জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সেই সাক্ষাৎকার

>
জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। ছবি: খালেদ সরকার
জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। ছবি: খালেদ সরকার

বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকার প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৩ সালে ২৬ সেপ্টেম্বর। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মারা গেছেন তিনি। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সাক্ষাৎকারটি আবারও দেওয়া হলো।

জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা গানের সব্যসাচী মানুষ। জন্ম পশ্চিমবঙ্গের চন্দননগরে ১৯৩৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর। একসঙ্গে গান লেখেন, সুর করেন, গাইতেও জানেন। তবে যত-না গান লিখেছেন বা সুর করেছেন, সে তুলনায় গেয়েছেন অনেক কম। যতটুকু গেয়েছেন, তার বেশির ভাগই কালজয়ী হয়ে আছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন হারুন আল রশীদ।

প্রথম গান রেকর্ড করলেন কত সালে?
আমার প্রথম অ্যালবাম রেকর্ড বের হয় মেগাফোন থেকে। ১৯৬৩ সালে। বলতে গেলে সুধীনদা আমাকে হাতে ধরে মেগাফোনের দপ্তরে নিয়ে যান। অ্যালবামটির সব কটি গানের কথা ও সুর সুধীন দাশগুপ্ত নিজেই করেছিলেন। এরপর ১৯৬৪ সালে সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে মেগাফোন থেকেই বের হলোপাগল হাওয়া অ্যালবাম। পরের বছর দিলীপ সরকারের সুরে ওই মেগাফোন থেকেই আমার তৃতীয় অ্যালবাম বের হয়।

‘বধূয়া’ অ্যালবামটি কখন বের হয়?
একদিন আমার এক বন্ধু এসে বললেন, তুমি সব গান মেগাফোনে করছ কেন? এইচএমভি তোমাকে দিয়ে গান করাতে চায়। সেই সূত্রে ১৯৬৮ সালে এইচএমভি থেকে বের হয় ‘বধূয়া’ অ্যালবামটি। এই অ্যালবামের একটি গান তো সবাই শোনেন বা জানেন। ‘বধূয়া আমার চোখে জল এনেছে’। ১৯৭৪ সালে এইচএমভি থেকেই বের হয় এ কোন সকাল।

‘ফুলকে যেদিন’ গানটি কীভাবে এল?
হাজরা মোড় থেকে ট্রামে করে টালিগঞ্জ যাচ্ছি। ট্রামটা প্রায় খালি। আমার পেছনের সিটে বসেছিলেন দুই অবাঙালি। একজন আরেকজনকে বলছেন, আরে ইয়ার, ম্যায়নে জিতিবাজি হারি। ‘জিতিবাজি’ শব্দটি আমার কাছে দারুণ লাগল। লোকটি জেতাবাজিতে হেরে গেছে। ট্রামে বসেই গানের অর্ধেক তৈরি করে ফেললাম। ‘আমি ফুলকে যেদিন ধরে–বেঁধে আমার সাজি ভরেছি, আমি সেদিন থেকে জেতাবাজি হেরেছি।’ বাড়িতে যেতে যেতে পুরো গানটিই তৈরি হয়ে গেল।

গানটি পিন্টু ভট্টাচার্যের কণ্ঠে দিলেন কীভাবে?
সে আরেক মজার ঘটনা। পিন্টু ভট্টাচার্য আর আমি একদিন নৌকায় গঙ্গা পার হচ্ছিলাম। ওপারে গিয়ে মাছ ধরব। মাঝগঙ্গায় গিয়ে পিন্টু বলল, তুমি এই মাঝগঙ্গায় আমাকে একটা কথা দাও। কথা না রাখলে তোমার কিন্তু খারাপ হবে। আমি বললাম, কী কথা বলো তো। পিন্টু বলল, ‘আমি ফুলকে যেদিন’ গানটা তুমি আমাকে ছাড়া আর কাউকে দেবে না। আমি কথা দিলাম। এটা সত্তরের পরের কথা। গানটি রেকর্ড হয়েছে ১৯৭৪ সালে।

বাংলা গানের বিবর্তনে স্বর্ণযুগকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
রবীন্দ্রসংগীত তো চির–আধুনিক। তবে আক্ষরিক অর্থে আধুনিক গানের যাত্রা শুরু হয় নজরুলের গানের মধ্য দিয়ে। চল্লিশের দশকের পরে পুরোনো বাংলা গানের ধরন পাল্টে দেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরীরা। তাঁরা বুঝিয়ে দিলেন, গানের কথা মানে অনেক কিছু, শুধু নর-নারীর প্রেম নয়। এঁরা সবাই ভারতীয় গণনাট্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এঁদের হাত ধরেই বাংলা গানের উৎকর্ষটা চূড়ান্ত রূপ নেয় ষাটের দশকে, যা অব্যাহত ছিল আশির দশক পর্যন্ত। সে জন্য আজকাল আমরা ষাটের দশককে বাংলা গানের স্বর্ণযুগ বলে থাকি।

বর্তমানের শিল্পী ও গান সম্পর্কে আপনি কী ভাবেন?
এখন যেসব গান হচ্ছে, তার আমি কিছুই বুঝি না। সে জন্য মন্দ বলা যাবে না। তবে কবীর সুমন, নচিকেতা বা অঞ্জন দত্তরা খারাপ গায় না। তাদের গানের কথা খুবই শক্তিশালী। আজকালের শিল্পীদের ত্যাগের চেয়ে অর্জন বেশি। আমাদের সময় এইচএমভির স্টুডিওতে কোনো শীতাতপ যন্ত্র ছিল না। শীতের দিনেও স্টুডিওতে বসে ঘামতে হতো। আর গরমের দিনে তো জামা-কাপড় খুলে বসতে হতো। আমি নিজে দেখেছি, শ্যামল মিত্র খালি গায়ে বসে বসে গান করছেন, গায়ের গেঞ্জিটা কাঁধে। তার ওপর স্টুডিও ছিল দমদম এয়ারপোর্টের পাশে। যখন উড়োজাহাজ উড়াল দিত, তখনই মাঝপথে কাজ বন্ধ হয়ে যেত। আবার নতুন করে শুরু করতে হতো। সেই দিক থেকে আজকের শিল্পীরা সৌভাগ্যবান। কাজ অর্ধেক করে বাকিটা পরেও করা যায়।