'কঞ্জুস'-এর ৭০০

কঞ্জুস নাটকের একটি দৃশ্যে ১১ জন শিল্পী। আজ তাঁরাই ৭০০তম প্রদর্শনীতে অংশ নেবেন l ফাইল ছবি
কঞ্জুস নাটকের একটি দৃশ্যে ১১ জন শিল্পী। আজ তাঁরাই ৭০০তম প্রদর্শনীতে অংশ নেবেন l ফাইল ছবি

কঞ্জুস নাটকটি পুরোনো হয় না। সেই যে শুরু হলো ১৯৮৭ সালের ৮ মে, এখন পর্যন্ত মঞ্চ মাতিয়ে রেখেছে নাটকটি। লোকনাট্য দলের অনবদ্য এই নাটকের ৭০০তম মঞ্চায়ন হতে যাচ্ছে আজ শুক্রবার, শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মঞ্চে। বাংলাদেশের কোনো মঞ্চনাটকের এটাই প্রথম ৭০০তম প্রদর্শনী। এ এক প্রেরণাদায়ক ঘটনা।

৩০ বছর ধরে নাটকটি মঞ্চায়ন করছে লোক নাট্যদল। অবশ্য কঞ্জুস নাটকের ইতিহাস আরও পুরোনো। ১৯৮২ সালে ভারতের ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এনএসডি) থেকে বেশ কজন নাট্যকর্মী পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফেরেন। দেশে ফিরে তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাট্যদল’ নামের একটি মঞ্চনাটকের দল। সঙ্গে আরও কয়েকজন। এর মধ্যে আছেন সৈয়দ জামিল আহমেদ, তারিক আনাম খান, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, গোলাম সারোয়ার, লিয়াকত আলী লাকী, কামাল উদ্দিন নীলু প্রমুখ। তারিক আনাম খান ফরাসি নাট্যকার মলিয়েরের দ্য মাইজার অবলম্বনে অনুবাদ করলেন কঞ্জুস নাটকটি। ১৯৮৩ সালের প্রথম দিকে নাটকটি মঞ্চে আনা হলো। শুরু থেকেই নাটকটি নিয়ে দর্শকের সাড়া পাওয়া গেল। সেই থেকে কঞ্জুস নাটকটির নিয়মিত প্রদর্শনী চলছে।

কামাল উদ্দিন নীলু নির্দেশিত নাটকটি পুরোটাই বাংলাদেশি আমেজে। সংলাপ বলা হয় পুরান ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায়। ১০টি প্রদর্শনী হওয়ার পর ১৯৮৭ সালে নাটকটি সম্প্রচারিত হয় বিটিভিতে। তারপর নাট্যদল আর নাটকটি মঞ্চস্থ করেনি। পরে নতুন আঙ্গিকে নাটকটি মঞ্চে আনে লোক নাট্যদল। নির্দেশনা দেন লিয়াকত আলী লাকী।

লোক নাট্যদলের প্রধান লিয়াকত আলী বললেন, জীবদ্দশায় মলিয়ের সমালোচকদের দ্বারা নানাভাবে সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর নাটক দেশে দেশে মানুষের মধ্যে কত যে শক্তি সঞ্চয় করেছে, তা কঞ্জুস নাটকটি দিয়েই বোঝা যায়।

বরাবরই প্রশংসা পেয়েছ কঞ্জুস। এগিয়ে থেকেছে প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে। ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের সাম্মানিক বিশ্ব সভাপতি রামেন্দু মজুমদার বলেন, প্রযোজনাটি গল্প, সংলাপ আর অভিনয় মিলিয়ে দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে কমেডি আর কঞ্জুস সমার্থক হয়ে গেছে। নাট্য নির্দেশক আতাউর রহমান বলেন, কঞ্জুস নাট্য প্রযোজনা আমাদের দেশে মঞ্চায়নের পরিসংখ্যানে মাইলফলক। দীর্ঘ মঞ্চায়নের পরিক্রমায় এর নির্দেশক দর্শক রুচির সঙ্গে সংগতি রক্ষার জন্য বিভিন্ন সময়ে নাটকটির পরিবর্তন ও পরিমার্জন করছেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি বজায় রেখে প্রযোজনাকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন।

৩০তম থেকে ৫০০তম প্রদর্শনী পর্যন্ত কঞ্জুস নাটকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন নরসিংদীর পলাশ শিল্পাঞ্চল সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক আনিসুর রহমান। তিনি মনে করেন, মঞ্চে দর্শকদের নাটক দেখতে উত্সাহিত করার জন্য কঞ্জুস-এর ভূমিকা অনেক।

নাটকটির শততম প্রদর্শনী হয় ১৯৯৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। ৪০০তম প্রদর্শনী হয় ২০০১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর নাটকটির ৫০০তম প্রদর্শনী হয়। এর মধ্যে ১৯৮৮ (লোক নাট্যদল টিএসসি) ও ২০০৫ সালে (লোক নাট্যদল বনানী) লোক নাট্যদল বিভক্ত হয়। পরে লোক নাট্যদল টিএসসি আর সক্রিয় থাকেনি। লোক নাট্যদল, বনানী অন্য নাটকসহ কঞ্জুস নিয়ে তাদের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।

শুরু থেকে নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ইমামুল হক। বর্তমানে তিনি কানাডাপ্রবাসী। ঢাকায় এসেছেন। আজকের প্রদর্শনীতে দর্শকের সারিতে তাঁর থাকার কথা। তিনি বলেন, ‘প্রবাসজীবনে এখনো অনেকেই আমাকে এই নাটকের কথা জিজ্ঞেস করেন, যা আমাকে আবেগতাড়িত করে।’

শুধু জনপ্রিয়তা আর দর্শক নয়, দেশে ও বিদেশে বহুবার পুরস্কার অর্জন করেছে কঞ্জুস। ১৯৯৩ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অলিম্পিকে অন্যতম সেরা প্রযোজনার পুরস্কার পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় একাধিক বিভাগে পুরস্কৃত হয়েছে। ইউরোপের মোনাকোয় অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব থিয়েটার উৎসব-২০১৩’তে অংশগ্রহণ করে প্রশংসিত হয়। যুক্তরাজ্যের ব্র্যাডি সেন্টারেও কঞ্জুস-এর উপস্থাপনা দর্শকনন্দিত হয়।

 কঞ্জুস পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জীবন ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে রূপান্তরিত, যাঁরা উর্দু ও বাংলা ভাষার মিশ্রণে এক বিশেষ ধারায় কথা বলেন। তাঁদের জীবনধারার আবহ তৈরি করার জন্য এই নাটকে পুরোনো দিনের জনপ্রিয় সব হিন্দি গান ব্যবহৃত হয়েছে। আজ কঞ্জুস নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করবেন আজিজুর রহমান, জিয়াউদ্দিন শিপন, রুবেল শংকর, মাসুদ সুমন, আবু বকর বকশী, ঈশিতা চাকি, খাদিজা মোস্তারি, শাহরিয়া কামাল, প্রিয়াঙ্কা বিশ্বাস, স্বদেশ রঞ্জন দাশগুপ্ত এবং জুলফিকার আলী। নাটক প্রদর্শনীর আগে সন্ধ্যা ছয়টায় শিল্পকলা একাডেমির লবিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাড়ে ছয়টায় মূল মঞ্চে আলোচনা এবং সাতটায় নাটক প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করেছে লোক নাট্যদল।