আপনি আসছেন তো?

উৎসব ঘিরে চলছে নাটকের মহড়া
উৎসব ঘিরে চলছে নাটকের মহড়া

দূর থেকে ঠক ঠক আওয়াজ কানে বাজে। এগিয়ে যেতেই দেখা গেল কাঠের ফ্রেমের বিভিন্ন সেট ফেলানো এদিক-সেদিক। তাতে পেরেক ঠুকছেন কজন। অচেনা আগন্তুককে দেখে কাজ থামিয়ে দেন। পরিচয় দিলে বলেন অপেক্ষা করতে। এই সময়ে ছড়ানো-ছিটানো নাটকের সেটগুলো দেখে বুঝে নিই, বড়সড় কোনো নাট্যযজ্ঞের প্রস্তুতি চলছে।

অপেক্ষা শেষে একজন নিয়ে গেলেন নাটমণ্ডলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের নাটকগুলোর এখানে দেখা মেলে। কালো পর্দায় ঢাকা কক্ষে টেবিলে পা তুলে বসে আছেন একজন। পেছনে একটি মানচিত্র। ওপর থেকে ঝোলানো দড়ির পাশে চেয়ারে জড়সড় বসা আরেকজন। একজন দাঁড়িয়ে। তাঁরা অভিনয় করছিলেন। থামিয়ে দিয়ে ঠিক জায়গাটি বোঝানো শুরু করলেন বিভাগীয় শিক্ষক শাহমান মৈশান। বিরতিতে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। জানা গেল, ১২তম কেন্দ্রীয় বার্ষিক নাট্যোৎসব ঘিরে এই প্রস্তুতি। অষ্টম সেমিস্টারের শিক্ষার্থীরা দেশি-বিদেশি ১৭টি নাটক নির্দেশনা দিচ্ছেন। অভিনয়ও করছেন বিভাগের অন্য সেমিস্টারের তরুণ শিক্ষার্থীরা।

শাহমান মৈশানের ভাষায়, এটি তারুণ্যের স্পর্ধার সৃজনশীলতার নাট্যোৎসব। সবাই বয়সে সবুজ—কত হবে? ২২ থেকে ২৩-এর কোটায়। এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের একটি কেন্দ্রীয় অভিব্যক্তি। থিয়েটার বিভাগের ছাত্ররা কোন মানের চিন্তা করেন? তাঁদের কল্পনাশক্তি কেমন? সৃজনশীলতা কী? বর্তমান সময়, রাষ্ট্র ও ইতিহাস নিয়ে তাঁরা কীভাবে চিন্তা করেন? নাট্যের ভাষায় প্রকাশ করেন—এর একটা সামগ্রিক অভিব্যক্তি হচ্ছে এই উৎসব।

এটি উৎসব যেমন, তেমনি আবার শিক্ষার্থীদের সিলেবাসের একটি কোর্সও। কোর্সটি নিয়েছেন দুজন শিক্ষক—আশিকুর রহমান ও শাহমান মৈশান। তাই শিক্ষার্থীদের দিয়ে পুরো নাট্যযজ্ঞ বাস্তবায়নের ভার পড়েছে তাঁদের কাঁধে। ছড়ানো সেটের একপাশে দাঁড়িয়ে পুরো বিয়ষটি নিয়ে শিক্ষক আশিকুর রহমান বলেন, প্রথমে শিক্ষার্থীরা তিনটি করে পাণ্ডুলিপি জমা দেন। সেখান থেকে বাছাইকৃতগুলো নিয়ে চলে আলোচনা, গবেষণা ও রূপান্তর। এরপর চলতি মাসের গোড়ার দিকে শুরু হয় মহড়া। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নাটমণ্ডল, টিএসসি ও কলাভবনে নিজেদের সৃজনশীলতার মালা বুনছেন এই তরুণ তুর্কিরা। মহড়া শেষে বিভাগীয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সামনে প্রদর্শনী চলবে। সেখান থেকে বাছাই করা নাটকগুলোর প্রদর্শনী শুরু হবে ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় টিএসসি মিলনায়তনে।

উৎসবটি পেরিয়েছে ১১ বছর। এবার এক যুগ হচ্ছে। তবে নাটকের গুরুত্বটা এখনো যেন ম্লান সবার কাছে। এই আক্ষেপ বিভাগের চেয়ারম্যান আহমেদুল কবিরের। তিনি বললেন, ‘জাতীয় উৎসব বাদে টিএসসিতে এত বড় উৎসব আর হয় না। সে ক্ষেত্রে এর একটি গুরুত্ব আছে। তবে যতই প্রগতিশীলতার কথা বলেন, এখনো সবাইকে থিয়েটারটা বোঝানো যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক সেশনে একে ক প্রশাসন আসে। তঁাদের বোঝাতে হয় থিয়েটারের গুরুত্ব। এরই মধ্যে তঁাদের সময় শেষ হয়ে যায়, নতুন প্রশাসন আসে। তঁাদের আবার বোঝানো শুরু করতে হয়। ২০১৭ সালে এসেও থিয়েটার, সংগীত, নৃত্য—এগুলো দেশ গঠনে যে অবদান রাখতে পারে, তা তঁারা এখনো মনে করে না।’

তাঁর কথায় থিয়েটারকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টিও উঠে আসে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এ দেশে জাতীয় ক্রিকেট দল আছে, কিন্তু জাতীয় নাটকের দল নেই। অথচ মৌলবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অবদান রাখতে পারে এই নাট্যোৎসবই।

উৎসবের ১৭টি নাট্যরচয়িতা নামের দিকে তাকালে তাঁর কথার যথার্থতা মেলে। আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আহমদ ছফা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিম আল দীন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, বাদল সরকার, মমতাজউদ্দীন আহমদের মতো লেখকেরা। এই লেখকদের সাহিত্যকর্মের ওপর ভর করে তরুণ নির্দেশকেরা কী নিয়ে আসছেন দর্শকের সামনে? কীর্তি বিজয়া বললেন, তিনি কাজ করছেন মমতাজউদ্দিন আহমদের কী চাহ শঙ্খচিল নিয়ে। এখানে উঠে এসেছে ’৭১-এর কথা। ৭১ কে উল্টো করলে হয় ১৭। এই সময়ে ’৭১-কে কীভাবে দেখছেন তরুণেরা, তাই উঠে আসবে তাঁর নাটকে। প্রণব শর্মা বলেন, চার বছরে শিক্ষকদের কাছ থেকে যা শিখেছেন, দর্শকদের সামনে তারই প্রদর্শনী করবেন। সাদিয়া মাহবুবের কাছে নাট্যোৎসবটি স্বপ্নের মতো। শিক্ষাজীবনে যা শিখেছেন তার সারকথা হলো—সমাজের চিত্রই মূলত মঞ্চে দেখানো হয়। আরও কথা হয় রিয়াজ তারেক, রফিকুল ইসলামের মতো তরুণ নির্দশকদের সঙ্গে। তাঁদের কথায় বোঝা যাচ্ছিল, টগবগে এই তরুণেরা প্রস্তুত। সবাইকে উৎসবে মেতে উঠতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আপনি আসছেন তো?