দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজালেই নাটক হয় না

অপরাহ্ণের আলো টেলিছবির দৃশ্য
অপরাহ্ণের আলো টেলিছবির দৃশ্য

গত ১ ডিসেম্বর শুক্রবার সকাল ৮টা ১০ মিনিটে নাহিদা আফরোজের উপস্থাপনায় এনটিভিতে প্রচারিত হলো সরাসরি গানের অনুষ্ঠান ‘ছুটির দিনের গান’। শিল্পী ছিলেন রুমানা ইসলাম। বিজয়ের মাসের প্রথম দিনের প্রত্যুষে সরাসরি গানের অনুষ্ঠানে এসে শিল্পী শ্রোতাদের নিরাশ করেননি। বেশ কয়েকটি দেশাত্মবোধক গান করেছেন তিনি নিজের তাগিদেই। অনুষ্ঠান শেষও করেছেন ‘হায় রে আমার মন মাতানো দেশ’—বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গানটি দিয়ে। গান নির্বাচনেও ছিল বৈচিত্র্যের স্বাক্ষর। তাঁর প্রয়াত পিতা সংগীত ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব খান আতাউর রহমান, তাঁর মা মাহবুবা রহমান, নীলুফার ইয়াসমীনের গান এবং নিজের গানও করেছেন। ‘মনমাঝি তোর বইঠা নে রে’, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘জীবন সে তো পদ্মপাতার শিশিরবিন্দু’ ইত্যাদি গান হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। ‘যদি আর দেখা না-ই হয়’—বাবার এই গানটি গাইতে গিয়ে কান্নায় তাঁর কণ্ঠ আড়ষ্ট হয়ে গেছে। গানটি আর শেষ করতে পারেননি। সরাসরি প্রচারিত বলে দর্শক এটি দেখতে পেয়েছেন এবং মোটেও অস্বাভাবিক মনে হয়নি। গানের ফাঁকে ফাঁকে কথোপকথনে তিনি যেমন সরলতার পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি গান পরিবেশনও করেছেন সহজ-সরলভাবেই। এত কিছুর পরও আমরা বলব, তিনি এখনো পিতামাতার যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে উঠতে পারেননি। পিতামাতাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সাধনাই একজন সাধক সন্তানের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ ব্যাপারে শিল্পীর সজাগ, সনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী অগ্রযাত্রা আশা করি।

গত ৩০ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে পারভেজ আমিনের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় মাছরাঙা টিভিতে প্রচারিত হলো টেলিছবি অপরাহ্ণের আলো। এতে অভিনয় করেছেন নাদিয়া, আজাদ আবুল কালাম, মামুনুর রশীদ প্রমুখ।

ছবিটির গল্প সংক্ষেপে এ রকম—অর্পার স্বামী স্থপতি রাহাত হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। এদিকে অর্পা মহিনের সন্তান অবৈধভাবে গর্ভে ধারণ করে দিন কাটাচ্ছে। সে এখন কী করবে স্থির করতে না পেরে ছুটে যায় তার স্বামীর ডাক্তারের কাছে। জানতে চায় রাহাত বাঁচবে কি না। সে ডাক্তারকে সব খুলে বলে, রাহাত বাঁচলে সে গর্ভপাত ঘটাবে আর না বাঁচলে সে মহিনের সন্তানের মা হবে। ডাক্তার জানায়, রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কিছুই জানানো সম্ভব নয়। এভাবে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে রাহাত বেঁচে যায় এবং অর্পার গর্ভের সন্তানও জন্ম নেয়। বিষয়টি জানা যায় অনেক দিন পর। শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, সামনের লনে অর্পার সন্তান খেলছে আর পেছনে হুইলচেয়ারে ঘরের মধ্যে রাহাত গ্লাস ধরতে গিয়ে ভেঙে ফেলছে। অর্পা ছুটে এসে রাহাতকে অনুশাসন করছে, কেন তাকে ডাকেনি। এভাবে অর্পা ও রাহাতের সুখময় দাম্পত্য জীবনের দৃশ্য দিয়ে শেষ হয় অপরাহ্ণের আলো

কিন্তু টেলিছবিটি শেষ হতেই মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে মহিনের কী হলো? মহিনের সন্তানই বা কী করে অর্পা ও রাহাতের সন্তান হলো? ছবিতে এটি দেখানো হয়নি। আর দেখানো হয়নি বলেই কাহিনিতে অপূর্ণতা ও অবিশ্বস্ততার ফাঁক রয়ে যায়।

আরেকটি বিষয় অতিনাটকীয়, অপরিণত এবং অপ্রয়োজনীয়ও মনে হয়েছে। তা হলো প্রথম সাক্ষাতে ডাক্তারের সঙ্গে অর্পার অতিনাটকীয় সংলাপ। জোর করে ডাক্তারের বাসায় ঢোকা ঠিক আছে, কিন্তু তার পরের সংলাপগুলো স্বাভাবিক ও বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। তারপরও বলব, গতানুগতিক ও বস্তাপচা প্রেমকাহিনির চেয়ে টেলিছবিটি ছিল আকর্ষণীয় ও আবেদনময়। আর ছবির বক্তব্যটি ছিল আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির জন্য মঙ্গলময় ও বিশ্বস্ত। অর্পা শেষ পর্যন্ত তার অসুস্থ স্বামীকে ফেলে মহিনের সঙ্গে চলে যায়নি। মহিনের সন্তানের মা হয়েও সে অসুস্থ রাহাতকে নিয়ে সুখের ঘর বেঁধেছে। এখানেই ফুটে উঠেছে নির্মাতার পরিপক্বতা। ধন্যবাদ পারভেজ আমিনকে, কিছু অমীমাংসিত প্রশ্নের পরেও গণমাধ্যমের উপযোগী একটি টেলিছবি উপহার দেওয়ার জন্য।

২ ডিসেম্বর রাত ৯টায় বিটিভিতে প্রচারিত হলো এ সপ্তাহের নাটক খোলা হাওয়া। লিটু শাখাওয়াতের রচনায় নাটকটি প্রযোজনা করেছেন এস এম নোমান হাসান খান।

নাটকের গল্পটি সংক্ষেপে এ রকম: মফস্বলের পাড়ায় খেলার মাঠের সংগঠক মাসুম। এই পরিচয় নিয়েই তার বাবা-মা গর্বিত। সেই মাঠের টানে তার খালা ঢাকা থেকে দুই শিশুসন্তানকে খেলানোর উদ্দেশ্যে নিয়ে এসেছে মাসুমদের বাসায়। মাসুম ভালোবাসে রুমাকে, কিন্তু রুমা তাকে বাউণ্ডুলে বলে পাত্তা দেয় না। এর মধ্যে জাফর ঠিকাদার চক্রান্তের মাধ্যমে মাঠ দখলে নিয়ে বহুতল ভবন বানানো শুরু করে। এরপর মাসুমের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে প্রতিরোধ আন্দোলন। হয় মানববন্ধন। তখন রুমা এই আন্দোলনে যোগ দেয়। দুর্বার আন্দোলনের মুখে ভবন নির্মাণ স্থগিত হয়, জয় হয় মাসুমদের। এরপর রুমা হাত বাড়িয়ে দেয় মাসুমের দিকে আর মাসুম সেই হাত ধরে।

প্রথমেই বলব, নাটকটির মধ্যে কয়েকটি ইতিবাচক দিক লক্ষণীয়। যেমন আমাদের সমাজজীবনে খেলার মাঠ ও খেলাধুলার গুরুত্ব তুলে ধরা। দুই, ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম্য ও তাদের আগ্রাসন। তিন, নাটকটিতে অনেক নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রীর সমাহার। তবে নতুনদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্মাতারা মঞ্চনাটকের দিকে হাত বাড়ালেই বোধ হয় ভালো করতেন। আরেকটি লক্ষণীয় দিক হলো, নাটকটিতে বাইরের দৃশ্য বেশি থাকায় বিটিভির গতানুগতিক ইমেজ থেকে বেরিয়ে আসা।

তবে নাটকের সমস্ত ঘটনা, সংলাপ, দৃশ্যায়ন—সবই আবর্তিত হয়েছে খেলার মাঠকে ঘিরে। দেখে মনে হয়েছে এদের কারও যেন কোনো ব্যক্তিগত জীবন, পেশাগত জীবন নেই এবং তার দায়-দায়িত্ব বলেও কিছু নেই। এভাবে দৃশ্য সাজালে সেটি আর নাটক মনে হয় না, মনে হয় জীবন্তিকা। যেমন নাটকের নায়ক মাসুমের প্রায় সব দৃশ্যই খেলার মাঠে, না হয় খাবারের টেবিলে। ব্যক্তিগত জীবনে সে পড়ালেখা করে না চাকরি করে—সেসব নিয়ে একটি দৃশ্যও নেই। আবার নায়িকা রুমারও একই অবস্থা, তার দৃশ্য মানেই দুই বান্ধবীর সঙ্গে মাসুমকে নিয়ে গসিপ। এভাবে কেবল দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজালেই তো নাটক হয় না। পুরো নাটকের মধ্যে একটি চরিত্রকেই মনে হয়েছে জীবন্ত, সেটি ঠিকাদার জাফর। আর সেই চরিত্রে ফারুক আহমেদের অভিনয়ও ছিল অসাধারণ। এ ছাড়া বাকি সব চরিত্রই প্রায় মৃত, না হয় অর্ধমৃত।