শাফিনকে নিয়ে যা বললেন তাঁরা

মাইলস ব্যান্ডের সদস্যরা
মাইলস ব্যান্ডের সদস্যরা

গানের দল মাইলস ভাঙনের মুখে—মাস দুয়েক ধরে সংগীতাঙ্গনে এমন কথা শোনা যাচ্ছে। এদিকে সম্প্রতি দেশে ও দেশের বাইরের কয়েকটি স্টেজ শোতে দেখা যায়নি শাফিন আহমেদকে। তাই ভক্তদের মনে নানা সন্দেহ তৈরি হয়। বিষয়টি নিয়ে ১০ ডিসেম্বর প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন মাইলসের অন্যতম সদস্য শাফিন আহমেদ। তিনি মাইলস নিয়ে তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেন। কিন্তু শাফিনের বক্তব্যে মাইলসের অন্য সদস্যদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এরপর শাফিন আহমেদের ব্যাপারে খোলামেলা কথা বলেছেন ব্যান্ডের বাকি চার সদস্য হামিন আহমেদ, মানাম আহমেদ, জুয়েল ও তূর্য।

মাইলসের আজকের অবস্থানের জন্য পুরো ক্রেডিট নিচ্ছেন শাফিন আহমেদ।
হামিন আহমেদ: মাইলস এমন একটা ব্যান্ড, এটা এক বছরের না, এক মাসের না, আবার পাঁচ বছরেরও না। ৩৫ বছর পার করা একটা ব্যান্ড বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে কতটা অবদান রেখেছে, তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। সে দাবি করেছে ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। প্রথমেই বলতে চাই, সে ভুল বলেছে।

শাফিন আহমেদ বলেছেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তিনি সরে গেছেন। তা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মাইলস কোনো কার্যক্রম চালাতে পারবে না।
হামিন আহমেদ: মাইলস তার কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে। ব্যান্ডের সঙ্গে এত বছর সম্পৃক্ত থাকার পরও কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই শাফিন আহমেদ সব কর্মকাণ্ডে অনুপস্থিত। এই অনুপস্থিতির কারণ ব্যান্ডকে জানানো কিংবা ভাই হিসেবে আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি! মাইলস শ্রোতাদের কাছে দায়বদ্ধ ব্যান্ড, মাইলস কমিটমেন্ট রক্ষা করে যাচ্ছে। এই ব্যান্ড একক কারও সিদ্ধান্তে চলে না। এখানে সবার মতামত গুরুত্বপূর্ণ, এটাই মাইলসের সৌন্দর্য। এর আগেও মাইলসে পরিবর্তন এসেছে। শাফিন আগেই একবার বের হয়ে গিয়েছিল। তখন অনেক কথা বলেছে। আবার সমঝোতা করে ব্যান্ডে ঢুকেছে।
মানাম আহমেদ: শাফিন যেভাবে কথা বলেছে, দাম্ভিকতা দেখিয়েছে, আস্ফালন করেছে—এসবের কারণে মাইলস এবং মাইলসের সদস্যেদের সঙ্গে তার সম্পর্কের বড় গ্যাপ তৈরি হয়। আমরা বিশ্বাসের ওপর কাজ করছি। একে অপরের প্রতি সম্মান আছে। তাই তারও উচিত অন্যদের প্রতি সম্মান নিয়ে কথা বলা।
হামিন আহমেদ: ৩৬ বছর ধরে যে ব্যান্ডের সঙ্গে শাফিন আহমেদ বাজিয়েছে, যাঁদের সুরকে পুঁজি করে ও শাফিন আহমেদ হয়েছে, তাঁদের নিয়ে এভাবে কথা বলার আগে ওর ভাবা উচিত ছিল। এটা বুঝতে হবে, তার জন্ম কিন্তু মাইলস থেকে। আমরা যখন মাইলসে যোগ দিই, তখন সবাই তরুণ ছিলাম। আমি কোন পরিবার থেকে এসেছি, সেটা ভিন্ন কথা। আজকে শাফিন, হামিন, মানাম, তূর্য, জুয়েল—তাদের সবার পরিচয় কিন্তু মাইলস।

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সূত্রপাত কোথায়?
হামিন আহমেদ: শাফিন আহমেদ ছয় বছর লন্ডনে ছিল, তখনো মাইলস ছিল। যখন দেশে ফিরেছে, তখন তাকে মাইলসে কে জায়গা করে দিয়েছিল? এই হামিন আহমেদ ও মানাম আহমেদ। আমরা বাংলা গান যখন শুরু করেছি, তখন কে গাইবে, তা একক সিদ্ধান্তে হয়নি। তিনজনের পরিকল্পনায় হয়েছে। সম্মান বজায় রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। আমরা যদি একসঙ্গে কাজ না করতে পারি, তাহলে সম্মান নিয়ে সরে যাব। আমরা ঢাকায় দুটি শো করেছি, সে যায়নি! ৩৬ বছর পর একজন সদস্য এসে যদি কোনো কারণ ছাড়াই এমন আচরণ করে, তাহলে আমরাও জানতে চাই, কেন? কানাডার ট্যুরেও যে যায়নি, তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।

তিনি জুনিয়র সদস্যদের বেয়াদবির কথা বলছেন।
হামিন আহমেদ: বেয়াদবি বলতে কী বোঝায়! শাফিন যে স্বার্থসিদ্ধি করতে চেয়েছে, তা করতে দেয়নি বলে বেয়াদবি হয়ে গেছে। ছোটরা বেয়াদবি করবে আর আমরা দুজন বসে দেখব! শাফিন যে মনোভাব ব্যক্ত করেছে, তা দুঃখজনক। মাইলসের কারণে সে শাফিন আহমেদ হয়েছে। ‘চাঁদ তারা’, ‘ধিকি ধিকি’, ‘পিয়াসি মন’, ‘জ্বালা জ্বালা’, ‘ফিরিয়ে দাও আমারই প্রেম’—এগুলো কার সুর? আমাদের শুরুটাই হয়েছে মাইলস দিয়ে। দ্বিতীয়ত, শাফিন আহমেদ তার সুর করা গান গেয়েছে? একটা নাম বলতে পারবে?
মানাম আহমেদ: ব্যান্ড কারও ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, এটা সমষ্টিগত সম্পদ। সবাই মিলে একটা ব্যান্ড। তাই আমিত্ব ব্যান্ডে চলে না।
হামিন আহমেদ: আমরা একসঙ্গে কথা বলছি, তাতে প্রমাণিত হয়, আমরা মাইলসেই আছি।
জুয়েল: মাইলস কিন্তু অন্য কোনো ব্যান্ডের মতো না। এখানে প্রত্যেক সদস্য সবদিক দিয়ে সমান। সবকিছুতে সমান ভাগ ও সমান সম্মান নিয়ে কাজ করে। শাফিন ভাইয়ের সঙ্গে বেয়াদবি করার প্রশ্নই আসে না। আমি সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য, তাও ১৯ বছর ধরেই আছি। সম্মান যদি না দিই, হামিন ভাই ও মানাম ভাই আমাদের ছেড়ে দেবেন? এখন যদি ব্যান্ডের চেয়ে নিজেকে বড় মনে করি, তাহলে পুরো ব্যাপারটি কঠিন হয়ে দাঁড়াবে, এটাই স্বাভাবিক।
মানাম আহমেদ: জুয়েল, তুমি শাফিনের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার কথা কেন বলছ না? সে যদি দাবি করে, সে এই ব্যান্ডের অংশ, তাহলে মনোমালিন্য হলে তা সমাধান করার উদ্যোগ নেবে। এর আগে একবার মাইলস থেকে বের হয়ে নতুন ব্যান্ড গঠন করে। একজন মানুষ যদি আরেকটা ব্যান্ড গঠন করতে পারে, তাহলে প্রমাণিত হয়, সে একক ক্যারিয়ার নিয়ে বেশি চিন্তিত। এর জন্য তো তাকে কিছু ফালতু অভিযোগ করতে হবে। এই বয়সে এসব যুক্তি অযৌক্তিক মনে হয়। আমরা জানি আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি।

শাফিন আহমেদ একক ক্যারিয়ার গড়তে চান?
মানাম আহমেদ: তিনি তা-ই গড়তে চান। এসব কর্মকাণ্ড তার ইঙ্গিত। অনেক দিন ধরে এর জন্য কাঠখড় পোড়াচ্ছেন। একক অ্যালবাম করেছেন। এসব তাঁরই লেখা আর সুর করা, এমনকি তাঁরই বাজানো। কেউ বলতে পারবেন, তাঁর একটা গান হিট হয়েছে? ব্যান্ডে তো আমরা তাঁকে সামনে দিচ্ছি, এটাতে তাঁর পেট ভারছে না। তিনি আরও চান? কোনো কিছু না বলে কেউ একজন যদি নিজেকে ব্যান্ড থেকে সরিয়ে রাখে, এর অর্থ কী? আমাদের কাছে এসে তাঁর বলতে হবে, কেন তিনি এসব করছেন?
হামিন আহমেদ: নিজের ইচ্ছায় সে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে। কারও জন্য মাইলসের কার্যক্রম থামেনি। সে যেহেতু নিজের ইচ্ছায় সরে গেছে, তাকে এসে এর ব্যাখ্যা দিতে হবে। কানাডা ট্যুর থেকে শেষ মুহূর্তে সে নিজেকে সরিয়ে নেয়। একটা বিদেশি ট্যুরে অনেক প্রস্তুতির ব্যাপার থাকে। এটা এক দিনের কোনো কাজ না। আয়োজকেরাও বিনিয়োগ করেন। তার কারণে মাইলস বিদেশ সফর বাতিল করবে? আমরা সবার সঙ্গে কমিটমেন্ট রক্ষা করে চলছি। মানামের ছেলে মারা গেছে, ওর মানসিক অবস্থা ভীষণ খারাপ ছিল, এরপরও সে আমাদের সঙ্গে ছিল। কিন্তু শাফিন কেন যাবে না, সেই ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন করেনি।

মাইলসের সঙ্গে শাফিন আহমেদ আছেন?
হামিন আহমেদ: মাইলসের ঐতিহ্য আছে। আমাদের আত্মসম্মান আছে, তাই আমরা খারাপ নিদর্শন নিয়ে চলতে চাই না। শাফিন আহমেদ আগে নিজেকে সংশোধন করবে। তা না হলে এই আমি হামিন আহমেদের তাঁর সঙ্গে গান করার কোনো ইচ্ছে নেই।
মানাম: আমারও নেই।
জুয়েল: আমারও নেই।
তূর্য: আমারও নেই।

হামিন আহমেদকে বলছি, শাফিন আহমেদ তো আপনার ভাই।
হামিন আহমেদ: সবই তো বুঝলাম। সে যদি নিজের ভাইয়ের মর্যাদা রক্ষা করতে না পারে, তাকে নিয়ে কিছু বলা ঠিক হবে না। ওর সম্পর্ক আর কিছু বলতে গেলে নিজেকেই ছোট করা হবে।

মানাম আহমেদ, তিনি তো আপনার বন্ধু।
মানাম আহমেদ: আমি যাকে বন্ধু বলি, তাকে সম্মান করি। আমিও তেমনটাই প্রত্যাশা করব। সম্মান না করুক, কিন্তু অসম্মানজনক কথা আর কাজ তার কাছ থেকে প্রত্যাশা করতে পারি না। সে সামনে থেকে গান গেয়েছে, মাইলসের মাধ্যমে পরিচিতি পেয়েছে, তার মানে এই নয়, আমরা তার অধীনে কাজ করছি। মাইলসের একজন সদস্যের যে গুণ থাকা দরকার, তা যদি কারও না থাকে, সে এই ব্যান্ডে থাকতে পারবে না।

শাফিন আহমেদ বলেছেন, অভ্যন্তরীণ সমস্যা না মিটলে ব্যান্ডের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
মানাম আহমেদ: মাইলসের কার্যক্রম চলবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ কোনো সমস্যা নেই।

তিনি আপনাদের কাছে কোনো সমস্যার কথা বলেছেন?
হামিন আহমেদ: ‘প্রতিচ্ছবি ডিলাক্স’ অ্যালবামের প্রকাশনার সময় তাকে বলেছিলাম, প্রচারণায় তুমি নেই কেন? ও বলেছিল, ‘ডোন্ট বদার মি।’
মানাম আহমেদ: একপর্যায়ে সে বলেছে, তার কারণেই নাকি আমরা খেয়েপরে বেঁচে আছি। এ রকম দাম্ভিকতা যে দেখাতে পারে, তার সঙ্গে কীভাবে কাজ করব!

হামিন আহমেদ, আপনি তো বামবার সভাপতি। ব্যান্ডের বিভিন্ন সমস্যায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। মাইলসের সমস্যা নিয়ে কী ভাবছেন?
হামিন আহমেদ: সেটা পরের কথা, প্রথম কথা হচ্ছে, এ মুহূর্তে তাকে ছাড়া মাইলস সম্পূর্ণ। মাইলস নিয়ে যে হুমকিধমকি দিয়েছে, তা আমরা কেয়ার করছি না। মাইলস তার কার্যক্রম শতভাগ চালিয়ে যাবে।
মানাম আহমেদ: মাইলস কোনো সদস্যের জন্য বসে থাকবে না।

মাইলস ব্যান্ডের জুনিয়র সদস্য হিসেবে এই সমস্যা নিয়ে জুয়েল আর তূর্য কী বলবেন?
জুয়েল: মিউজিশিয়ান শাফিন আহমেদকে নিয়ে বলার কিছু নেই। কিন্তু মানুষ হিসেবে তিনি যা বলছেন, তা আমাদের জন্য দুঃখজনক।
তূর্য: আমি মাইলস ব্যান্ডে ২২ বছর বাজাচ্ছি। এ পর্যায়ে এসে এমন ঘটনা দুঃখজনক। আমাদের মানসিকতা একসঙ্গে কাজ করছে না বলেই এমনটা হচ্ছে।
মানাম আহমেদ: ১৯৭৯ সালে মাইলস গঠিত হয়। প্রথমে হামিন যোগ দিয়েছে। এরপর সে-ই শাফিনকে নিয়ে আসে। পরে আমি যোগ দিই। এই হচ্ছে গোড়ার কথা।
তূর্য: আমার অর্ধেক জীবন মাইলসের সঙ্গে বাজাচ্ছি। এত দূর এসেছি কিন্তু তাঁদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায়। বড় ভাই শিক্ষক আর অভিভাবক, আমাদের ক্ষেত্রে তাঁরা তা-ই।
জুয়েল: শাফিন ভাই বরাবরই রিজার্ভ ছিলেন। হামিন ভাই ও মানাম ভাই—ছোট ভাইয়ের মতো সব সময় আদর করেছেন। আমাদের আবদার রক্ষা করে চলছেন। মাইলসের আগে আমি ১০ বছর গানের সঙ্গে ছিলাম। আমি মাইলসে যোগ দেওয়ার পর মনে হয়েছে, আমি নিজে কিছু শিখেছি। বন্ধুর মতো সবাই আমাদের গ্রহণ করেছেন।
মানাম আহমেদ: এই ব্যান্ডে একমাত্র কেউ যদি থাকে, তিনি হামিন আহমেদ, যিনি কখনো তাঁর কমিটমেন্ট থেকে পিছপা হয়নি। যেকোনো ক্রাইসিস মুহূর্তে এই মানুষটি সবাইকে আগলে রেখেছেন।

শাফিন আহমেদকে নিয়ে শেষ কথা শুনতে চাই।
হামিন আহমেদ: শাফিন আহমেদ মাইলসের সদস্য ছিলেন। হামিন আহমেদ, মানাম আহমেদ আজকে না থাকলে মাইলসের কিছু হবে না।
মানাম আহমেদ: আমরা গান করে যাব। আমরা একক ক্যারিয়ার গড়তে চাইনি। শাফিন তা-ই ভেবেছে। শাফিনকে ছাড়াই আমরা ‘প্রিয়তমা মেঘ’ শ্রোতাদের দিয়েছি। মাইলসের নিজস্ব একটা স্টাইল আছে। এই স্টাইল শ্রোতারা পছন্দ করে। এখানে ব্যক্তি মুখ্য নয়।