হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত চার দৃশ্য

>হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত নাটক ও চলচ্চিত্র লেগে আছে আমাদের চোখে। বিশেষ কিছু দৃশ্য তো ভোলার নয়। তার নির্মিত বেশ কয়েকটি নাটকের অসাধারণ চারটি দৃশ্য নিয়ে কথা বলেছেন নাটক, অর্থাৎ ওই সব দৃশ্যর পাত্রপাত্রীরা। বলেছেন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কিছু স্মৃতিও। ১৩ নভেম্বর জনপ্রিয় এই নির্মাতার জন্মদিন উপলক্ষে আনন্দের এই বিশেষ আয়োজন।
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ

মাহফুজ কি সত্যিই কাগজ খেয়েছিলেন?

হুমায়ূন আহমেদের হাবলঙ্গের বাজার নাটক দেখলে হাসতে হাসতে এখনো অনেকের পেটে ব্যথা শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। জাহিদ হাসান, মাহফুজ আহমেদ, শাওন অভিনীত এই নাটকে মজার সব দৃশ্যের ছড়াছড়ি। তবে একটা প্রশ্ন অনেকের মনে অনেক দিন ধরেই আছে হয়তো। সেই প্রশ্নটা হলো, কবিতা লেখা কাগজটি কি সত্যিই খেতে হয়েছিল মাহফুজকে? নাটকের একটি দৃশ্যে শাওনের জন্য কবিতা লিখেছিলেন মাহফুজ। কিন্তু নাটকে শাওনের বাবা আতাউর রহমানের ভয়ে ওই কবিতার কাগজ পুরো মুখে পুরে দেন তিনি। সেই দৃশ্যের কথা এখনো মনে আছে মাহফুজের। সেই দৃশ্যর কথা বলতে গিয়ে বললেন, হুমায়ূন আহমেদ স্যার কখনো কোনো দৃশ্য এক টেকে নিতেন না। খুব অল্প অভিনয়শিল্পীর বেলায় এমন হয়েছে। আমাকেও এই কাগজ খাওয়ার দৃশ্য অনেকবার করতে হয়েছে।’ সেই স্মৃতি মনে করে মাহফুজ বললেন, খুব কায়দা করে মুখের মধ্যে কাগজ জমিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু একবার ঝামেলায় পড়েছিলাম। গলার মধ্যে কাগজ আটকে গিয়েছিল।’ মজা করে এই অভিনেতা বললেন, ‘স্যার অনেক কিছুর মধ্যে আনন্দ খুঁজে পেতেন। আমার মনে হয় স্যার আমাদের দিয়ে এসব ভয়ংকর দৃশ্য করিয়ে আনন্দ পেতেন। তাঁর আনন্দ দেখে আমাদের খুব ভালো লাগত।’

‘বৃক্ষমানব’-এ কাদায় মাখামাখি

এজাজুল ইসলাম ও ফারুক আহমেদ—এ দুই অভিনেতাকে হুমায়ূন আহমেদের নাটকগুলোয় বিচিত্র সব চরিত্রে পাওয়া গেছে। জনপ্রিয় এই কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতাকে ঘিরে তাঁদের স্মৃতির কোনো শেষ নেই। বৃক্ষমানব নামের একটি নাটকে এজাজ ও ফারুককে দেখা গিয়েছিল একটা মজার দৃশ্যে। ‘দুলাভাই গো’ বলে বিদেশফেরত ভগ্নিপতি এজাজকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরছেন ফারুক। এরপর তাঁরা পড়ে যান কাদায়। বৃক্ষমানব নাটকের ৭ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডের মাথায় দেখা যায় দৃশ্যটি। সেই দৃশ্য দেখে এখনো হেসে কুটিকুটি হন দর্শক। কিন্তু যখন অভিনেতারা এ দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন, সেই অভিজ্ঞতা ছিল সত্যিকার অর্থে শিউরে ওঠার মতোই। কারণ, শীতের দিনে কাদায় গড়াগড়ি খেতে হলে গা তো শিউরে উঠবেই। ফারুক আহমেদ ওই দৃশ্যের কথা মনে করে বলেন, ‘শুটিংটা হয়েছিল নুহাশ পল্লী ও আশপাশের এলাকায় বাইরে। আগে থেকে আমরা জানতামই না যে আমাদের কাদায় গিয়ে পড়তে হবে। স্যার বাইরে শুটিং করার সময় ওই কাদা ও আইল দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন এ রকম একটা দৃশ্য নেবেন। স্যার যখন দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন শীতের মধ্যে কীভাবে করব, সেই প্রশ্ন মাথায় আসে। কিন্তু আমাদের উপায় ছিল না। কাদায় পড়তেই হবে, স্যার বলেছেন বলে কথা! মজার ব্যাপার হলো, আমরা একবারের চেষ্টাতেই সফলভাবে কাদায় গিয়ে পড়েছিলাম। দৃশ্যটা এখন দেখলে অনেকেই বুঝবে কী ভয়ংকরভাবে কাদায় ডুবে গিয়েছিলাম আমরা!’
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে অসংখ্য স্মৃতি আছে এই অভিনেতার। বললেন, ‘কোনটা রেখে কোনটা বলব। স্যারের নাটকে কাজ করা মানে সারাক্ষণ আনন্দের মধ্যে থাকা। সেই আনন্দ এখন খুব মিস করি।’

গায়ে গ্রিজ মেখে পানিতে

বৃক্ষমানব-এর কথা বলতে গিয়ে ফারুক আহমেদ আরও একটি দৃশ্যের স্মৃতি আমাদের জানান। নুহাশ পল্লীতে সেই নাটকের শুটিংও হয়েছিল শীতের দিনে। নাটকের নাম উড়ে যায় বকপক্ষী। এই ধারাবাহিক নাটকের শেষের দিকের একটি পর্বে ফারুক আহমেদ হীরার আংটি খুঁজতে ঝাঁপিয়ে পড়েন পুকুরে। সেই দৃশ্যের জন্য বেচারা ফারুককে খুব কষ্ট করতে হয়েছিল। দৃশ্যটি করা হয় রাত ৯টার দিকে। জানুয়ারি মাসের কনকনে শীতে পানিতে নেমে শট দিতে ভয়ই পাচ্ছিলেন তিনি। তখন সেটের কয়েকজন তাঁকে পরামর্শ দেন গায়ে সরিষার তেল মাখতে। প্রয়াত অভিনেতা চ্যালেঞ্জার এক ধাপ এগিয়ে ফারুককে গায়ে গ্রিজ মেখে পানিতে নামতে বলেন। যেই কথা, সেই কাজ। গ্রিজ আনানো হয়, গায়ে মাখা হয়, এরপর নেওয়া হয় শট। পানি থেকে যখন ওঠেন ফারুক আহমেদ, তখন নাকি গায়ে লেপ জড়িয়ে তাঁকে ওঠানো হয়, গরম পানিতে গোসল করানো হয়। কিন্তু গ্রিজ কি আর সহজে ওঠে গা থেকে! দৃশ্যটি শেষে হুমায়ূন আহমেদ সেদিন নাকি ফারুককে বলেছিলেন, ‘আরে, তোমরা ইয়াংম্যান। এখন ঝুঁকি না নিলে আর কখন নেবে?’ স্যারের কথায় নতুন করে উৎসাহ পেয়েছিলেন তিনি। সেদিন আরও বলেছিলেন,‘শোন, এগুলিকে বলে বাঘের বাচ্ছা। করবা মিয়া, সমস্যা কী। জীবনে রিস্ক নিবা। রিস্ক না নিলে কিছু হবে না।’

‘প্যাকেজ সংবাদ’-এ ছোট্ট তিশা

‘মারো চিকা মারো’ গানটি প্যাকেজ সংবাদ নাটকের জন্য তৈরি করেছিলেন মকসুদ জামিল মিন্টু। সেই গান মনে আছে নিশ্চয়? তাহলে প্যাকেজ সংবাদ-এর কথাও অনেকের মনে পড়ে যাওয়ার কথা। আতাউর রহমান, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, জাহিদ হাসান, তারিন, আবদুল কাদের, শমী কায়সার ছিলেন সেই নাটকে। তাতে অভিনয় করেছিলেন তিশাও। নাটকটি হুমায়ূন আহমেদের লেখা এবং শামীমা নাজনীনের পরিচালনায় চ্যানেল আইয়ে ঈদে প্রচারের জন্য তৈরি হয়েছিল। তিশার এই বিশেষ চরিত্র নিয়ে কথা হয় পরিচালক শামীমা নাজনীনের সঙ্গে। পুরোনো কথা মনে করে শামীমা বলেন, ‘২০০০ বা ২০০১ সালের কথা হবে। এখনো মনে আছে। ছোট্ট একটা মেয়ে তিশা। এসেছিল হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কাজ করবে বলে, খুব ইচ্ছা ছিল ওর। তখন তিশা ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ে হয়তো। পরে হুমায়ূন স্যার নাটকে ওর জন্যই লিখলেন ফুলির চরিত্রটি।’ নাটকে তিশার বেশ কয়েকটি দৃশ্য আছে। কয়েক দিন আগে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে এক আলাপচারিতায় তিশা বলেছিলেন হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে পাওয়া তাঁর অটোগ্রাফের গল্প। ২০১০ সালে সেই অটোগ্রাফে হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে লিখেছিলেন, ‘শীলার মতো দেখতে যে মেয়ে।’ বইটি সযত্নে তুলে রেখেছেন এই অভিনেত্রী।