এ এক অপূরণীয় ক্ষতি

আনিসুল হক (২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫২—৩০ নভেম্বর ২০১৭)
আনিসুল হক (২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫২—৩০ নভেম্বর ২০১৭)

সফল ব্যবসায়ী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র হয়েছেন তিনি অনেক পরে। আনিসুল হক তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন একজন উপস্থাপক হিসেবে। ফজলে লোহানী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ধারাবাহিকতায় উপস্থাপনার জগতে তিনি নতুনত্ব নিয়ে এসেছিলেন। গত বৃহস্পতিবার তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন আরও দুজন জনপ্রিয় উপস্থাপক হানিফ সংকেত ও আব্দুন নূর তুষার।

হানিফ সংকেত
হানিফ সংকেত

হানিফ সংকেত
আনিসুল হকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় আশির দশকে। তিনি ‘আনন্দমেলা’, ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার অনুষ্ঠান’ উপস্থাপনা করেছেন, আমিও করেছি। আশির দশকে ‘এখনই, অন্তরালে’ এই অনুষ্ঠানগুলো উপস্থাপনা করতেন। আমি করতাম ‘কথার কথা’। সে সময় আমাদের মধ্যে ভালো কিছু করার সুস্থ প্রতিযোগিতা কাজ করত। ভালোও লাগত কাজ করতে।
আনিসুল হকের প্রথম পরিচয় উপস্থাপক হলেও তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন। দেশপ্রেম তাঁকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
দেশের উন্নয়ন, দেশের অগ্রগতির জন্য নেতা হতে হয় না। প্রয়োজন একটা ভালো আত্মার, প্রয়োজন একজন ভালো মনের মানুষের। আনিসুল হকের মধ্যে সবই ছিল। দেশের জন্য সেই উদাহরণই রেখে গেলেন তিনি। আনিসুল হক একজন জনপ্রিয় উপস্থাপক ছিলেন, আমিও একজন উপস্থাপক হিসেবে তাঁর জন্য গর্ব করতাম।
ঢাকা উত্তরের মেয়র নির্বাচিত হয়ে স্বল্প সময়ে মিরপুর, তেজগাঁওয়ের বাস, ট্রাকস্ট্যান্ডসহ অবৈধভাবে দখল করা একাধিক জায়গা দখলমুক্ত করে মানুষের চলাচলের উপযোগী করে দিয়েছেন। মিরপুরে বেশ কয়েকটি রাস্তায় সিটি করপোরেশনের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে সতর্ক করা আছে: ‘বাস দাঁড়ালেই দণ্ড’। এসব সতর্ক আনিসুল হক রাত-দিন নিজেই তদারকি করতেন। ফলে ওই সব এলাকায় যানজট কমে গিয়েছিল। দুঃখের বিষয়, আনিসুল হক অসুস্থ হয়ে যুক্তরাজ্যের হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে ওই সব রাস্তায় নিয়ম আর মানছেন না বাসচালকেরা। মাস দু-এক আগে দেখলাম ‘দাঁড়ালেই দণ্ড’ লেখা সাইনবোর্ডের নিচেই বাস দাঁড়িয়ে। এরই মধ্যে এই অনিয়মের বিষয়টি ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে দেখিয়েছি। বিষয়টি খুবই পীড়া দিচ্ছে যে, একজন মানুষের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি কীভাবে পার্থক্য গড়ে দেয়!
আনিসুল হক বেঁচে থাকলে সুন্দর একটা নগরী উপহার দিতে পারতেন। সেভাবেই এগোচ্ছিলেন তিনি। তাঁর অনুপস্থিতি দেশের জন্য ক্ষতি হয়ে গেল। অনেকের মৃত্যুতেই ‘অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল’ বলি আমরা। কিন্তু আনিসুল হকের মৃত্যুতে আমাদের সত্যিকারের ক্ষতি হয়ে গেল। সত্যিকারের একজন দেশপ্রেমিককে হারালাম।

আব্দুন নূর তুষার
আব্দুন নূর তুষার

আব্দুন নূর তুষার
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সঙ্গে আড্ডা দিতে প্রায়ই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আসতেন আনিসুল হক। সে সময় মমতাজউদ্দীন আহমেদ, জামালউদ্দিন হোসেন, আবেদ খান, সানজিদা খানসহ অনেককেই সেই আড্ডায় দেখতাম। সময়টা আশির দশকের শুরুর দিকের। ওখান থেকেই আনিসুল হকের সঙ্গে আমার পরিচয়। এরপর থেকে আস্তে আস্তে তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। তত দিনে ব্যবসার কারণে উপস্থাপনা ছেড়ে দিয়েছেন। ব্যবসার উন্নতি হচ্ছে। হঠাৎ করেই আবার ১৯৯১ সালের দিকে ‘বলা না বলা’ নামে একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে ফিরে এলেন। আমি তাঁর সঙ্গে থেকে অনুষ্ঠানের পাণ্ডুলিপি তৈরিসহ গবেষণার কাজগুলো করতে থাকি। তখন তো টেলিভিশন স্টেশন একটাই-বাংলাদেশ টেলিভিশন। এরপর’ ৯২-তে এসে ‘আনন্দমেলা’ অনুষ্ঠানটি করলেন। আনন্দমেলা অনুষ্ঠানটি করার পর থেকে আমি অনেকটাই আনিসুল হকের প্রধান সহকারী হয়ে গেলাম।
সেই থেকে কোনো না কোনোভাবে আনিসুল হকের সঙ্গে থেকে গেছি। তাঁর সঙ্গে আমার মানসিক একটা সম্পর্ক ছিল। ভালোভাবে দাঁড় করাতে আড়াই বছর হলো আমার হাতে একটি টেলিভিশন স্টেশন তুলে দিয়েছেন তিনি। আমাকে তাঁরা তাঁদের পরিবারের সদস্যের মতোই দেখতেন। আমার পরিবারে আমিই সবার বড়। আমাকে মাথায় হাত দিয়ে স্নেহ করার কেউ নেই। তিনিই আমার বড় ভাই, বন্ধুর মতো স্নেহ দিতেন। তাঁর চলে যাওয়া শুধু আমার নয়, দেশের মানুষের জন্য কত বড় শূন্যতা তৈরি হলো, তা বোঝাতে পারব না।