১০ মিনিটের ইশকুল!

বিভিন্ন পরীক্ষার প্রস্তুতি, প্রস্তুতি যাচাই কিংবা তথ্য অনুসন্ধান, সব হবে এক ওয়েবসাইটে—টেনমিনিটস্কুল ডটকম! ব্যতিক্রম এই অনলাইন স্কুলের উদ্যোক্তা আয়মান সাদিক বলেছেন বিস্তারিত। সঙ্গে ছিলেন তৌশিকুর রহমান ও মো. সাইফুল্লাহ
দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী টেনমিনিটস্কুলের কর্মীদের একাংশ। ছবি: সংগৃহীত
দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী টেনমিনিটস্কুলের কর্মীদের একাংশ। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ) ভর্তি হয়ে আয়মান সাদিক পড়লেন মহা মুসিবতে। স্কুল-কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞান ক্লাসে বসে তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল ছাত্রজীবনে বহুল প্রচলিত কথা—‘কিচ্ছু বুঝি না!’ সে সময় হঠাৎই ইউটিউবে হিসাববিজ্ঞান বিষয়ের ওপর কিছু টিউটোরিয়াল খুঁজে পেলেন। তারপর? ‘সতেরোটা ভিডিও দেখে আবিষ্কার করলাম, হিসাববিজ্ঞানের মোটা বইটার ১৭টা অধ্যায় আমার পড়া শেষ। সেই কোর্সে আমি “এ” পেয়েছিলাম!’ বলছিলেন আয়মান। তিনি ভাবলেন, সহজে শেখার এই উপায়টা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিলে কেমন হয়? এই ভাবনা থেকেই বছর দুয়েক আগে যাত্রা শুরু হয়েছিল টেনমিনিটস্কুলডটকম (10minuteschool.com) নামের ওয়েবসাইটটির।
দুই মিনিটে নুডলস তৈরি কিংবা ৩০ মিনিটে ‘পিৎজা ডেলিভারি’র কথা শুনেছেন। কিন্তু ১০ মিনিটের পাঠশালা! সেটা কী? ওয়েবসাইটটির বর্ণনায় লেখা আছে, এটা এমন এক ‘প্ল্যাটফর্ম’, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পছন্দের বিষয় শিখতে পারবে, বিভিন্ন তথ্য জানতে পারবে এমনকি কোনো বিষয়ে নিজের দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষাও দিতে পারবে।
অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি), মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক থেকে শুরু করে আইবিএ, মেডিকেল, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য সহস্রাধিক ‘কুইজ’ পরীক্ষার প্রশ্ন পাওয়া যাবে এখানে। যে পরীক্ষা দিতে চান, ক্লিক করলেই সে বিষয়ের ওপর নির্ধারিত কিছু প্রশ্ন চলে আসবে পর্দায়। ১০ মিনিটের মধ্যে নির্ধারিত সংখ্যক নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। সময় শেষ হলে অথবা সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়ে গেলে পেয়ে যাবেন ফলাফল। সঙ্গে রয়েছে ‘র্যা ঙ্কিং’। যাঁরা এই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীর অবস্থান কত, তা সঙ্গে সঙ্গেই বলে দেবে ওয়েবসাইটটি। বিসিএস, ব্যাংক বা সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতির পাশাপাশি আইইএলটিএস, স্যাট, জিআরই, জিম্যাট, টোফেলের জন্যও আছে ভিন্ন ভিন্ন কুইজ।

প্রস্তুতি যাচাইয়ের ব্যবস্থা থাকলে নিশ্চয়ই প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যবস্থাও থাকা উচিত। হ্যাঁ, আছে সেটাও। ওয়েবসাইটে সব বিষয়ের প্রস্তুতির জন্য ‘টিউটোরিয়াল’ ও ‘ইনফো গ্রাফিক’-এর ব্যবস্থা রয়েছে। আইবিএ থেকে সদ্য স্নাতক পেরোনো আয়মান বলছিলেন, ‘মূলত আমি নিজে অনেক কিছুই শিখেছি খান একাডেমির ভিডিও দেখে। সেখান থেকেই ধারণা পেলাম, আমাদের শিক্ষার বিষয়গুলোও সহজভাবে উপস্থাপন করা যায় কি না। এখন পর্যন্ত মোট দুই শর বেশি টিউটোরিয়াল ও ১ হাজার ৪৩টি কুইজ আমাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। প্রতিনিয়ত এই সংখ্যা বাড়ছে এবং বাড়বে।’ এ ছাড়া যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ধরনের তথ্য, কত পয়েন্ট থাকলে পরীক্ষা দেওয়া যাবে কিংবা কোন বিভাগের আসনসংখ্যা কত—এই সবকিছু ‘ইনফোগ্রাফিকস’ আকারে দেওয়া হয়েছে এই ওয়েবসাইটে।
এখন ওয়েবসাইটটিতে ঢুকলে সবকিছুই বেশ গোছানো মনে হবে। তবে কাজটা কিন্তু সহজ ছিল না মোটেও। বহু বিষয়, নানা ধরনের পরীক্ষা আর শেখার ধরনও একেকজনের একেক রকম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাকসহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি হয়েছে এই অনলাইন স্কুল। তাঁদের সহযোগিতা করছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও। টেনমিনিটস্কুলের কর্মী শামস, সামিদ, আকিব, সাদমান তাঁদের ভাবনাগুলোকে প্রতিদিন নতুন আঙ্গিকে আর নতুন ডিজাইনে সাজিয়ে তুলছেন। জিহান, রামিম, মেহেদি, মুনযেরীন, অনিন্দ্য, অনন্যা—প্রতিদিন তাঁরা নতুন করে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নপত্র তৈরি করছেন। বুয়েটের রাইদ ওয়েবসাইট চাঙা রাখার কাজ করে যাচ্ছেন। আর সবাই মিলে এই সবকিছুই করছেন একটাই লক্ষ্যে—শেখা ও শেখানোর সময়টাকে ‘দশ মিনিটে’ আনার জন্য!
ওয়েবসাইটটির নাম টেনমিনিটস্কুল কেন? প্রশ্নের জবাবে আয়মান বললেন, ‘আমরা কথায় কথায় বলি, “দশ মিনিটে করে দিচ্ছি”। এই স্কুলের বক্তব্যও সেটাই। কোনো বিষয়ে কিছু শিখতে চান, নিজের দক্ষতা যাচাই করতে চান? আমাদের ওয়েবসাইটে স্রেফ ১০ মিনিট সময় দিন। আমাদের টিউটোরিয়াল ভিডিওগুলোর দৈর্ঘ্য ১০ মিনিটের কম। বিসিএস ছাড়া প্রতিটা কুইজের সময়ও ১০ মিনিট কিংবা তার কম।’ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে বিতর্কের দক্ষতা বৃদ্ধি কিংবা পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড বানানোর মতো শিক্ষাও ওয়েবসাইটটির মাধ্যমে দিচ্ছেন আয়মানরা।
যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো শিক্ষার্থী, শিক্ষক এই অনলাইন স্কুলের জন্য স্বেচ্ছাশ্রম দিতে চান, টেনমিনিটস্কুল তাঁদের স্বাগত জানাচ্ছে। চাইলে কেউ অনুদানও দিতে পারেন। যেন ‘দশ মিনিটের স্কুলের’ পরিধি হয় আরও বড়। আয়মান সাদিকের ভাষ্যমতে তাঁদের স্বপ্নটা এমন, ‘আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের যেন কোচিংয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। ঘরে বসেই যেন তারা বিনা মূল্যে শিখতে পারে, পরীক্ষার প্রস্তুতি যাচাই করতে পারে, এটাই আমাদের চাওয়া।’
টেনমিনিটস্কুলের ফেসবুক পেজ: facebook.com/10minuteschool
ইউটিউব ঠিকানা: youtube.com/c/10minuteschool