বিকল্প থিয়েটার একটা পন্থা হতে পারে

>

ড. আশিস গোস্বামী। তাঁকে বলা যেতে পারে থিয়েটার পরিব্রাজক। তিনি ঘুরে ঘুরে থিয়েটার দেখেন আর তাঁর দেখা থিয়েটারকে তিনি নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করেন। ভারত ও বাংলাদেশের থিয়েটার নিয়ে গবেষণা এবং থিয়েটারের ইতিহাস সংরক্ষণের কাজটিও তিনি করে চলেছেন দীর্ঘদিন ধরে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে পড়াকালে ছিলেন ছাত্রনেতা, পরে হয়ে উঠলেন নাট্য গবেষক। প্রথম আলোর জন্য নাট্য গবেষক ড. আশিস গোস্বামীর এই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন নাট্যকার অলোক বসু

ড. আশিস গোস্বামী
ড. আশিস গোস্বামী


অলোক বসু: কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন বাংলা সাহিত্য নিয়ে, নাটকে চলে এলেন কীভাবে?

আশিস গোস্বামী: আমি তখন রীতিমতো ছাত্রনেতা। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। ঘটনাটা ১৯৮২ সালের। ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (দিল্লি) সিদ্ধান্ত নিল ক্যাম্পাসের বাইরে দুই মাসের একটা আবাসিক নাট্য কর্মশালা করাবে এবং সেটা তারা কোলকাতায় করাতে চায়। একদিন রুদ্র প্রসাদ সেনগুপ্ত এসে আমাকে বললেন, একটা জায়গার ব্যবস্থা করা যায় কি না। আমি তখন রুদ্র বাবুকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে গেলাম। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদ ও নান্দীকারের যৌথ উদ্যোগে কর্মশালাটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়। এটি পরিচালনা করেছিলেন বিশ্বখ্যাত নাট্য নির্দেশক রতন থিয়াম। আজকে ভারতবর্ষজুড়ে আমার যে যোগাযোগ, সেটার সূত্রপাত হয়েছিল সেই কর্মশালার মাধ্যমে। কর্মশালার পরে আমি শূদ্রক নাট্যদলের সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করি। পরে উৎপল দত্তের পিএলটি থেকে সেখানে কাজ করার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। তত দিনে আমি বুঝে গেছি, অভিনয় আমার কাজ নয় বরং এমন কিছু করতে চাই, যা সুনির্দিষ্ট কোনো দলের হবে না, কিন্তু থিয়েটারেরই হবে। উৎপল দত্তের এপিক থিয়েটার পত্রিকার ‘কল্লোল’ সংখ্যায় কল্লোল নাটকটি নিয়ে আমার একটি গবেষণাধর্মী লেখা ছাপা হওয়ার পরে উৎপল দত্ত বললেন—এ ধরনের কাজ করার তো কেউ নেই, তুমি বরং এ ধরনের কাজ চালিয়ে যাও। সেই থেকে শুরু।

অলোক: আপনি ভারতের বিকল্পধারার থিয়েটার নিয়ে প্রচুর গবেষণা করে চলেছেন, এই কাজটার অনুপ্রেরণা পেলেন কোত্থেকে?

আশিস: থিয়েটার দেখতে দেখতে, থিয়েটারের মানুষের সঙ্গে মিশতে মিশতে মনে হয়েছে, এত এত প্রতিভাবান ছেলেমেয়ে এখানে কাজ করতে আসছে, যারা থিয়েটারটাকে দারুণভাবে ভালোবাসে। কিন্তু আজকাল থিয়েটারটা এত ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে যে তাদের অনেকের পক্ষেই কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না, আবার তারা থিয়েটারটাও ছেড়ে যেতে পারছে না। ফলে তারা নানা রকমভাবে থিয়েটারটা করার কথা ভাবছে। নানা রকম পন্থাও আবিষ্কার করে চলেছে। একসময় থার্ড থিয়েটার বা পথনাটকের চর্চা ছিল, সেগুলোর পেছনে রাজনৈতিক কারণ থাকত। তরুণদের অনেকেই রাজনীতির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে থিয়েটারটা করতে চাইছিল। সবাই থিয়েটারের একটা নতুন দরজার সন্ধান করছিল। কোলকাতা দিয়ে শুরু হলেও এদের খোঁজখবর করতে গিয়ে সারা ভারতবর্ষ ঘুরতে শুরু করে দিলাম। দেখলাম, ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন মানুষের নেতৃত্বে ভিন্ন ভিন্ন থিয়েটার গড়ে উঠেছে। কতভাবে যে থিয়েটার হতে পারে আর থিয়েটারও যে কত বৈচিত্র্যময় হতে পারে, না দেখলে বোঝা যাবে না। সারা ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘুরে যেমন বিকল্পধারার থিয়েটার নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি এবং থিয়েটারের ইতিহাস সংরক্ষণের কাজ করছি, তেমনি আমি বাংলাদেশের থিয়েটার নিয়েও কাজ করছি।

অলোক: বাংলাদেশের থিয়েটার নিয়েও আপনি ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, তো আপনি বলবেন কি বাংলাদেশের থিয়েটার এখন কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে?

আশিস: দেখুন সময়টাই এখন থিয়েটারের জন্য প্রতিকূল। সব জায়গায় কমবেশি একই অবস্থা। ১৯৭৪-৭৫ সাল থেকে বাংলাদেশের নাটক দেখছি। সে সময় বাংলাদেশের কিছু নাটকের মান এমন উচ্চতর পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, যা সত্যিই বিস্মিত করে। কাজ কিন্তু হচ্ছে। ভালো কাজও হচ্ছে, হয়তো বিভিন্ন কারণে ভালো কাজগুলো অতটা ঔজ্জ্বল্য ছড়াতে পারছে না। আর একটা বিষয়, দুই দেশেই শাসনযন্ত্রের কাছ থেকে পৃষ্ঠপোষকতা নিতে গিয়ে থিয়েটার হয়তো তার স্বভাবসিদ্ধ বিরোধিতার ক্ষমতাটা হারিয়ে ফেলছে কোথাও কোথাও। সেই দিক থেকে বিকল্প থিয়েটার একটা পন্থা হতে পারে। আমি যেখানে কথা বলার সুযোগ পাই, সেখানেই আমি নতুন চিন্তাভাবনায় থিয়েটার করার ব্যাপারে উৎসাহিত করার চেষ্টা করি।

অলোক: বাংলাদেশের থিয়েটারের ভবিষ্যৎ কেমন বলে মনে হয় আপনার?

আশিস: সারা বিশ্বেই থিয়েটার এখন নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশে এখন হয়তো একটা ক্রান্তিকাল চলছে। তবে এ ব্যাপারে আমি খুবই আশাবাদী। নতুন নতুন ছেলেমেয়েরা আসছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগছে। তাদের চিন্তাভাবনায় নতুনত্ব আছে। থিয়েটারকে তারা এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে এটা আমরা আশা করতেই পারি।