সরাসরি গানের অনুষ্ঠানে দর্শকই প্রাণ

‘তোমায় গান শোনাব’ অনুষ্ঠানে মাহমুদ সেলিম
‘তোমায় গান শোনাব’ অনুষ্ঠানে মাহমুদ সেলিম

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে টেলিভিশনের অন্যান্য অনুষ্ঠানের মাঝে বিশেষ আকর্ষণ ছিল বিজয় দিবসের বিশেষ নাটক। ১৬ ডিসেম্বর রাত ৯টায় একযোগে বেশ কয়েকটি চ্যানেলে শুরু হলো বিজয় দিবসের বিশেষ নাটক। মাছরাঙায় শুরু হলো অবাক করা ছেলেটি, এনটিভিতে পিয়ানো, বিটিভিতে বাবার বায়নোকুলার, আরটিভিতে সেন্টিমেন্টাল সেলিম। এর মাঝ থেকে আমরা আলোচনার জন্য বেছে নিয়েছি মাছরাঙায় প্রচারিত ও ইভান রেহান পরিচালিত নাটক অবাক করা ছেলেটি। অভিনয় করেছেন রওনক হাসান, ঈশানা, শতাব্দী ওয়াদুদ প্রমুখ।

নাটকের গল্পটি সংক্ষেপে এ রকম-রওনক হাসান জার্মানপ্রবাসী বাঙালি, দেশে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহের জন্য। তাকে সহযোগিতা করছে তার ফেসবুক বান্ধবী ঈশানা। ঈশানা প্রথমেই নিয়ে যায় তার মামার কাছে, মামা একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক। সেখানে সাক্ষাৎ হয় মামার অফিসের দারোয়ান শতাব্দী ওয়াদুদের সঙ্গে, সে উচ্চারণ করে হারাগাছি নামটি। রওনক কৌতূহলী হয়ে তার কাছে হারাগাছি সম্পর্কে জানতে চায়, কিন্তু ওয়াদুদ কিছুই জানে না বলে নিজেকে লুকায়। এদিকে মামাও বারবার এ প্রসঙ্গ পাশ কাটিয়ে যায়। এরপর রওনক ও ঈশানা হারাগাছি ঘুরে এসে ওয়াদুদের মুখোমুখি হলে সে সব বলে দেয়। সে স্ত্রী-পুত্রহারা একজন অসহায় মুক্তিযোদ্ধা আর ঈশানার মামা আলবদর। পঁচাত্তরের পর সে মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক হয়ে ওয়াদুদকে দারোয়ানের চাকরি দিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছে। এরপর রওনক ওয়াদুদকে জানায়, সে-ই তার হারানো সন্তান। রওনক আর ঈশানা মামার সামনে গিয়ে তার মুখোশ খুলে দেয় এবং জানায় তারা ওর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালে মামলা করবে।

নাটকের গল্পে কিছুটা গতানুগতিকতা পরিলক্ষিত। কেননা আমরা ইতিপূর্বে বেশ কয়েকটি নাটকে বীরাঙ্গনার প্রবাসী সন্তান দেশে ফিরে আত্মপরিচয়ের সন্ধান করছে, বাবা-মায়ের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে, এমন দেখেছি। এ নাটকেরও পটভূমি একই। দু-একটি ত্রুটি-বিচ্যুতির মাঝে বলা যায়, মামার মেকআপটি মনে হচ্ছিল যেন তুলা দিয়ে দাড়ি বানানো। এ ছাড়া রওনক হাসানকে ৪৭ বছর বয়সী মনে হয়নি, তার অভিনয়েও ছিল দুর্বলতার ছাপ। বিশেষ করে পিতৃপরিচয়ের পর সবার চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে অথচ সে নাক-মুখ দিয়ে শব্দ করেছে, অথচ চোখে কোনো পানি নেই। তবে শতাব্দী ওয়াদুদের অভিনয় ছিল অসাধারণ। চিত্রনাট্য ও পরিচালনা গ্রহণযোগ্য হলেও নাটকের নামকরণটি মোটেই আকর্ষণীয় মনে হয়নি।

১৫ ডিসেম্বর বেলা তিনটায় বাংলাভিশনে প্রচারিত হলো টেলিছবি পরিণতি। রচনা, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা ইমরাউল রাফাত। অভিনয়ে তাহসান, মেহজাবিন প্রমুখ।

ছবিটির গল্প সংক্ষেপে এ রকম-ধনীর কন্যা মেহজাবিনের বেডরুম ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের জন্য নিয়োগ দেওয়া হলো অচেনা ডিজাইনার তাহসানকে। এই সূত্রেই প্রথমে তাহসানের সঙ্গে হলো মেহজাবিনের প্রণয়, তারপর পরিণয়। এরপর হঠাৎই তাহসান আক্রান্ত হলো ডিমেনশিয়া রোগে। ফলে ক্রমেই সে স্মৃতিহীন হতে থাকল। এরপর প্রথমে বিপর্যয় নামল তার কর্মক্ষেত্রে, তারপর সংসারে। তারপর এক দিন হঠাৎ সে না বলে-কয়ে উধাও হয়ে গেল। আহত বিপর্যস্ত মেহজাবিন ফিরে এল পিতৃগৃহে। আবার তার অন্যত্র বাগদান হলো। তার হবু বরকে জানাল সব। তার সহায়তায় সে খুঁজে পেল তাহসানকে। সে হাসপাতালে তাহসানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে একে একে জানাল তার ক্ষোভ-যন্ত্রণা ও কষ্টের কথা। তাহসান সব শুনল, কিন্তু তাকে চিনল না। গল্প এ পর্যন্তই।

কিছুটা গতানুগতিক হলেও গল্পটি ছিল ভালোই। টেলিছবি উপযোগী। নির্মাণও ছিল বেশ পরিচ্ছন্ন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে লেখক ও নির্মাতা যেন মাত্রা রক্ষা করতে পারেননি। যেমন একজন অচেনা ইন্টেরিয়র ডিজাইনারের সঙ্গে পরিচয়পর্ব থেকেই মেহজাবিনের সংলাপ, আচরণ ও কথোপকথন এমনভাবে দেখানো হয়েছে, যেন তাদের প্রেম হয়েই আছে, শুধু সময়ের অপেক্ষা। আবার তাহসানের হঠাৎ অসুস্থ হওয়াটা যেন মনে হয়েছে আরোপিত। এমন ব্যতিক্রম একটি অসুখকে বিশ্বস্ত করে তোলাটা ছিল পরিচালকের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সে চ্যালেঞ্জে নির্মাতা মনে হয়েছে পুরোপুরি সফল হতে পারেননি।

আরেকটি বিষয়, মেহজাবিনের শুধু বাবাকে দেখানো হলেও তাহসানের পারিবারিক আবহটি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সে কি এতই এতিম, না অসামাজিক। তার বাবা-মা তো নেইই, এমনকি তার অসুস্থতার সময় কিংবা প্রেম বা বিয়ের সময় একজন বন্ধুবান্ধবও দেখানো হয়নি। বিষয়টি গল্পকে দুর্বল ও অবিশ্বস্ত করে ফেলেছে। বর্তমানে আমাদের লেখক ও নির্মাতারা স্বল্প চরিত্রের নাটক ও টেলিছবি নির্মাণ করতে গিয়ে যেন বাস্তবতা ও বিশ্বস্ততার খেই হারিয়ে ফেলছেন। ফলে নাটক-টেলিছবি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কখনো কখনো তা হচ্ছে প্রাণহীন ও অন্তঃসারশূন্য।

মাছরাঙা টিভিতে সরাসরি গানের অনুষ্ঠান ‘তোমায় গান শোনাব’ প্রচারিত হলো ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের রাত ১১টায়। অনুষ্ঠানে শিল্পী ছিলেন মাহমুদ সেলিম। প্রায় দুই ঘণ্টা একটানা গান করেছেন তিনি এবং অধিকাংশই করেছেন দেশের গান ও গণসংগীত। গানের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা ও নিবেদন প্রশংসনীয়। তাঁর গানের নির্বাচনও ছিল ব্যতিক্রমধর্মী এবং আকর্ষণীয়। তবে এর মাঝেও দু-একটি বিষয় আমাদের নজর কেড়েছে। যেমন তাঁর কণ্ঠটি বেশ চাপা। গণসংগীতগুলোর কথায় ও সুরে যে বলিষ্ঠতা ছিল, তাঁর কণ্ঠে যেন তা ফুটে ওঠেনি। আবার উঁচু পর্দায় যখন গান করেছেন, তখন মাঝে মাঝে তাঁর কণ্ঠ যেন সুরের পর্দা থেকে সরে গেছে। আরেকটি বিষয়, দর্শক-শ্রোতাদের অনুরোধ তিনি তেমন একটা রক্ষা করেননি। তাঁদের ফোনের জবাবেও তাঁকে আরেকটু আন্তরিক হওয়া উচিত ছিল। বুঝতে হবে, সরাসরি গানের অনুষ্ঠানে দর্শকই প্রাণ।