তারাদের সঙ্গে তিন দিন

আর্চারি ছিল সবচেয়ে মজার অভিজ্ঞতা
আর্চারি ছিল সবচেয়ে মজার অভিজ্ঞতা

উচ্চতাটা খুব বেশি নয়। দোতলা সমান হবে। অথচ মনে হচ্ছিল পায়ের নিচে মাটিটা কত দূরে!

৮ মার্চ, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের ডিইএ (দ্য ডিউক অব অ্যাডিনবার্গ অ্যাওয়ার্ড) ক্লাব থেকে আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম গাজীপুরের বেস ক্যাম্পে। এক গাছ থেকে আরেক গাছে, দড়িতে ঝুলে (জিপ লাইনিং) খাল পার হতে হয়েছে। ছোটবেলা থেকে আমার উচ্চতাভীতি আছে। ভয় পেয়েছি ঠিকই, তবে পাখির মতো ওড়ার যে স্বপ্নটা ছোটবেলা থেকে দেখেছি, সেটা বোধ হয় একটু হলেও পূরণ হয়েছে। বেস ক্যাম্পে আমাদের বেশ কয়েকটি কার্যক্রমের মধ্যে এই জিপ লাইনিং ছিল অন্যতম।

জায়গাটা ঢাকার যান্ত্রিকতা থেকে একেবারে আলাদা। খোলা আকাশের নিচে তাঁবুতে থাকা, রাতে সবাই একসঙ্গে বসে আগুন জ্বালিয়ে গান আর আড্ডা—সবকিছুর মধ্যে বিশেষ আকর্ষণ ছিল আকাশভরা তারা। অবাক হয়ে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, একটাই তো আকাশ, ঢাকায় বসে তারা দেখা যায় না কেন! হয়তো ঢাকায় আমাদের আকাশ দেখার সময়ই হয় না! অথচ বেস ক্যাম্পে, খোলা মাঠে শুয়ে তারা দেখেই কেটে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

বাকি কার্যক্রমগুলোর কথাও বলি। আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল আর্চারি, অর্থাৎ তির নিক্ষেপ। জীবনে প্রথমবার তিরের নিশানা করতে গিয়ে আমার হাত কাঁপছিল থরথর করে। হঠাৎ পাশ থেকে কে যেন বলল, ‘চিপসের প্যাকেট যেভাবে খোলে, সেভাবে টেনে ধরো। তির আর নিশানা সমান লাইনে রেখে ছেড়ে দাও।’ আমি ঠিক তা-ই করলাম। ব্যস! সিরিয়াল মতো তিন নম্বর গোলটাতেই তিনবার লাগল, আর পেয়ে গেলাম ১৫-তে ৯। মনে মনে নিজেকে রবিনহুড কিংবা ডিসি কমিকসের সুপারহিরো ‘অ্যারো’ ভাবতে মন্দ লাগছিল না।

একটা ‘ভয়ংকর মজার’ পর্বের নাম ছিল ‘ট্রি টপ অ্যাকটিভিটি’। আগেই বলেছি, আমার উচ্চতাভীতি আছে। অতএব গাছে চড়া ব্যাপারটা ‘ভয়ংকর’ তো বটেই। কিন্তু এই পদ্ধতিতে গাছে ওঠার নিয়মটা ভিন্ন বলে মজাও পেয়েছি বেশ। গাছগুলোর মাঝে মাঝে কাঠের তক্তা দিয়ে ঝুলন্ত সাঁকো বানানো আর সেই সাঁকো ধরেই বিভিন্ন কায়দা করে পুরোটা পথ পাড়ি দিতে হয়। আমাদের সঙ্গে যথেষ্ট নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল, তবু পাঁচ ফুট এক ইঞ্চি উচ্চতার এই আমি লাফিয়ে লাফিয়ে দড়ি ধরতে গিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারিনি। মাঝপথে ঝুলন্ত সাঁকো থেকে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম। এরপরে আমাকে উদ্ধার করার কাহিনি আর না-ই বলি।

ক্যাম্পের কার্যক্রমের কথা তো অনেক হলো, এবার আমার সঙ্গীদের কথা বলি। সংখ্যায় আমরা ছিলাম ৬০ জনের বেশি। ছোটবেলা থেকে ‘অ্যাডভেঞ্চার’-এর প্রতি একধরনের আগ্রহ আছে। তাই যখনই শুনেছি ক্যাম্পিংয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, দ্বিতীয়বার না ভেবে এত্তগুলা অপরিচিত মানুষের সঙ্গে চলে গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে ভাবিনি এই অপরিচিত মানুষগুলোর মধ্যেই একটা পরিবার খুঁজে পাব। ক্লাবে সবার ছোট হওয়ায় আদরটাও তুলনামূলক বেশি পেয়েছি। এই মানুষগুলোর জন্যই ফোন ব্যবহার করার কথা একদম ভুলে গিয়েছিলাম। এমনকি ‘আই মিস ঢাকা’ লিখে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ারও প্রয়োজন পড়েনি। এদের সঙ্গেই একটামাত্র দোলনাতে চড়ার জন্য ঝগড়া করেছি, আবার একজন আরেকজনের কর্মকাণ্ডের সময় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উৎসাহ দিয়েছি। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকা সত্ত্বেও দিন শেষে একসঙ্গে গান গেয়েছি।

আগেই বলেছি, আমরা সবাই আইইউবির ডিইএ ক্লাবের সদস্য। এটি একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের অংশ। সারা পৃথিবীতে প্রায় ১৬৬ দেশে ডিইএ ক্লাব আছে। বাংলাদেশে আইইউবি ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে এই সংগঠন। আমাদের এই ক্লাব প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শেখার সুযোগ করে দেয়। ক্লাব থেকেই গোল্ড, সিলভার ও ব্রোঞ্জ—তিনটি ধাপে সম্মাননা দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতি ধাপে বিভিন্ন পুরস্কার দিয়ে উৎসাহিত করা হয়।

লেখক: ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী