃদ্ধ হয়েছে পাঠাগার ও গবেষণাগার। প্রায় ১১ একর আয়তন নিয়ে গড়ে ওঠা বিশাল এই ক্যাম্পাসে উচ্চমাধ্যমিক ছাড়াও ১৪টি বিষয়ে স্নাতক পড়ার সুযোগ আছে। স্নাতকোত্তর আছে ৮টি বিষয়ে। এখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্নাতকোত্তরের ছাত্র রক্তিম ঢালী। তাঁকে পাওয়া গেল শহীদ মিনার চত্বরে। খুব মনোযোগ দিয়ে তিনি মুঠোফোনে কী যেন দেখছেন। জানালেন, ক্যাম্পাসের এই অংশ ওয়াই-ফাই জোনের আওতায়। তাই ক্লাস বাদে অন্য সময়টুকু এখানেই বসা হয়। দেখা গেল অনেক শিক্ষার্থী বাড়ি ফেরার আগে এখানে বসে ইন্টারনেটের প্রয়োজনীয় কাজটুকু সেরে নিচ্ছেন।

গণিত বিভাগের সামনে পাওয়া গেল মো. শওকত ওসমানকে। এ কলেজ থেকে তিনি গণিতে স্নাতক করেছেন। এখন আছেন স্নাতকোত্তরের অপেক্ষায়। সাহিত্যে না পড়লেও বাঙালির উৎসব নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। কলেজে কী কী উত্সব হয় জানতে চাইলে একটানা বললেন, রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী, বর্ষবরণ, পিঠা উৎসব, বসন্ত উৎসব—সব মিলিয়ে সারা বছর কোনো না কোনো অনুষ্ঠান চলছেই। বাংলা বিভাগের সামনে দেখা এইচ এম নাঈমের সঙ্গে। তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতক করছেন। বললেন, ‘আমাদের এখানে সংস্কৃতিচর্চাটা নিয়মিতই হয়। কলেজ থেকে ম্যাগাজিন বের হয়। ছাত্ররা সেখানে খুব আগ্রহ নিয়ে লেখে। সত্যিকার অর্থেই কলেজটা আমাদের প্রাণের কলেজ।’

ছাত্র সংসদ ভবনটি কলেজ ক্যাম্পাসের ঠিক মাঝখানে। সেখানে দেখা হলো বর্তমান ভিপি এস এম বায়জিদের সঙ্গে। তাঁর বক্তব্য, ‘কলেজে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক খুব ভালো। যেকোনো প্রয়োজনে আমরা শিক্ষকদের কাছে পাই। তবে আমাদের একটা সমস্যা হলো, কলেজে কোনো ক্যানটিন নেই। অনেক দূর থেকে ছাত্ররা এখানে পড়তে আসে। সামান্য কিছু খেতে হলেও তাদের আবার শহরেই ছুটতে হয়।’

সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজে আছে দক্ষ একটি স্কাউট দল। আছেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) এবং রেড ক্রিসেন্টের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের মতো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তাঁরা জেলা প্রশাসনকে সাহায্য করেন। রেড ক্রিসেন্টের সঙ্গে যুক্ত এইচ এম শিবলী রহমান বলেন, ‘দেশের দক্ষিণ অংশ যখন সিডরের আঘাতে প্রায় ভেঙে পড়েছিল, আমাদের কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের সাহায্যের জন্য সবটুকু নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা মানুষের পাশে থাকি।’ এই কলেজের শিক্ষার্থীরা মানুষের পাশে থাকবেন না-ই বা কেন, কলেজের প্রধান ভবনেই তো বিরাট হরফে লেখা ‘জ্ঞানের সন্ধানে এসো, জ্ঞান অর্জন করো, দেশের সেবা করো’।

সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. দেলোয়ার হোসেন কলেজ নিয়ে তাঁর সন্তুষ্টির কথাই জানালেন। বললেন, ‘কলেজটিতে ১০ হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী পড়ছে। ছাত্র এবং অভিভাবকদের আস্থার কারণে দেশের দক্ষিণ অংশের অন্যান্য জেলা থেকেও ছাত্ররা এখানে পড়তে আসে।’ সন্তুষ্টির সঙ্গে খানিকটা আফসোসের কথাও তিনি জানালেন। এখানে ৬৩টি শিক্ষকের পদে কর্মরত আছেন মাত্র ৪১ জন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৪৩টি পদ আছে, অথচ কাজ করছেন মাত্র ৮ জন।