তেনজিনের প্রেরণা রবীন্দ্রনাথ

গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে তৃতীয় ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসব। রাজধানীর বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে আয়োজিত এই উৎসব চলবে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত। প্রথম দিন সংগীত পরিবেশন করেন তিব্বতের তেনজিন চোয়েগাল ও তাঁর দল। গতকালই তাঁরা কথা বললেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

‘টিবেটটুটিম্বাকটু’ দলের শিল্পী মার্চেলো মিলানি, ট্যারো টেরাহারা, তেনজিন চোয়েগাল ও শেন ফ্লিনডেন l ছবি: খালেদ সরকার
‘টিবেটটুটিম্বাকটু’ দলের শিল্পী মার্চেলো মিলানি, ট্যারো টেরাহারা, তেনজিন চোয়েগাল ও শেন ফ্লিনডেন l ছবি: খালেদ সরকার

খুব ছোটবেলায় তাঁকে ছাড়তে হয়েছে নিজের দেশ। তিব্বত ছেড়ে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে উত্তর ভারতের ধর্মশালায়। সেখানেই বড় হয়েছেন তেনজিন চোয়েগাল। মাতৃভূমির স্মৃতি তাঁর আবছা, কিন্তু কণ্ঠে মেলে তিব্বতের বরফের শীতলতা, পাহাড়ের ঔদাসীন্য, ঝরনার বহমানতা।

গতকাল ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসবের প্রথম দিনে আর্মি স্টেডিয়ামে শ্রোতারা শুনেছেন তেনজিনের গান। তাঁর সঙ্গে গতকাল গিটারে ছিলেন মার্চেলো মিলানি, তবলায় শেন ফ্লিনডেন। তাঁরা দুজনই অস্ট্রেলিয়ার শিল্পী। তেনজিনও এখন থাকেন সেখানে। এই দলের সঙ্গে জাপান থেকে উড়ে এসে যোগ দিয়েছেন ট্যারো টেরাহারা। তিনি বাঁশি বাজান।

তিব্বতের যাযাবরদের ঐতিহ্যধারার সংগীত করেন তেনজিন। এটিই মূলত তাঁর সংগীতের প্রাণ। কিন্তু এর সঙ্গে তবলা, গিটার, বাঁশি, কখনো কখনো অর্কেস্ট্রা যুক্ত হয়। তিব্বতের সুরকে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিলেও তেনজিন মনে করেন, সংগীত হচ্ছে ভাসমান মেঘের মতো। মানুষের তৈরি করা ভৌগোলিক সীমানায় তাকে বেঁধে রাখা যায় না। তেনজিনের কথার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর গড়া গানের দল ‘টিবেটটুটিম্বাকটু’তেও।

প্রথাগতভাবে সংগীতের শিক্ষা নেননি তেনজিন। নানা ধরনের গান শুনে শিখেছেন তিনি। গান গাওয়ার পাশাপাশি তিনি বাজান ড্রানিয়েন ও লিংবু। দুটিই পাহাড়ি বাদ্যযন্ত্র। তেনজিন মনে করেন, সংগীত আসলে শেখার বিষয় নয়; আত্মস্থ করার বিষয়। সংগীতে মাঝে মাঝে শেখা জিনিসও ভুলে যেতে হয়।

এই দলের অন্য দুই সদস্য অবশ্য গুরু-শিষ্য পরম্পরায় সংগীত শিখেছেন। শেন ফ্লিনডেন বানারসি ঘরানার তবলা শিখেছেন পণ্ডিত আশুতোষ ভট্টাচার্য ও দেবু ভট্টাচার্যের কাছে। আর ট্যারো টেরাহারার গুরু হলেন সেতারশিল্পী পণ্ডিত অমিত রায়। এই গুরুদের সবাই বাঙালি।

এমনকি তেনজিনও বাংলা সংস্কৃতি থেকে বিযুক্ত নন। অনেক তিব্বতি সাহিত্যিকের ওপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল। ছোটবেলায় ধর্মশালায় তেনজিনও পরিচিত হয়েছেন রবীন্দ্রসাহিত্যের সঙ্গে।

তেনজিন কথা বলেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়েও। রাজনীতির কারণে এমন মানব–বিপর্যয়কে তিনি মেনে নিতে পারেন না। পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে মানুষকে নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু তেনজিনের বিশ্বাস, জীবনকে এভাবে থামিয়ে রাখা যাবে না। এই বিশ্বাস তিনি পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের দুটি লাইন থেকে: ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা—/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’

এটি যে একটি গান, তা জানা ছিল না তেনজিনের। গান শুনে অনেক প্রীত হলেন তিনি। বললেন, ‘সংগীতের শক্তি হলো এটি আমাদের আবার মানুষ করে তোলে। পৃথিবীতে সংগীত ছড়িয়ে পড়ুক। মানুষ আবার মানুষ হোক।’