টিএসসিতে রাজ্জাক, কবরী, শাবানাদের মুখ

৬ দিনব্যাপী এই আয়োজনে মাত্র ৩০ টাকার টিকিটের বিনিময়ে দেখানো হয় দুই বাংলার ২০টি ধ্রুপদি ও সমসাময়িক চলচ্চিত্র। ছবি: সংগৃহীত
৬ দিনব্যাপী এই আয়োজনে মাত্র ৩০ টাকার টিকিটের বিনিময়ে দেখানো হয় দুই বাংলার ২০টি ধ্রুপদি ও সমসাময়িক চলচ্চিত্র। ছবি: সংগৃহীত

১০ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে ১৮তম বারের মতো অনুষ্ঠিত হলো ‘আমার ভাষার চলচ্চিত্র’ নামের মহাযজ্ঞ। বাংলালিংকের সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ আয়োজন করেছিল এই উৎসব।

প্রস্তুতিপর্ব

উৎসব শুরু হওয়ার তিন দিন আগে টিএসসির দোতলায় চলচ্চিত্র সংসদের জন্য বরাদ্দ করা রুমটিতে গিয়ে দেখা গেল, জনা বিশেক সদস্য সবাই গোলটেবিল বৈঠকে ব্যস্ত। উৎসবে কী কী ছবি দেখানো হবে, কার কী দায়িত্ব, কত টাকা টিকিট ধরা যায় ইত্যাদি খুঁটিনাটি আলোচনায় সাদা কাগজে একবার লেখা হচ্ছে তো আরেকবার কাটা হচ্ছে। এভাবেই উৎসবমুখর পরিবেশে এগিয়ে চলছিল উৎসবের প্রস্তুতি।

সাজ সাজ রবে টিএসসি

এমনিতেই টিএসসি সব সময় ছাত্র আর অছাত্রদের পদচারণে মুখর থাকে। ভাষার মাসে বইমেলা, ফাল্গুন, ভ্যালেন্টাইনস ডেসহ একটার পর একটা উৎসব লেগেই আছে। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘আমার ভাষার চলচ্চিত্র’ উৎসব। টিএসসির মাঠে, আনাচকানাচে প্রায় অর্ধশতাধিক সিনেমার পোস্টারে উঁকি দিচ্ছে রাজ্জাক, করবী, শাবানাদের মুখ। আয়োজনটা দেখতে গিয়ে দেখলাম সেসবের সঙ্গে একা কিংবা দলীয় সেলফি তোলায় মত্ত অনেক তরুণ-তরুণী। সিনেমার পোস্টারের ফাঁকে ফাঁকে আবার হীরালাল সেন, মৃণাল সেন, আনোয়ার হোসেন, সাইদুল আনাম টুটুল বা আমজাদ হোসেন প্রমুখ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বর সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরা হয়েছে দর্শকদের সামনে। হীরালাল সেন নির্মিত সব চলচ্চিত্রের (৪০টিরও বেশি) ফিল্মের রিল দুর্ঘটনাবশত স্টুডিওতে পুড়ে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পড়তে পড়তে আফসোস করতে দেখা গেল একজন দর্শককে।

উৎসবে প্রদর্শিত চলচ্চিত্র

৬ দিনব্যাপী এই আয়োজনে ৩০ টাকার টিকিটের বিনিময়ে দেখানো হয় দুই বাংলার ২০টি (১৬টি পূর্ণদৈর্ঘ্য, ৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্য) ধ্রুপদি ও সমসাময়িক চলচ্চিত্র। এগুলোর মধ্যে দেবী, মাটির প্রজার দেশে, স্বপ্নজাল, মার্সিলেস মেয়হ্যাম, তিতাস একটি নদীর নাম, খুঁটি, চারুলতা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে সদ্য প্রয়াত আনোয়ার হোসেন, মৃণাল সেন, সাইদুল আনাম টুটুল এবং আমজাদ হোসেনকে সম্মান জানিয়ে ১১ ফেব্রুয়ারি প্রদর্শিত হয় নদীর নাম মধুমতি, আকালের সন্ধানে, আধিয়ার এবং ভাত দে।

খুদে ভিক্ষুক যখন দর্শক

পাঠশালা দেখব বলে টিএসসির গেটের পাশে টিকিট কাউন্টারের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় ৬–৭ বছরের একটা ছেলে এসে বলল, ‘আপা, আমিও বই দেখুম, একটা টিকিট কিন্যা দ্যান?’ ভাবলাম ভালোই তো, পাঠশালা সিনেমাটাও তো ওর মতোই একজন শিশুশ্রমিকের ওপর নির্মিত। দুজনে ঢুকলাম হলে। হাউসফুল না হলেও দর্শকের কমতি ছিল না। কথায় কথায় জানলাম ওর নাম রাকিব। চার ভাইবোনের মধ্যে সে মেজো, বাবা নেই, মা টোকাই। বাবা কই জিজ্ঞেস করলে হাত নেড়ে এমন ভঙ্গি করল, যার অর্থ ‘কে জানে’! কী করো? প্রশ্ন করতেই ঝটপট উত্তরটি এল, ‘ভিক্ষা’। সিনেমাটা কেমন লাগছে বা মানিকের (চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র) মতো তারও লেখাপড়া করতে ইচ্ছা করে কি না, এসব জিজ্ঞেস করব, তার আগেই কোনো এক টিভি চ্যানেলের লোক সাক্ষাৎকার নেবে বলে রাকিবকে ধরে নিয়ে গেল, আর তার দেখা মিলল না।

হীরালাল সেন পুরস্কার

এ বছর নূর ইমরান পরিচালিত কমলা রকেট এই পুরস্কার জিতে নেয়। জুরিবোর্ডে ছিলেন মানজারে হাসিন, জাহিদুর রহিম অঞ্জন, নাদির জুনাইদ এবং লাইলুন নাহার। ১৩ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৫টায় টিএসসির সবুজ মাঠে হলুদ-কমলা শাড়ি-পাঞ্জাবিতে বসন্ত বরণ করতে আসা দর্শকদের সামনে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের কাছ থেকে ছবিটির প্রযোজক (ইমপ্রেস টেলিফিল্ম) ও চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর পুরস্কার গ্রহণ করেন। পুরস্কার হাতে নিয়েই খানিক স্মৃতিকাতরতা আর অনেকখানি উচ্ছ্বাস নিয়ে যে তথ্যটি দিলেন, সেটি অনেকের কাছেই অজানা। চাইলে বিসিএস প্রার্থীরাও টুকে রাখতে পারেন, বাংলাদেশ থেকে প্রথম যে চলচ্চিত্রটি নেটফ্লিক্সে স্থান পায়, সেটি এই কমলা রকেট। পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ মিটিমিটি হাসছিলেন ছবির পরিচালক। ২০১৭ সাল থেকে শুরু করে এ বছর তৃতীয়বারের মতো প্রদান করা হলো উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকারের নামানুসারে ‘হীরালাল সেন পুরস্কার’। এটি এই উৎসবের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্ব।

পুরো আয়োজনটির প্রচার সহযোগী ছিল স্বপ্ন নিয়ে। ১৫ ফেব্রুয়ারি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র খুঁটির প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে এই আয়োজন সমাপ্ত হয়। সমাপ্ত মানে এই বছরের মতো, আসছে বছর আবার হবে!