হল জীবনের শুরু

অনেক স্বপ্ন নিয়ে হলে পা রাখেন নতুন বাসিন্দারা। মডেল: রাজন। ছবি: খালেদ সরকার
অনেক স্বপ্ন নিয়ে হলে পা রাখেন নতুন বাসিন্দারা। মডেল: রাজন। ছবি: খালেদ সরকার
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি-প্রক্রিয়া প্রায় শেষ। কলেজ পেরোনো ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই তাঁদের ‘ঠিকানা’ জেনে গেছেন। শিক্ষাজীবনের এই সময়টাতে দেশের একটা বড়সংখ্যক শিক্ষার্থীর ঠাঁই হয় হলে। নতুন আবাসনের কথা ভেবে নিশ্চয়ই রোমাঞ্চ, শঙ্কার পাশাপাশি তাঁদের সঙ্গী স্বপ্নও! হলজীবনের শুরুটা কেমন ছিল, জানিয়েছেন ঢাকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের বাসিন্দারা

প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়টা যেন দেশের শিক্ষার্থীদের ঠিকানা বদলের মৌসুম। রংপুরের এক ছাত্র যখন ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে’ পড়বেন বলে ঢাকায় পা রাখেন, ঠিক তখনই হয়তো সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে গাট্টিবোঁচকা নিয়ে সিলেটের ট্রেন ধরেন রাজধানীর এক ছাত্রী! অচেনা শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ঠাঁই হয় অধিকাংশ শিক্ষার্থীর। যদিও দেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই শুরুতে হলে সিট পাওয়া লটারি জেতার চেয়ে কম ‘ভাগ্যের ব্যাপার’ নয়!
চেনা গণ্ডির বাইরে এসে যখন হলে উঠতে হয়, সেই পরিস্থিতি অনেকের কাছেই প্রথমে সুখের হয় না। আবার অচেনা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে খুব বেশি সময়ও লাগেনা। বরং বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষে এই হলের স্মৃতিই যেন মনকে উতলা করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, সূর্যসেন হলের বাসিন্দা রায়হানুল আবেদিনের শুরুর অভিজ্ঞতা ছিল ভীতিকর। বলছিলেন, ‘প্রথম যখন একসঙ্গে ৫০ জনের গণরুমে উঠেছিলাম, তখন মনে হয়েছিল কীভাবে হলে থাকব? কিন্তু সেই ৫০ জনই যখন বন্ধু হয়ে গেলাম, সারা রাত জেগে রাজু ভাস্কর্য-টিএসসি-ফুলার রোডে গান গেয়ে, আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে শুরু করলাম, তখন বুঝলাম ক্যাম্পাস জীবন কত সুন্দর।’
হলের ডাইনিং-ক্যানটিনের খাবার নিয়েও শিক্ষার্থীদের ঝুলিতে কম গল্প জমা নেই। রোকেয়া হলের ছাত্রী ফারিয়া রিফাতের কাছেই শোনা যাক তাঁর অভিজ্ঞতা। ‘প্রথমে ডাইনিংয়ের খাবার একদম খেতে পরতাম না। পাতলা ডাল, মোটা ভাত আর প্লাস্টিকের মতো পরোটা! খেতে বসে চোখে পানি এসে যেত।’ বলেই ফারিয়া এ-ও মানলেন, বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষে একদিন এই ‘প্লাস্টিক-পরোটা’র জন্যই হয়তো মন কাঁদবে!
বুয়েটের আহসানউল্লাহ হলের সুকান্ত সুমন জানালেন, শুরুতে বড় ভাইদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কিছুটা সমস্যাই হচ্ছিল। বললেন, ‘অনেক সময় র্যা গিংয়ের শিকারও হয়েছি।’ কিন্তু আজ সেগুলো তাঁর কাছে মজার স্মৃতি হিসেবেই গণ্য। এত সব প্রতিকূলতার মধ্যেও হলের পরিবেশ অনেকের কাছেই স্বাধীনতার আরেক নাম। ঢাবির বিজয় একাত্তর হলের সিফাত হাসানও ‘স্বাধীন’দের দলে। বন্ধুদের সঙ্গে হঠাৎ পরিকল্পনা করে ঘুরতে চলে যাওয়া, মাঝ রাতে পলাশীর মোড়, চানখাঁরপুলের রেস্তোরাঁয় দলবেঁধে খাওয়া, এটাই তাঁর কাছে হলজীবন।
‘ইচ্ছা করে আবার সেই ছাত্রজীবনে ফিরে যাই’ হলজীবনের স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের প্রভোস্ট মাকসুদ কামাল। একটি হলের অভিভাবক হয়ে তিনি আরও কাছ থেকে জেনেছেন, হলে থাকার শুরুটা কঠিন হলেও পড়াশোনা, বন্ধু, আড্ডা আর শিক্ষকদের সহযোগিতা সবকিছু ঠিক করে দেয়। দলবেঁধে থাকার সুবিধাটা যাঁরা ‘গ্রুপ স্টাডি’র মাধ্যমে কাজে লাগাতে পারেন, তাঁরাই বিশ্ববিদ্যালয়ে সফল হন।
ঢাবির রোকেয়া হলের প্রভোস্ট নাজমা শাহীনের শিক্ষাজীবনে হলে থাকা হয়নি। তবে ২৬ বছর বিভিন্ন হলের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষার্থীদের শুরুর সময়টার বাধাগুলো তিনি জানেন। বলছিলেন, ‘হলে এসে অনেক সময় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। সে জন্যই ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের ব্যবস্থা আছে। তাঁর সঙ্গে কথা বলে ছাত্রীরা সমস্যার সমাধান করতে পারে।’
হলের রাজনীতি কখনো কখনো নতুন বাসিন্দাদের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্কুল-কলেজ পেরিয়ে নিজের মেধা দিয়ে যাঁরা দেশসেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এই সংকট মোকাবিলার মতো সাহস রাখেন।

সব নিজের দায়িত্ব
সাবরিনা শাওরীন আলম
কেমিকৌশল বিভাগ, তৃতীয় বর্ষ
ছাত্রী হল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

শুরুটা ছিল মে মাসে। প্রথম দর্শনেই হলের মাঠের প্রেমে পড়ে যাই। সবুজ মাঠ, ছোট কিছু গাছের ঝোপ, আর কোনায় বিশাল বটগাছ। বটগাছে আবার টিয়া পাখির বাসা!
আমার বাবার মুখে হলের গল্প শুনে বড় হয়েছি, বাবার রুম নম্বর ছিল ৩৩৩! বুয়েটে যখন হলে সিট পেলাম, অবাক হলাম। আমার রুম নম্বরও ৩৩৩! কিন্তু রুমে ঢুকেই মন খারাপ। পরিবার ছেড়ে এসে বেশ খারাপ লাগা তো ছিলই, তার ওপর এক রুমে চারজন! সবাই অপরিচিত, চেনামুখ একটাও নেই। সবকিছু নিজের করা লাগবে। ঘর পরিষ্কার থেকে শুরু করে কাপড় ধোয়া পর্যন্ত সব নিজের দায়িত্ব!
যতবার ডাইনিংয়ে যেতাম, বাসার জন্য টান আরও বেড়ে যেত। কিন্তু খুব অল্প সময়েই রুমের অচেনা তিনটা মুখই হয়েছে সবচেয়ে আপন। প্রথম চাঁদনি রাতে হলের মাঠে গান, প্রথম বৃষ্টিতে আফতাবের খিচুড়ি দিয়ে পেটপূজা, বিশ্বকাপের সময় টিভি রুমে সেই টান টান উত্তেজনা কিংবা দীপাবলিতে হল আলো করে ফানুস ওড়ানোর মতো অজস্র স্মৃতি মন খারাপের সেই প্রথম দিনগুলোকে ম্লান করে দিয়েছে।

অসাধারণ কিছু বন্ধু পেয়েছি
হৃদয় বিশ্বাস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিবিএ চতুর্থ বর্ষ
জগন্নাথ হল
যখন জানতে পারলাম, রাজনৈতিক সাহায্য ছাড়া হলে আসন পাওয়া যাবে না, খুব ভেঙে পড়েছিলাম। কারণ রাজনীতিতে আমার কখনোই আগ্রহ ছিল না। যেহেতু আর তেমন কোনো উপায় ছিল না, তাই রাজনীতি করেন এমন ছাত্রদের সাহায্য নিয়েই হলে উঠেছিলাম।
প্রথমদিকে সিনিয়রদের সবাইকে ভয় পেতাম। বড়দের সঙ্গে ওঠাবসা করতেও কিছুটা সমস্যা হতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম, বিভিন্ন সংকটের মধ্য দিয়ে গেলেও আমি অসাধারণ কিছু বন্ধু পেয়েছি। এর চেয়েও বড় কথা, হলে থাকার সময়টাতেই আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করা শিখেছি।
আমার মতে, ক্যাম্পাসে কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে। কিংবা তাঁরা খারাপ কাজ করতে বাধ্য হন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যদি নিজেদের চিন্তার স্বাধীনতাকে কাজে লাগাতে পারেন, আমরা নিশ্চয়ই রাজনীতির সুন্দর দিকটাও দেখতে পারব।