'বড় ছেলে' তাক লাগিয়ে দিলে রে বাবা!

‘বড় ছেলে’ নাটকে অপূর্ব ও মেহজাবীন।
‘বড় ছেলে’ নাটকে অপূর্ব ও মেহজাবীন।

সপ্তাহ খানেক ধরে ফেসবুক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘বড় ছেলে’। স্ক্রল করলেই কারও না কারও টাইমলাইনে দেখা যাচ্ছে তাকে। বন্ধু তালিকার অনেকেই স্ট্যাটাস দিচ্ছেন, ‘আমিও বাড়ির বড় ছেলে’। কেউ লিখেছে, ‘মেজ ছেলে কবে আসবে?’ আমার সেন্স অব হিউমার বুদ্ধিবৃত্তিক দারিদ্র্যসীমার অনেক নিচে। প্রথমে বিষয়টা ধরতে পারি নাই। ভাবছিলাম ঘটনা কি? ‘বড় ছেলে’—মানেটা কি? তবে বুঝতে পারছিলাম বিষয়টা সিনেমাটিক কিছু একটা হবে। নামের মধ্যেই ভারতীয় বাংলা ছবি ‘বড় বউ, ‘মেজ বউ’, ‘সেজ বউ’, ‘ছোট বউ’—এই রকম একটা গন্ধ আছে। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বড় ছেলে’ জিনিসটা কি? খায় নাকি মাথায় নেয়? সে বলল, ‘খালি খান আর গতরে বাতাস লাগায়ে বেড়ান। টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে এত্ত বড় একটা বোমা ফাটল; আর আপনে কন জিনিসটা কী?’

—বোমাটা কী?
—বিস্ময়; বুঝলেন, এইটা এক বিস্ময়! দুর্দান্ত এক টেলিফিল্ম। লিখেছে এবং পরিচালনা আরিয়ান।
—আরিয়ান কে?
—মিজানুর রহমান আরিয়ান
—ও আচ্ছা।
—‘ও আচ্ছা’ শুনেই বুঝতে পারছি আরিয়ানকে চেনেন না। নতুন মেকার। ভালো বানায়। এই টেলিছবিটিতে নায়ক-নায়িকা অপূর্ব আর মেহজাবিন।
—ও আচ্ছা।

পরে ইউটিউবে গিয়ে দেখি সত্যিই এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেছে। এক সপ্তাহে এই টেলিছবিটি সাড়ে ৫৮ লাখ বার দেখা হয়েছে।

তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসের নিতাই চরণের মতো অবস্থা। ‘শুধু দস্তুরমতো একটা বিস্ময়কর ঘটনাই নয়, রীতিমতো এক সংঘটন।’ ‘চোর-ডাকাত বংশের ছেলে হঠাৎ কবি হইয়া গেল। গ্রামের ভদ্রজনেরা সত্যই বলিল—এ একটা বিস্ময় রীতিমতো! অশিক্ষিত হরিজন বলিল—নেতাইচরণ তাক লাগিয়ে দিলে রে বাবা!’ যে নিতাইকে সবাই অতি নিকৃষ্ট অচ্ছুত ডোমের ছেলে বলে জানে, হঠাৎ কবিগানে তার বিস্ময়কর পারফরম্যান্স দেখে সবাই হতবাক হয়ে যায়।

আমাদের টেলিভিশন নাটকে যেদিন কারণে অকারণে ‘আইছিলাম-খাইছিলাম’ ঢুকেছে; হাসির নাটকের নামে কাতুকুতু আর ইতরামির চল শুরু হয়েছে; সেদিনই তার বংশমর্যাদা নিতাইয়ের পর্যায়ে নেমে এসেছে। সেই নিতাই হঠাৎ ‘বড় ছেলে’ দেখিয়ে আমাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ‘যে লোককে মানুষ চেনে, তাহার মধ্য হইতে অকস্মাৎ এক অপরিচিতজনকে আত্মপ্রকাশ করিতে দেখিলে বিস্ময়ে মানুষ হতবাক হইয়া যায়।’ কবিয়াল নিতাইয়ের মতো ‘বড় ছেলে’ দিয়ে আরিয়ান আমাদের হতবাক করেছেন। বিস্মিত করেছেন। আবেগে ভাসিয়েছেন। বহুদিন পরে চোখের পাতা বিনোদনাশ্রুতে ভাসিয়েছেন।

‘বড় ছেলে’র গল্প যে আহামরি কিছু; তা নয়। নিয়ত আর্থিক টানাপোড়েন-ক্লিষ্ট অতি সাদাসিধে একটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলের প্রেম এবং পরিবারের প্রতি তার দায়িত্ববোধের সংঘাত নিয়ে এর গল্প। এই ধরনের গল্প নিয়ে কত নাটক হয়েছে তার কোনো লেখাজোখা নেই। তারপরও ‘বড় ছেলে’ কেন এভাবে আলোড়ন তুলল সেটিই রীতিমতো গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই টেলিছবির প্রথম দৃশ্যে নায়ক রাশেদের বাবা বাজার হাতে নিয়ে ঘরে ফেরেন। একটা পলিথিনের ব্যাগে কেজি পাঁচেক চাল; এক বোতল খোলা সয়াবিন, কেজি খানিক ডাল আর একটা চিপস। এই দিয়ে পরিবারটির আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে প্রথমেই ধারণা পাওয়া যায়। পরে জানা যায়, এই ভদ্রলোক শিক্ষক। তিনি দুই মাস পরে অবসরে যাবেন। টানাটানির সংসার তখন আরও টানাটানিতে পড়ে যাবে। বড় ছেলে রাশেদ পড়াশোনা শেষ করে চাকরির চেষ্টা করছে। পাশাপাশি টিউশনি করছে। এরও পাশাপাশি এক অতি বিত্তবান শিল্পপতির একমাত্র মেয়ে রিয়ার সঙ্গে প্রেম করছে। রাশেদের এক বোন দাম্পত্য বিপর্যয়ের শিকার। সে বাবার পরিবারে তার শিশুসন্তানসহ আছে। রাশেদের ছোট ভাই ছাত্র।

রাশেদ চাকরি না পেয়ে লাগাতার টিউশনি করে যাচ্ছে। রিয়াকে সময় দিতে পারছে না। এমনকি ফোনেও সময় দেওয়া তার পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়েছে। রিয়ার বাবা একের পর এক বিয়ে ঠিক করছে। রিয়ার ইচ্ছায় তা ভেঙেও দেওয়া হচ্ছে। একপর্যায়ে রিয়ার বাবা মরিয়া হয়ে ওঠেন। যথারীতি বিষয়টি রাশেদের ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করে। রাশেদ শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে আসে। সে রিয়াকে বোঝায়, তাদের বিয়ে না করাটাই ঠিক হবে। সে যেহেতু সংসারের বড় ছেলে; তার দিকে যেহেতু পরিবারের সবাই তাকিয়ে, সেহেতু তার অন্য কোনো পথ নেই। পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে দুজনই চিরবিচ্ছেদ মেনে নেয়। রাশেদ বড় ছেলের দায় মাথায় নিয়ে নিজের সব কষ্ট চাপা দিয়ে পরিবারের কাছে ফিরে আসে।

এই হলো ‘বড় ছেলে’র গল্প। তার মানে খুব নাটকীয় তেমন কিছুই এই গল্পে নেই। নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে এ ধরনের গল্পকে উপজীব্য করে নাটক হতো। সেই গল্পই যেন এত দিন পরে ফিরে এল।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, দর্শক কি শুধু স্মৃতিকাতরতার জন্যই নাটকটিকে গ্রহণ করেছে?

আমার ছোট মাথা বলছে, বর্তমানে যে অস্থিরতার গল্প দেখতে দেখতে মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েছে, তার মধ্যে এটি একটি ঠান্ডা এবং স্নিগ্ধ গল্প। প্রেমিক-প্রেমিকার রোমান্টিক দৃশ্য বলতে বনে-বাদাড়ে গান গাওয়া আর ফোনে উঁহু-আহা করা দেখতে দেখতে দর্শক বিরক্ত হয়ে গেছে।

এই টেলিছবির রোমান্টিক দৃশ্যের মধ্যে মধ্যবিত্তের আবেগকে নাড়া দেওয়ার মতো কতকগুলো এলিমেন্ট ঢোকানো হয়েছে। নিজের হাতে রান্না করে আনা খাবার পরম মমতায় প্রেমিককে খাইয়ে দেওয়া; তার ঘাম জবজবে মুখ ওড়নায় মুছিয়ে দেওয়া—এগুলো রোমান্টিক দৃশ্যের বহুল ব্যবহৃত অনুষঙ্গ। কিন্তু পুরোনো হলেও চিরায়ত। এগুলোকেই এ দেশের মানুষ ভালোবাসার শুদ্ধতম প্রকাশ বলে জেনে এসেছে। এ দৃশ্যগুলো দর্শকের মনে দাগ কেটেছে।

টেলিছবিটির একেবারে শেষে বলা যায় চিরবিদায় নেওয়ার সময় রিয়া রাশেদকে যে উপহারগুলো দেয়, সেগুলোর মধ্যেও আবেগ জাগানিয়া অনুষঙ্গ আছে। রাশেদকে যেহেতু সারা দিন বাইরে বাইরে থাকতে হয়, সে জন্য রিয়া তার জন্য একটা পাওয়ার ব্যাংক চার্জার নিয়ে আসে। মানে এখানেও রিয়া ‘মাতৃরুপেনুঃ’। আবহমান বাঙালি নারীর এই পরম মমতাময়ী ছবি আমাদের নাটকে অনেক দিনই অনুপস্থিত। হঠাৎ এই রূপ দর্শককে মুগ্ধ করেছে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল দুজনের দুর্দান্ত অভিনয়। বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে মেহজাবিনের অনবদ্য অভিনয় সবার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। দৃশ্যায়নও ছিল নয়নকাড়া।

‘বড় ছেলে’র কিছু ব্যাপার মনের মধ্যে খচখচানির তৈরি করে। রাশেদকে সব সময়ই চিন্তাক্লিষ্ট দেখানো হয়েছে। চূড়ান্ত সংকটে থাকা মানুষও সর্বক্ষণ মুখে দুশ্চিন্তার রেখা নিয়ে থাকে না। এখানে রাশেদকে অতিরিক্ত গম্ভীর দেখা গেছে।

অবসরে যাওয়ার আগেই একটি পরিবারের এতটা উদ্বিগ্ন হওয়া এবং অর্থসংকটে পড়া কিছুটা দর্শকমনে হোঁচট খাওয়ায়। কিন্তু এসব ছোটখাটো বিষয় ছাড় দিলে ‘বড় ছেলে’র জন্য আরিয়ানকে ধন্যবাদ না দেওয়াটা ভদ্রতার কথা হবে না।