বছরটি ছিল রিজওয়ানময়

িরজওয়ান নাটকের দৃশ্য
িরজওয়ান নাটকের দৃশ্য

টানা ১০ দিন একই নাটকের প্রদর্শনী ছিল। টিকিট নিয়ে পড়ে গিয়েছিল হুড়োহুড়ি। মঞ্চনাটকের ইতিহাসে এটি একটি ঘটনা বটে। রিজওয়ানের কল্যাণে এমন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল এ বছরই। মঞ্চের এই অভূতপূর্ব দৃশ্যের পাশাপাশি উৎসব আর নতুন নাটক মিলে বছরটি বেশ কেটেছে। দেশে প্রশংসিত হয়েছে যেমন বিদেশেও অনেক নাটকের অংশগ্রহণ ছিল। নাটকের জন্য এসেছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ ও শাবানা আজমিও।

নতুন বছর দরজায় কড়া নাড়ছে। বছর শেষে এ বছরের নাটকপাড়ার নানা খবর হালখাতায় জমা পড়ল। এই সবকিছু মিলে তৈরি হলো এ বছরের মঞ্চপাড়ার হাল হকিকত।

রিজওয়ান উন্মাদনা
প্রথমেই বলতে হয় ঢাকার মঞ্চে সৈয়দ জামিল আহমেদের আগমনের কথা। দুই যুগ আগে বিষাদ সিন্ধু তিনি মাতিয়ে তুলেছিলেন যে মঞ্চে, সেখানে তাঁর দেখা মিলল এ বছর। ঈদের দিন থেকে শুরু হয় এই নাট্য আসর। একটানা ১০ দিন চলে। ঢাকার মঞ্চে এক নাটকের টানা ১৯টি প্রদর্শনী এই প্রথম। নাটবাংলা নাটকটি মঞ্চে আনে। ঈদের আনন্দের পাশাপাশি নগরবাসী উপভোগ করে মঞ্চ নাটকের স্বাদ। আলোচনা, সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক ছাড়িয়ে নাটকটি মঞ্চপাড়ায় জমজমাট পরিবেশ এনেছিল। আগে ঈদে নাটকপাড়ার দরজা বন্ধ থাকত। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়, রিজওয়ান বছরের সবচেয়ে আলোচিত নাট্য আয়োজন।

নতুনের আহ্বান
বেশ কটি নতুন নাটক এ বছর মঞ্চে এসেছে। বছরের শুরুতেই আসে কবি চণ্ডিদাসের জীবনীভিত্তিক নাটক এথিক থিয়েটারের চণ্ডিদাস। এরপর নাট্যকার মাসুম রেজা নিয়ে আসেন সুরগাঁও। রচনা ও নির্দেশনা তাঁরই। ১৬ বছর পরে আবার নির্দেশক হিসেবে তাঁকে পাওয়া গেল। তাঁর নির্দেশিত প্রথম নাটক ছিল নিত্যপুরাণ। ২০০১ সালে নিত্যপুরাণ মঞ্চে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল বাংলা নাটকের ‘একলব্যকে’। দিলীপ চক্রবর্তীর অভিনয় ছিল একলব্যের বাণের মতোই। কিন্তু ২০০৫ সালে নাটকটি আর প্রদর্শিত হয়নি। মাসুম রেজা নাটকটি এ বছরের শেষ দিকে আবার মঞ্চে আনেন। ছিল মঞ্চ সারথি আতাউর রহমানের নির্দেশনায় শেক্সপিয়ারের নাটক হ্যামলেট। এ ছাড়া আরও যেসব নাটক মঞ্চে আসে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রাঙ্গণে মোরের দাঁড়াও জন্ম যদি তব বঙ্গে, ওপেন স্পেস থিয়েটারের টুয়েলভ অ্যাংরি মেন, থিয়েটারওয়ালা রেপার্টরির জবর আজব ভালোবাসা, মেঠোপথ থিয়েটারের অতঃপর মাধো, বিবর্তন যশোরের ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন, পদাতিক নাট্য সংসদের গুনজন বিবির পালা ইত্যাদি।

বর্ণিল উৎসবে
নতুন নাটকের পাশাপাশি নাটকপাড়ায় নাটকের উৎসবগুলো শোভা বাড়ায়। বছরের শুরুতেই প্রাঙ্গণে মোর আয়োজিত দুই বাংলার নাট্য মেলায় চাঙ্গা হয়ে ওঠে নাট্যাঙ্গন। বর্ণিল সজ্জা, বিকেল থেকে পথনাটক, গান, সেমিনার, কর্মশালায় ভরে ওঠে নাট্যশালা। রিজওয়ান-এর রেশ না কাটতেই শুরু হয় ‘গঙ্গা যমুনা নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব’। ছিল বাংলাদেশ ও ভারতের নাটক। পাশাপাশি ছিল প্রাঙ্গণে মোর নাট্যদলের নিজেদের সাতটি নাটক নিয়ে নাট্যসপ্তাহ। এরই মাঝে শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র থিয়েটার ক্যাম্পের ঘোষণা দেয়। আরণ্যকের ৪৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘পুষ্প ও মঙ্গল আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব’ও বেশ আলোড়ন তোলে। এ ছাড়া আরও অনেকগুলো উৎসব হয়, যা প্রাণ সঞ্চার করেছিল নাট্যপাড়ায়। উৎসব ও নতুন নাটকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাটক বিভাগও ছিল সরব।

দেশে-বিদেশে
নিজেদের নাটকের পাশাপাশি বিভিন্ন উৎসবে বিদেশি নাটকের দলগুলো বাংলাদেশে হরহামেশাই নাটক প্রদর্শন করে। তবে আলাদা করে দুটি আয়োজনের কথা বলতেই হয়। একটি নাসিরুদ্দিন শাহ অভিনীত ইসমাত আপাকে নাম। তাঁর নির্দেশিত ও অভিনীত এ এক অনন্য সৃষ্টি। নাটকে খ্যাতিমান লেখক ইসমাত চুঘতাইয়ের স্পষ্টবাদী ও বৈপ্লবিক লেখনীর মঞ্চরূপ দিয়েছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ। আর বছরের শেষ দিকে ভারতীয় কবি কাইফি আজমিকে মঞ্চে নিয়ে আসেন তাঁর কন্যা অভিনেত্রী শাবানা আজমি ও জামাতা গীতিকবি জাভেদ আখতার। বিদেশে গিয়েও প্রশংসিত হয়েছে দেশের কিছু প্রযোজনা। স্পেনে অনুষ্ঠিত আইটিআই কংগ্রেসে নাট্যপালা রূপচান সুন্দরী প্রদর্শিত করে বেশ প্রশংসিত হয়েছেন তরুণ নাট্যকর্মী সাইক সিদ্দিকী। দেশের বাইরে বিভিন্ন উৎসবে অংশ নিয়েছে বেশ কটি নাটক। এ ছাড়া ভারতে অনুষ্ঠিতব্য থিয়েটার অলিম্পিকেও কয়েকটি প্রযোজনা আমন্ত্রিত হয়েছে।

ব্যতিক্রম যত
বছরে অনেকগুলো ব্যতিক্রমী ঘটনাও ঘটেছে। কার্ল মাক্সের ১৯৯তম জন্মদিনে কার্ল মাক্স ইন সোহো নামে এক চরিত্র ও এক দৃশ্যের একটি নাটকের পাণ্ডুলিপি পাঠাভিনয় করেন মামুনুর রশীদ। বিউটি বোর্ডিং সাহিত্যিকদের আড্ডাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। সেখানেই তীরন্দাজ রেপার্টরি তাঁদের নাটক সারারাত্তির মঞ্চায়ন করে। ৪৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আরণ্যকের নাটক ইবলিশ-এ অভিনয় করলেন পুরোনো সব তারকা অভিনেতা। ৭০০তম প্রদর্শনীর মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলে লোকনাট্যদলের নাটক কঞ্জুস। বাংলাদেশের কোনো নাটকের এটিই সর্বোচ্চ প্রদর্শনী। নাটক দেখার পাশাপাশি এবার দর্শকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাটক নিয়ে বেশ আলোচনা, সমালোচনা ও তর্ক-বিতর্ক করতে দেখা যায়।

যে কথা থেকে যায়
প্রশংসা যেমন হয়েছে, সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে নাট্যাঙ্গনকে। উৎসবগুলোতে নতুন নাটকের অপ্রতুলতার কথা উৎসবের অতিথিরাই বললেন। রিজওয়ান উৎসব যেমন টেনে এনেছিল দর্শকদের, তেমনটি খুব কম দেখা গেছে বছরজুড়ে। এ ছাড়া বটতলা নাট্যদলের ক্রাচের কর্ণেল নাটকটি বেশ প্রশংসিত ও বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শিত হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমিতে এই নাটকের প্রদর্শনী হয়েছে মাত্র দুটি। দলটির তথ্যমতে, ২০১৬ সালের জুন মাস থেকে এ বছরের নভেম্বর পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমিতে আবেদন করা সত্ত্বেও তাঁরা কোনো হল পায়নি।
প্রশংসা থাকলে সমালোচনাও থাকে। তবু সবকিছু মিলে বছরটি নাটকের জন্য বেশ তাৎপর্যময় ছিল এ কথা সত্য।