ঘরে বসে বিশ্বজয়

>মহামারির এই দুর্যোগের সময়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর সময় কাটছে ঘরে। ঘরে বসেই অনেকে অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়। আসছে সম্মাননা, পুরস্কার। এমনই কয়েকটা পুরস্কার জয়ের গল্প শোনাচ্ছেন জাওয়াদুল আলম।
‘ডিইউ নিম্বাস’ দলের সদস্যরা, ‘ডিজিটাল ইনোভেশন’ দলের সদস্যরা
‘ডিইউ নিম্বাস’ দলের সদস্যরা, ‘ডিজিটাল ইনোভেশন’ দলের সদস্যরা

আন্তর্জাতিক ব্লকচেইন অলিম্পিয়াড
প্রথমবারেই জোড়া পুরস্কার
৩ থেকে ৫ জুলাই হংকংয়ে অনুষ্ঠিত হলো আন্তর্জাতিক ব্লকচেইন অলিম্পিয়াড (আইবিসিওএল)। প্রথমবার অংশ নিয়েই দুটি পুরস্কার জিতেছেন বাংলাদেশের তরুণেরা। অনলাইনে আয়োজিত এ প্রতিযোগিতায় দেশের হয়ে রৌপ্যপদক পেয়েছে ‘ডিজিটাল ইনোভেশন’ দল। অন্যদিকে বিশেষ পুরস্কার শাখায় আইবিসিওএল ২০২০ বেস্ট প্রোটোটাইপ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে ‘ডিইউ নিমবাস’ নামে আরেকটি বাংলাদেশি দল।

‘ডিজিটাল ইনোভেশন’ দলটি পেশাগতভাবেই ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে। মজার ব্যাপার হলো দলের দুজন সদস্যের নাম কামরুল হাসান। বাকি দুজন হলেন রিদোয়ান খান ও নওসাদ হোসেন। সবাই সফটওয়্যার–প্রতিষ্ঠান লিডস করপোরেশন লিমিটেডের কর্মী। তরুণ প্রকৌশলীদের দলটি গত ২০ মার্চ ব্লকচেইন অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্যায়ের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে। শুরু থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল—এমন একটি প্রকল্প তৈরি করবে, যা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এ কথা মাথায় রেখে তারা ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন–নির্ভর পরিচয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থাপনা ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাহায্য বিতরণের প্ল্যাটফর্ম তৈরির লক্ষ্যে কাজ শুরু করে।


দলনেতা কামরুল হাসান জানালেন, তাঁদের এ প্রকল্পের মাধ্যমে পরিচয় শনাক্তকরণ–সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ অনেক সহজ হবে। অন্যদিকে এ প্রকল্পের আওতায় সাধারণ মানুষের তথ্য একক কোনো প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না; বরং এখানে সাধারণ মানুষ ও ব্যবহারকারীরা নিজেরাই নিজেদের তথ্যগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।

একই প্রতিযোগিতায় আইবিসিওএল ২০২০ বেস্ট প্রোটোটাইপ অ্যাওয়ার্ড অর্জনকারী দলটি হলো ‘ডিইউ নিমবাস’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বর্তমান শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান ও ইশতিয়াক জাহিদ এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থী তাহলিল—এ তিনজন মার্চে একসঙ্গে কাজ শুরু করেন। জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতা শেষে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন ঢাবির আরেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দী। দলের মূল লক্ষ্য, দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনাকে পুরোপুরি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের আওতায় নিয়ে আসা।

তাঁদের প্রস্তাবিত প্রকল্পটি মূলত সরকারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করবে। মুঠোফোন অ্যাপ ও ওয়েবসাইট–নির্ভর সেবা প্রকল্পের মাধ্যমে একদিকে যেমন জমিজমাসংক্রান্ত কাজগুলোর দীর্ঘসূত্রতা কমবে, অন্যদিকে বন্ধ হবে এ খাতের দুর্নীতি।

প্রস্তাবিত প্রকল্পের কর্মপ্রক্রিয়ার ভিডিও ও অনলাইনে দেওয়া পোস্টার বোর্ড প্রেজেন্টেশন মুগ্ধ করে প্রতিযোগিতার বিচারকদের। ফলে আইবিসিওএল ২০২০ বেস্ট প্রোটোটাইপ অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয় ডিইউ নিমবাস। সবাই সশরীর উপস্থিত হয়ে কাজ করতে পারলে হয়তো আরও ভালো কিছু উপহার দিতে পারতেন বলে মনে করেন আতিকুর। আর মূল অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে নিজ হাতে পুরস্কার ছুঁয়ে দেখতে না পারার আফসোস তো আছেই। ইশতিয়াক বলেন, ‘ঘরে বসে এ ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতাও অসাধারণ। আর প্রথমবার অংশগ্রহণেই পুরস্কার অর্জন আমাদের সাহস জোগাচ্ছে প্রকল্পটিকে বাস্তবে পরিণত করার।’ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে সহযোগিতা পাবেন বলেই আশা করছেন তাঁরা।

অ্যান্টসের সদস্যরা মূলত বিমানের নকশা নিয়ে কাজ করেন। ছবি: সংগৃহীত
অ্যান্টসের সদস্যরা মূলত বিমানের নকশা নিয়ে কাজ করেন। ছবি: সংগৃহীত

আনম্যানড এয়ারক্রাফট সিস্টেম চ্যালেঞ্জ
তিনটি পুরস্কার জিতেছে আইইউটির অ্যান্টস
প্রথমবারের মতো আনম্যানড এয়ারক্রাফট সিস্টেম (ইউএএস) চ্যালেঞ্জে অংশ নিয়ে তিনটি পুরস্কার জিতেছে গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) শিক্ষার্থীদের সংগঠন অ্যান্টস। আন্তর্জাতিক এই প্রতিযোগিতার আয়োজক যন্ত্র প্রকৌশলীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইনস্টিটিউশন অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স। প্রতিযোগিতাটির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মানববিহীন বিমানের নকশা করা ও তৈরিতে উৎসাহ দেওয়া হয়।

২০১৮ সালের নভেম্বর মাস থেকেই আনম্যানড বা মানববিহীন বিমান নিয়ে কাজ করছিল অ্যান্টস। ঠিক পরের বছরই ইউএএস চ্যালেঞ্জে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হয় তারা। অ্যান্টসের সদস্য আসীর নিহালুল ইসলাম বললেন, ‘শুধু প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য নয়, বরং সব সময়ই আমাদের লক্ষ্য ছিল এমন কিছু নকশা করব, তা যেন বাস্তবে রূপ দেওয়া যায়।’


আইইউটির যন্ত্র প্রকৌশল, ব্যবসায় ও প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের মোট ১৪ জন শিক্ষার্থী এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। আর শুরু থেকেই দলটির উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্র ও উৎপাদন প্রকৌশল বিভাগের প্রভাষক চৌধুরী সাদিদ আলম।

অ্যান্টসের তৈরি উড়োজাহাজ প্রকল্পের নাম ফ্রিডম–৭১। অনেকটা গতানুগতিক উড়োজাহাজের আদলেই তৈরি। মূলত চার ধরনের সেবা দেবে এটি—দুর্যোগে জরুরি সেবা, পণ্য সরবরাহ, কৃষি খাত ও সাংবাদিকতায় সেবা সহায়তা। ধরা যাক, কোথাও অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। সেখানে দ্রুত একটি বিমান পাঠিয়ে ঘটনাস্থল চিহ্নিত করা, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণসহ আরও প্রয়োজনীয় নানা তথ্য পাওয়া যেতে পারে। প্রকল্পের খরচও হবে তুলনামূলক কম। এ ছাড়া এ ধরনের বিমানের সাহায্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষিজমির এরিয়াল শট নেওয়া যাবে। ফলে বিভিন্ন স্থানের ফসলের পরিমাণ, ফসলের বৈচিত্র্যসহ বিভিন্ন তথ্য সহজেই সংগ্রহ করা যাবে। ফ্রিডম-৭১ বিমানের মাধ্যমে দ্রুত কোনো ঘটনাস্থলে পৌঁছানোসহ ভালো মানের ছবি ও ভিডিও পাওয়া সম্ভব।

এই বিমানের প্রকল্প পরিকল্পনা, ব্যবসায়িক মডেল, পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের ভিডিও, পোস্টারসহ নানা রকম উপস্থাপনার ভিত্তিতে দলটি আলাদা অবস্থান করে নেয় প্রতিযোগিতায়। ফলে অংশ নেওয়া ৩৬ দলের জন্য নির্ধারিত ছয়টি বিভাগের মধ্যে তিনটিতে পুরস্কার লাভ করে অ্যান্টস। হাইয়েস্ট প্লেসড নিউ এন্ট্রান্ট অ্যাওয়ার্ড, মিডিয়া অ্যান্ড এনগেজমেন্ট অ্যাওয়ার্ড এবং বিজনেস প্রপোজিশন অ্যাওয়ার্ড—এই তিন বিভাগে পুরস্কার জিতেছে তারা।

তবে এই অর্জনেই অ্যান্টস থামতে চায় না। ক্যাম্পাস খুললেই ফ্রিডম-৭১ বিমানটিকে নিয়ে আরও গভীরে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। পরিপূর্ণ একটি উড়োজাহাজ বানিয়ে পরবর্তী বছর আবারও প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার কথা ভাবছে তারা।

বাঁ থেকে আশরাফুল ও বাঁধন
বাঁ থেকে আশরাফুল ও বাঁধন

সার্নের ওয়েবফেস্ট
বড়দের মঞ্চে দুই ‘ছোট’
আর সব এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মতোই দুশ্চিন্তায় দিন কাটছিল ঢাকার সরকারি বিজ্ঞান কলেজের ছাত্র আশরাফুল আলমের। পড়াশোনার কারণে এর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার উপস্থিতি ছিল না। ঘরবন্দী এই সময়ে ফেসবুক আর টুইটারে অ্যাকাউন্ট খোলে সে। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন টুইটারে সুইজারল্যান্ডের দ্য ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ বা সার্নখ্যাত প্রতিষ্ঠানটির একটি ওয়েবফেস্ট আয়োজনের ঘোষণা চোখে পড়ে।

ওয়েবফেস্টের ব্যাপারে আশরাফুল তার স্কুলের ছোট ভাই বাঁধন বিশ্বাসের সঙ্গে আলাপ করে। বাঁধন এখন ঢাকার সেন্ট যোসেফ স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ছে। তবে স্কুলে থাকার সময়ে সায়েন্স ক্লাবের সুবাদেই দুজনের পরিচয়। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানবিষয়ক নানা পরিকল্পনা মাথায় ঘুরপাক খেত, কিন্তু কেউই নাকি তাদের পাত্তা দিত না।


এবার বড় একটি মঞ্চে নিজেদের পরিকল্পনা তুলে ধরার সুযোগ পেয়ে সেটি হাতছাড়া করতে চায়নি দুজন। বলে রাখা ভালো, প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পরিকল্পনার আগেই ‘ডাট্যুরএক্স’ নামে নিজেদের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিল দুই কিশোর। করোনাকালেই ডাট্যুরএক্সের যাত্রা শুরু। ইচ্ছা ছিল, এই প্রতিষ্ঠান থেকেই তারা নিজেদের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করবে।

আশরাফুল আর বাঁধন মিলে একটি অ্যাপ বা ওয়েবসাইট তৈরির পরিকল্পনা সাজায়। যেটি বিষণ্নতা ও হতাশা কাটাতে সাহায্য করবে। অ্যাপটি ফেসবুক, গুগলের অ্যালগরিদমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে আপনার পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক অনুপ্রেরণামূলক বিষয়, ছবি, সিনেমা, বই কিংবা কোনো পেজ সুপারিশ (সাজেশনস) করবে। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের উদ্বেগ বা হতাশা বাড়ায়, এমন সব পোস্টও ফিল্টার করবে অ্যাপটি।

গত ২৬-২৯ জুন অনলাইনে একাধিক অধিবেশনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় আশরাফুল ও বাঁধন। উপস্থাপনা, নিবন্ধ লেখা, প্রকল্পকেন্দ্রিক তথ্য-উপাত্তের গবেষণা তারা বিচারকদের সামনে তুলে ধরে। বিশ্বের ছয়টি মহাদেশ থেকে অংশ নেওয়া ৩৫টি প্রকল্প নির্বাচিত হয় মূল প্রতিযোগিতার জন্য। বাছাইয়ের পর সাতটি প্রকল্প নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় চূড়ান্ত পর্ব। সাতটির একটি প্রকল্প হচ্ছে আশরাফুল ও বাঁধনের প্রকল্পটি। ফাইনালিস্ট হওয়ার পর আশরাফুলের অভিব্যক্তির কথা সার্নের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।

আশরাফুল বলেছে, ‘এত বড় একটি প্রতিযোগিতায় ফাইনালিস্ট হওয়া নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য অনেক বড় অর্জন। আগে আমাদের বিজ্ঞান প্রকল্প আর ধারণাগুলোকে কেউই পাত্তা দিত না। যারা বলত, “তোমরা তো এখনো কলেজই শেষ করতে পারোনি, তোমরা এসবের কী বোঝো?” তারাই এখন আমাদের সাফল্যে বাহবা দিচ্ছে।’

আশরাফুল জানাল, তাদের দলটি ছাড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী বাকি সবাই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা সদ্য স্নাতক তরুণ। বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়েই এই উৎসবের আয়োজন করে সার্ন। তবে এবার করোনাভাইরাসের কারণে অনলাইনে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। পাশাপাশি অংশগ্রহণের জন্য বয়সের সীমাবদ্ধতাও ছিল না এবার। তাই সহজেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পেরেছিল আশরাফুল ও বাঁধন। উচ্চমাধ্যমিক শেষে তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে চায় দুজন।