'পারফরমার' হওয়ার স্বপ্ন মনোজের

মনোজ কুমার
মনোজ কুমার

বাবা ও নানা নিয়মিত যাত্রায় অভিনয় করতেন। মা করতেন গান। এমন না যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসের নিতাইয়ের মতো ডোম গোত্রের ছেলে কবি হয়েছে। পুরোদস্তুর শিল্পমনা পরিবারের মধ্যেই বড় হয়েছেন মনোজ কুমার। কিছু বিজ্ঞাপন এবং এ বছরের বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় নাটকে অভিনয় করে চিনিয়েছেন নিজেকে। তবে এই চেনানোর জায়গাটা তৈরির জন্য কম কষ্ট করতে হয়নি। বাবা-চাচা কিংবা মামারা যাত্রা নিয়ে মেতে থাকলে কী হবে, পরিবারের ছেলে যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগে ভর্তির জন্য মনস্থির করলেন, তখন ঠিকই বাধা এসেছিল। ‘এসব করে কি জীবনে কিছু হবে?’ এই প্রশ্নটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়েছিল মনোজের জন্য। সেই চ্যালেঞ্জ কি জয় করেছেন?

মনোজ পেছনে ফিরে তাকান। ২০০৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এসেছেন ঢাকায়। নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর থানার রাধানগর গ্রামে বেড়ে ওঠা ছেলেটির এই শহরের কোনো কিছুই চেনা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থিসিসের একটা সূত্র ধরে নির্মাতা অমিতাভ রেজার সঙ্গে একবার পরিচয় হয়েছিল। সেই পরিচয়টাই কাজে লাগান ঢাকায় এসে। একটা ‘ইন্টারভিউ’ দিয়ে তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। এটাই আসলে মিডিয়া ও ঢাকা শহরের সঙ্গে ‘পরিচয়’পর্ব তাঁর। এসব গল্প শোনাতেই সম্প্রতি প্রথম আলোয় এসেছিলেন মনোজ কুমার। গল্প চলতে থাকে আমাদের।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ২০০৬ সালের দিকে রাজিবুল হোসেনের বালু ঘড়ি নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ২০১০ সালে গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপনে। তবে মনোজের দাবি, তাঁকে বেশি মানুষ চিনেছেন ২০১৪ সালে প্রচারিত ক্লোজআপ কাছে আসার গল্পের একটা বিজ্ঞাপনে। মাঝে টুকটাক কাজ করলেও বলার মতো না।

তবে বলার মতো না হলেও মনোজের ভাষায়, ‘মাঝে কিছু ইতিহাস আছে’? কী সেই ইতিহাস? মনোজ চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, ‘মাঝে আমি কিছুদিনের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলাম শিক্ষক হিসেবে। বছরখানেকের এই চাকরি শেষ করে আবার ঢাকায় এসেছিলাম। কিন্তু ওই সময়টা আমার জন্য আসলে যুদ্ধের মতো। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নির্মাণ নয়, অভিনয় করব। এর জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করেছি। তখন খুব খারাপ সময় পার করেছি।’

মনোজের সৌভাগ্য, এই যুদ্ধটা করতে করতে পেয়ে যান দুটি উপস্থাপনার কাজ। নিয়মিত অনুষ্ঠান বিধায় টাকাপয়সার কষ্টটা কমে যায়। মাঝে ধারাবাহিক ও একক নাটকে অভিনয় চলতে থাকে।
মনোজ বলেন, ‘আমি প্রায় ৪০-৫০টা নাটক করেছি। নাটকগুলো কিন্তু খুবই ভালো। কিন্তু মানুষ অতটা চেনেনি কেন, এটা একটা রহস্য। গেল দুই ঈদে যথাক্রমে ফুল ফোটানোর খেলা ও কথা হবে তো? নাটক দুটি পরিবর্তন করে দিয়েছে আমাকে। এখন বাইরে বের হলেই মানুষ চেনেন।’

মনোজ পরিচালনা শিখেছেন, অভিনয় করেন। তবে ‘নায়ক’ হতে অভিনয় করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করতে চান। তাঁর ভালো লাগার তালিকায় আছে হুমায়ুন ফরীদি, টম হ্যাংকস, নওয়াজউদ্দিন, আমির খানের অভিনয়।

ভালো অভিনেতা হওয়ার পাশাপাশি একজন ভালো শিক্ষক হিসেবেও কদর বাড়ছে তাঁর। ময়মনসিংহের ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন গেল বছর। মনোজের ধারণা, অভিনয় বাবা-দাদুর রক্ত থেকে পাওয়া, শিক্ষকতাও। কারণ, বাবা ছিলেন কলেজের প্রিন্সিপাল, দাদা স্কুলের শিক্ষক।

মনোজ সেরা অভিনেতা ও সেরা শিক্ষক—দুটি স্বপ্ন নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবে একটা ‘কমন’ প্রশ্ন তাঁর সামনে এসে পড়ে। তিনি উত্তর দেন এভাবে, ‘দুইটা কাছাকাছি। একটা চরিত্রে যখন অভিনয় করতে যাই, তখন আমাকে চিত্রনাট্যটা পড়ে ওই চরিত্রের ফর্মে ঢুকতে হয়। তারপর অভিনয়টা শুরু হয়। ক্লাস নেওয়াটাও একই রকম। যাওয়ার আগে আমাকে প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হয়, আমি আসলে আজ কী পড়াব। আমার মনে হয়, একেকজন শিক্ষক সেরা পারফরমার। আমার মনে হয়, প্রত্যেকটা মানুষই যার যার জায়গায় পারফরমার। যে যতটা ভালো করবে, সে-ই টিকে থাকবে।’