চাই নৃত্যমঞ্চ, চাই পৃষ্ঠপোষকতা

বাদী-বান্দার রূপকথার দৃশ্য
বাদী-বান্দার রূপকথার দৃশ্য

১ থেকে ৪ নভেম্বর—জাতীয় নাট্যশালায় সন্ধ্যাগুলো বেশ জমেছিল নাচ আর গানে। চার সন্ধ্যায় নাচের দলের তিন পরিবেশনা। শেষ দিন পরীক্ষণ থিয়েটারে লোকনাট্য দলের নাটক—তা-ও নৃত্য আর গীতকে আশ্রয় করে সোনাই মাধব। প্রতিটি প্রদর্শনীতে ছিল দর্শকের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি।

নাট্যাঙ্গনে নাচের মানুষদের এ উৎসব রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয়। নাচ দেখা, গান শোনা আর আড্ডা-আলোচনায় কিছু কথা, কিছু দাবি বারবার উঠে এসেছে—নৃত্যশিল্প অনেকাংশে অবহেলিত। এর উত্তরণের জন্য চাই পদক্ষেপ। চাই নৃত্যমঞ্চ, চাই পৃষ্ঠপোষকতা। চাই সরকারি পরিকল্পনা।
উৎসবের শিরোনাম ‘সৃষ্টি-মীনা বাজার নৃত্যনাট্য উৎসব’। শিরোনামে যেহেতু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নাম জড়িয়ে, বুঝতে বাকি নেই অন্তত এই আয়োজনের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে সৃষ্টি কালচারাল সেন্টার। আর এই উৎসবে পরিকল্পনাও যথেষ্ট ছিল বলে মনে হয়েছে চার দিনের আয়োজন দেখে। বুধবার উদ্বোধনের দিন ছিল রবীন্দ্রনাথের তাসের দেশ। সাধনার ওই প্রযোজনাটির বাছাই যে যথার্থ ছিল, তার প্রমাণ দেয় মিলনায়তনভর্তি দর্শক আর পুরো সময় তাদের মন্ত্রমুগ্ধ অবস্থান। ওয়ার্দা রিহাবের পরিচালনায় এদিন লায়লা হাসান, লুবনা মারিয়ামের মতো জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের পাশাপাশি তুলনামূলক তরুণ শিল্পীদের নৃত্যপ্রতিভা সারাক্ষণ রসদ জুগিয়েছে দর্শকের মুগ্ধতায়। নেপথ্যে লোপামুদ্রা মিত্র, রুপংকর বাগচী, শায়ান চৌধুরী, আনুশেহ আনাদিলের গান ছিল বাড়তি পাওনা। ছিল গানের ছড়াছড়ি। নানা রূপ, রস ও জীবনবোধের সম্মিলন।

দ্বিতীয় দিন নাট্যশালা মূল মিলনায়তনের বাইরেই ছিল চমক। মিলনায়তনের প্রবেশমুখে শ্রীকৃষ্ণের প্রতীকী ভক্তরা গোল হয়ে বসে গান গেয়ে দর্শকদের অভ‍্যর্থনা জানান। এই মুগ্ধতা নিয়ে মিলনায়তনে ঢুকে দর্শক দেখল নৃত্যাঞ্চলের গীতিনৃত্যনাট্য রাই-কৃষ্ণ পদাবলী। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনি নিয়ে এ গীতিনৃত্যনাট্যে রাধা-কৃষ্ণের চরিত্রে ছিলেন ঢাকার নৃত্যজগতে দীর্ঘদিনের জনপ্রিয় নৃত্যজুটি শামীম আরা নীপা ও শিবলী মহম্মদ। শ্রীকৃষ্ণের রথযাত্রাসহ নান্দনিক সব কোরিওগ্রাফি আর নেপথ্যে ছিল হৈমন্তী শুক্লা, মনোময় ভট্টাচার্য ও রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গান।

তৃতীয় দিন শুক্রবার ছিল আয়োজক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি কালচারাল সেন্টারের পরিবেশনা বাদী-বান্দার রূপকথা। এককথায় চোখধাঁধানো ছিল এদিনের পরিবেশনা। আলী বাবা ও চল্লিশ চোরের গল্প নতুন বিন্যাসে, নতুন ভঙ্গিতে ছিল এ প্রযোজনা। শিল্পীর রূপসজ্জা থেকে শুরু করে মঞ্চসজ্জা, আলো-ছায়া, গান সর্বোপরি তারকা শিল্পীদের পরিবেশনাটি যারা দেখেছে, তাদের চোখে এ মুগ্ধতার রেশ থাকবে বহু দিন। ছুটির দিনে দর্শকের উপস্থিতি আক্ষরিক অর্থে উপচেপড়া ছিল। দর্শক আসনের মাঝে চলাচলের মেঝেতে বসে, পেছনে দাঁড়িয়েও অনেক দর্শক উপভোগ করেছে এদিনের ‘রূপকথা’। অনেক দর্শককে টিকিট না পেয়ে ফিরে যেতে দেখা গেছে।

শেষ দিনের আয়োজনটি ছিল পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে। নাচের উৎসবে নাটক দর্শক কতটা নেবে, নাটক শুরুর আগে এমন প্রশ্ন ছিল উৎসবের অন্যতম উদ্যোক্তা নৃত্যশিল্পী আনিসুল ইসলামের মনে। শেষ পর্যন্ত মিলনায়তনের সব কটি আসনে দর্শকের উপস্থিতি সে প্রশ্নটার একটা ভালো জবাব দেয়। রীতিমতো ক্রিকেট ম্যাচের শেষ ওভারগুলোয় দক্ষ ব্যাটসম্যানের হাতে মাঠ শাসনের কথা মনে করিয়ে দেয় এদিনের জমায়েত। ‘নাটক’ হলেও নাচ-গানে ভরপুর ছিল উৎসবের শেষ দিনের পরিবেশনা সোনাই মাধব। নাটক শেষে সোনাই আর মাধবের বিচ্ছেদ সংক্রামিত করেছিল সামনের সারিতে বসা জুডিথা ওখ্লমাচারকে, চোখ মুছতে দেখা গেল তাঁকে।
পুত্রবধূর এই প্রতিক্রিয়ার কথাটি উল্লেখ করলেন উৎসবের পৃষ্ঠপোষক রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী আমিনা আহমেদ। উৎসবটিকে সফল উদ্যোগ বিবেচনা করে ভবিষ্যতেও পাশে থাকার আশ্বাস দিলেন।

উৎসবটিকে পুরোপুরি সফল বললেন নৃত্যগুরু অন্যতম উদ্যোক্তা আনিসুল ইসলাম। তাঁর মতে, ‘আমাদের এখানে বিভিন্নভাবে অনেকেই নৃত্যনাট্য করে থাকলেও খুব কম সংগঠন নৃত্যনাট্য উৎসবের আয়োজন করতে পারবে। এর প্রধান কারণ পৃষ্ঠপোষকতা, বিশেষত অর্থের জোগান এবং নৃত্যমঞ্চ। যথাযথ মঞ্চের অভাবে নৃত্য সংগঠনের বড় পরিকল্পনাগুলো সফল হচ্ছে না।’ উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত একটি সংকলনে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর লিখেছেন, ‘নাচ বা নৃত্যনাট্য অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের চেয়ে অনেক সৃজনশীল ও ব্যয়বহুল। কিন্তু নৃত্যজগতে অনেক প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও আর্থিক সহযোগিতার অভাবে এ দেশে নৃত্যশিল্প প্রত্যাশা অনুযায়ী বিকশিত হতে পারেনি।’ তিনি সরকারি উদ্যোগে দুটি নৃত্যমঞ্চ ও মিলনায়তন নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।

সমাপনী দিন নিজেদের পরিবেশনা শেষ করে দর্শকদের অভিনন্দনের জবাব দিতে এসে আশা জাগালেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী। জাতীয় নৃত্য, জাতীয় সংগীত ও নৃত্যকলা ভবনের ওপরে নাচের জন্য আলাদা একটি মিলনায়তন হবে। শুধু তা-ই নয়, আরও বড় পরিসরে বাংলাদেশ অপেরা হাউসের পরিকল্পনার কথা জানালেন লিয়াকত আলী। যেখানে নৃত্যের জন্য আলাদা মিলনায়তন থাকবে। যেখানে ৭৫০টি আসনের ব্যবস্থা করা হবে। মঞ্চ হবে পুরোপুরি বড় পরিসরে নাচের আয়োজন করার উপযোগী করে। লিয়াকত আলীর এ ঘোষণায় মুহুর্মুহু করতালি জানান দিচ্ছিল কী খুশিই না হয়েছেন নৃত্যানুরাগীরা।

শনিবার রাতে পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তন থেকে বের হওয়ার সময় পরিচয় হলো ইস্কাটনের অঞ্জনা পালের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে প্রসন্ন হাসিমুখ নিয়ে জানালেন, চার দিনই পরিবারের সবাইকে নিয়ে টিকিট কেটে নৃত্যনাট্য দেখতে এসেছেন। বললেন, ‘খুব ভালো লাগল চার সন্ধ্যার পরিবেশনা। চার দিনই শুনে আসছিলাম হল-সংকটের কথা। আজ মহাপরিচালক সাহেবের কথা শুনে বেশি ভালো লাগছে। এখন ভালো স্পনসর পেলেই হয়।’
পর্যাপ্ত নৃত্যমঞ্চ হবে, কাঙ্ক্ষিত পৃষ্ঠপোষকতা মিলবে নৃত্যশিল্পে—এমনটা আশা আমাদেরও।