বুয়েটের চার প্রথমের সারকথা

>

বাঁ থেকে শোয়াইব, অনিক, আসিফ ও কৌশিক। ছবি: সুমন ইউসুফ
বাঁ থেকে শোয়াইব, অনিক, আসিফ ও কৌশিক। ছবি: সুমন ইউসুফ

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পড়ার স্বপ্ন নিয়ে যাঁরা বড় হয়েছেন, এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়েছেন, আগামী ৭ অক্টোবর তারিখটা তাঁদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আসছে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা। এই পরীক্ষা সামনে রেখে চার তরুণের সঙ্গে আড্ডায় বসেছিলাম আমরা। গত চার বছরের ভর্তি পরীক্ষায় তাঁরা প্রথম হয়েছেন—২০১৪ সালে অনিক সরকার, ২০১৫ সালে শোয়াইব আহমেদ, ২০১৬ সালে মো. আসিফ ইকবাল এবং ২০১৭ সালে কৌশিক রায়। সঙ্গে ছিলেন মোস্তফা মনোয়ার

পরীক্ষা নিয়ে আড্ডা। এদিকে আপনাদেরও তো টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। কথা বলতে আর ছবি তুলতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যাবে। সমস্যা হবে না তো?

কৌশিক রায়: না, সমস্যা নেই। তবে একটু তাড়াতাড়ি শেষ হলে ভালো হয়।

হাতে আর এক মাসও সময় নেই। পরীক্ষার্থীদের জন্য এই সময়ে কোন পরামর্শটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে মনে করেন?

অনিক সরকার: আমার কাছে মনে হয়, সবার আগে দরকার হলো সুস্থ থাকা। নিজের খেয়াল রাখতে হবে, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে, নিজেকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিতে হবে, পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে হবে। অসুখ বাঁধিয়ে বসলে যদি একটা দিন নষ্ট হয়, সেটা অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।

মো. আসিফ ইকবাল: যা যা পড়ার আছে, সেগুলো এত দিনে পড়ে ফেলার কথা। নতুন কিছু আর ওভাবে পড়ার দরকার নেই। বরং যা যা পড়া হয়েছে, সেগুলোই ভালো করে ঝালিয়ে নিতে হবে। যে ধরনের অঙ্কগুলোতে বারবার আটকে যায় কেউ, যেসব বিক্রিয়া, সূত্র, গ্রাফে মনে হয় দুর্বলতা আছে কিংবা মনে থাকে না, সেগুলো খাতায় বারবার করতে হবে।

শোয়াইব আহমেদ: মূল পরামর্শগুলো বাকিরা মোটামুটি বলে ফেলেছে। এর বাইরে একটা কথা বলতে পারি। গণিত, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান—তিন বিষয়ের মোট ছয়টা পত্র। কোন বিষয়ের কোন পত্রে কয়দিন করে সময় দেব, সেটা মাথায় রেখে একটা রুটিন করে নেওয়া যেতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, ঘুরেফিরে আমি একই বিষয় বারবার পড়ছি, অন্য একটা বিষয়ে ঠিকমতো প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে না। এটা যেন না হয়।

গণিত, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান—তিনটি বিষয়ের মধ্যে কোনটার উত্তর দেওয়া আগে শুরু করা উচিত?

কৌশিক: এই প্রশ্নের উত্তর একেকজন একেক রকম দেবে। কেউ বলবে গণিত, কেউ রসায়ন, কেউ বলবে পদার্থবিজ্ঞান। কারও কথা শোনার দরকার নেই। যে যেটা সবচেয়ে ভালো পারে, সেটা দিয়েই আগে শুরু করা উচিত। কোন বিষয়ে একজন বেশি পারদর্শী আর কোন বিষয় তার দুর্বলতা, তার নিজের চেয়ে বেশি নিশ্চয়ই আর কেউ জানে না।

ধরুন যে বিষয়টা আমি ভালো পারি, সেটার প্রশ্নগুলো একটু কঠিন মনে হলো। তাহলে?

কৌশিক: প্রথমে সহজ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে ফেলতে হবে। তিন ঘণ্টায় একজন পরীক্ষার্থীকে উত্তর করতে হবে মোট ৬০টা প্রশ্ন। একেকটির জন্য সে পাবে তিন মিনিট সময়। প্রথমেই পুরো প্রশ্নের খুঁটিনাটিসহ পড়ে সহজ প্রশ্নগুলো বাছাই করে নিতে হবে। দেখা যাবে অনেকগুলো উত্তর করতে তিন মিনিটও লাগেনি। পরের প্রশ্নগুলোর জন্যে বাড়তি সময় পাওয়া গেল, তাতে চাপ কম থাকবে। কোনো প্রশ্নে আটকে গেলে সেটা ফেলে সামনে এগোতে হবে। কোনো প্রশ্নে বেশিক্ষণ সময় নষ্ট করা যাবে না। এটা খুবই কমন একটা ভুল, অনেকেই ব্যাপারটা জানা সত্ত্বেও এই ভুল করে। কঠিন জিনিসে বেশি সময় দিয়ে সহজ প্রশ্নগুলো আর উত্তর করতে পারে না।

পরীক্ষার আগের রাতে কীভাবে পড়া উচিত? আপনারা কীভাবে পড়েছিলেন?

শোয়াইব: তিনটা বিষয়ের দুইটা পত্র মিলে মোট ছয়টা পত্রের সব আসলে কেউ চাইলেও পরীক্ষার আগের রাতে পড়তে পারবে না। যতটুকু পড়ার, আগেই পড়া হয়ে যাবে। পরীক্ষার আগের রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানো উচিত, বেশি পড়ার দরকার নেই। যে জিনিসগুলো অনেকটা মুখস্থ রাখাই লাগে, সেগুলো একবার করে দেখে নেওয়া যেতে পারে।

তিনটা বিষয়ের মধ্যে কোনটা একটু অন্য রকম? কোনটা ভালোমতো পড়লে সুবিধা পাওয়া যাবে?

অনিক: আমার মনে হয়, ব্যবধান গড়ে দিতে পারে রসায়ন। কেন জানি সবাই গণিত আর পদার্থবিদ্যা—এই দুইটা বিষয়ের ওপর অনেক জোর দিলেও রসায়নের ওপর দেয় না। অথচ প্রতিটা বিষয়েই আছে ২০০ নম্বর। রসায়নের প্রস্তুতিটা একটু ভালো হলেই কিন্তু একজন এগিয়ে যেতে পারে।

পরীক্ষার প্রশ্ন খুব কঠিন হলে অনেকেই দেখা যায় নার্ভাস হয়ে যায়...

আসিফ: পরীক্ষায় নিজের সর্বোচ্চটা দিতে হবে। প্রশ্ন সহজ হতে পারে, কঠিনও হতে পারে। মনে রাখতে হবে, যে প্রশ্নটা কঠিন, সেটা সবার জন্য কঠিন। তুমি কম নম্বর পেলে বাকিরাও কম নম্বর পাবে। অনেকে ভয় পেয়ে যায়, পারা জিনিসও ভুল করে ফেলে।

উত্তর লেখার সময় আর কী কী মাথায় রাখা দরকার?

অনিক: পারশিয়াল মার্কিং একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো প্রশ্নের বা অঙ্কের উত্তর যদি পুরোটা না জানি তাহলে একেবারে উত্তর না করার চেয়ে প্রশ্ন-সম্পর্কিত বিষয় সম্পর্কে যতটুকু প্রাসঙ্গিক ধারণা আছে, সেটুকুই লেখা উচিত। পুরো নম্বর না পেলেও তখন কিছু নম্বর পাওয়া যায়।

শোয়াইব: উত্তরপত্রে লেখার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। পরীক্ষার হলে আলাদা করে প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র দেওয়া হবে না। প্রশ্নের নিচে যতটুকু অংশ ফাঁকা থাকে, সেখানেই লিখতে হবে। এই জায়গাটাও অবশ্য একেবারে কম না। উত্তর বেশি বড় হলে তিন কলামে লেখা যায়, তাহলে আর সমস্যা হবে না।

আসিফ: ক্যালকুলেশন স্পিড বাড়াতে হবে, কিন্তু দ্রুত ক্যালকুলেট করতে গিয়ে ভুল করা যাবে না। একটু তাড়াতাড়ি হিসাব করতে পারলে অনেকটা সময় বেঁচে যাবে। এই দিকটাতে নজর রাখা উচিত। আর ক্যালকুলেটর ব্যবহারের সময় ক্যালকুলেটর কোন মোডে আছে সেটা খেয়াল রাখতে হবে।

সাধারণত কোন কোন বিষয় থেকে প্রশ্ন আসে, সে সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায় কীভাবে?

কৌশিক: বুয়েটের আগের বছরের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নগুলো সমাধান করে নেওয়া উচিত অবশ্যই। বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় কোন ধরনের প্রশ্ন বেশি আসে সে সম্পর্ক ধারণা পাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় এটাই। তারপর সে বিষয়গুলো বারবার করে পড়া উচিত। আগের বছরের প্রশ্নগুলোতে নিজে নিজে বাসায় পরীক্ষা দেওয়াটা কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার ভালো একটা প্রস্তুতি।

আপনারা তো প্রথম হয়েছেন। আপনাদের আত্মবিশ্বাসের জায়গাটা কী ছিল?

অনিক: পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিত—তিনটা বিষয়েই ধারণা ভালো ছিল। জানতাম, যে জায়গা থেকে প্রশ্ন আসুক পারব।

শোয়াইব: আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলাম নিজের জীবনের সেরা পরীক্ষাটা দেব। এর চেয়ে ভালো পরীক্ষা আর দেওয়াও সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে, যা ভেবেছিলাম তা সত্য হয়েছিল।

আসিফ: জানতাম আমি পদার্থবিজ্ঞান ভালো পারতাম। আর এটা আমাকে এগিয়ে রাখবে।

কৌশিক রায়: আমার ব্যাপারটাও অনিকদার মতো। জানতাম যেকোনো জায়গা থেকে প্রশ্ন এলেই পারব, তাই আত্মবিশ্বাস ছিল।

তাহলে আত্মবিশ্বাসটা জরুরি?

অনিক: অবশ্যই। বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা অনেকটাই নির্ভর করে একজন পরীক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাসের ওপর। কেবল পরীক্ষার হলে আত্মবিশ্বাসী থাকতে হবে শুধু তাই না, এই আত্মবিশ্বাস আগে থেকে রপ্ত করতে হবে। বাকিটা পরিশ্রমেই হয়ে যাবে।


পরীক্ষার মধ্যেও আপনারা অনেকটা সময় দিয়েছেন। ধন্যবাদ।