'নারী শক্তিশালী হলে দেশ শক্তিশালী হবে'

ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক বারোটার সময় জুহুর অভিজাত ‘সান অ্যান্ড স্যান্ড’ হোটেলে এলেন বলিউডের ‘মি. ক্লিন’ অভিনেতা অক্ষয় কুমার। ‘টয়লেট: এক প্রেমকথা’র পর এবার তাঁর আগামী ছবির মাধ্যমে উঠে আসবে আরেকটি সামাজিক সমস্যা। টুইংকেল খান্না প্রযোজিত এবং আর বাল্কি পরিচালিত ‘প্যাড ম্যান’ ছবিতে নারীদের মাসিকসংক্রান্ত নানান কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে। ভারতের প্যাড ম্যান অরুণাচালাম মুরুগানান্থামের জীবন অবলম্বনে এই ছবিটি। ২৫ জানুয়ারি মুক্তি পাবে ‘প্যাড ম্যান’। পর্দার প্যাড ম্যান বলিউড সুপারস্টার অক্ষয় কুমারের মুখোমুখি প্রথম আলোর মুম্বাই প্রতিনিধি দেবারতি ভট্টাচার্য

২০১৭ কেমন কাটল?
বেশ ভালো কেটেছে।
২০১৮-এ রেজল্যুশন কী?

আপনি বলুন কী নেওয়া যায়। আমার তো কিছু মাথায় নেই। আমার এমন কোনো অভ্যাস, যা আপনি বদলাতে চান।

অক্ষয় কুমার
অক্ষয় কুমার

আপনি তো বলিউডের ‘মি. ক্লিন’। আপনাকে অনেকে আদর্শ মেনে চলে। আপনার কিই বা বদল করা যায়?
ধন্যবাদ, তাহলে ভাবছি, বছরে চারটার জায়গায় তিনটা ছবি করব। (সশব্দে হেসে)

বছরে পর পর চারটি সিনেমা। এখন আপনার কাছে দর্শকের প্রত্যাশাও অনেক বেশি। কোথাও কি একটু চাপ অনুভব করেন?

না না, কোনো চাপ নেই। সাড়ে ২৭ বছর এই ইন্ডাস্ট্রিতে। তাই আর এসব হয় না। বছরে চারটি ছবি করি। একেকটা ছবি করতে ৪৫ দিনের মতো লাগে। চারটি সিনেমা ২০০ দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। ১৬৫ দিন বেঁচে যায়। তখন কোথাও গিয়ে ফিতা কাটি। কোনো শো করি। হাতে অফুরন্ত সময় থাকে। এই সব করে সময় কাটাই।

নতুন বছরে নতুন কিছু শিখতে চান?

হ্যাঁ, আমি এখন ‘শোর্ড ফাইটিং’ শেখা শুরু করেছি। আমার আগামী ছবির প্রস্তুতি।
‘টয়লেট: এক প্রেম কথা’র পর আবার একটি সামাজিক সমস্যার কথা তুলে ধরলেন। এমন একটি সমস্যা, যা নিয়ে কেউ কখনো খুলে কথা বলেনি। আর ভারতে মেয়েদের মাসিকের

ব্যাপারে অনেক বেশি রক্ষণশীল। হঠাৎ সমাজের এই দিকটাই বেছে নিলেন কেন?

প্রথমে টুইংকেলের মাথায় এই আইডিয়াটা আসে। আমারও বিষয়টা খুবই ভালো লাগে। আমি নিজে অরুণাচালামের সঙ্গে দেখা করি। তাঁর জীবনের গল্প আমাকে ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ করে। একটা মানুষের নিজের স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা কোন পর্যায়ে যেতে পারে, তা তাঁকে দেখে শিখি। এরপর বাল্কি গল্পটি রচনা করে। আর সত্যি মেয়েদের মাসিককে ঘিরে আমাদের দেশে প্রচুর কুসংস্কার আছে। অনেক অন্ধবিশ্বাস আছে। আজও মেয়েরা সবার কাছে বিষয়টা লুকিয়ে রাখে। লজ্জা পায়। দেশের ৫০ কোটি নারীর মধ্যে ৮০ শতাংশ নারী স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার জানে না। এখনো তারা মাসিকের সময় মাটি, ছেঁড়া নোংরা কাপড়, গাছের পাতা, ছাই—এসব ব্যবহার করে। মাসের এই চার দিন মেয়েরা মন্দিরে যেতে পারে না। শোওয়ার জন্য তাদের আলাদা ব্যবস্থা করা হয়। আচার ছুঁতে পারবে না, প্রথম দুই দিন চুলে শ্যাম্পু দেওয়া যাবে না, রান্নাঘরে যেতে পারবে না—এ ধরনের নানান নিয়মের বেড়াজালে মেয়েদের বেঁধে রাখা হয়। অথচ আমাদের দেশের দক্ষিণের মেয়েদের যখন প্রথম মাসিক হয়, বাড়িতে পার্টি দেওয়া হয়। সবাই তাদের উপহার দেয়। দক্ষিণ ভারতে মাসিকের প্রথম দিন ধুমধাম করে উদ্যাপন করা হয়। মাসিক নিয়ে আমাদের দেশে ডকুমেন্টারি ছবিতেও খুলে কথা বলা হয় না। তবে এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য মেয়েদের প্রথমে সব লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে। নারী শক্তিশালী হলে দেশ শক্তিশালী হবে। যে গর্ভ থেকে আমাদের জন্ম হচ্ছে, সেই গর্ভকে প্রথমে শক্তিশালী হতে হবে।

আপনি কি মনে করেন, আপনার এই ছবি সমাজে পরিবর্তন আনবে?

আমার আগের ছবি টয়লেট: এক প্রেমকথা নিয়েও অনেকের মনে দ্বিধা ছিল। ‘টয়লেট’কে ঘিরে আবার ভালোবাসার গল্প! কিন্তু মানুষ দারুণভাবে ছবিটি গ্রহণ করেছে। মানুষ উপলব্ধি করেছে যে তাদের মা, বোন ও স্ত্রীকে যদি সত্যি ভালোবাসে, তাহলে সবার আগে টয়লেট বানানো উচিত। একটা ছবির প্রভাব অনেক বেশি। গ্রামে গিয়ে শৌচালয় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা দিলেও মানুষের ওপর তার কোনো প্রভাব পড়ে না। কিন্তু সিনেমার কথা মানুষ শোনে। মানুষ উপলব্ধি করেছে অক্ষয়-ভূমির প্রেমকথা। আর আমার আগামী ছবি প্যাড ম্যান তো ইতিমধ্যে অনেক পরিবর্তন এনেছে। এই যে আপনি নিঃসংকোচে আমার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন, সব সাংবাদিক আমার সঙ্গে কথা বলছেন, সংবাদমাধ্যমে মেয়েদের মাসিক নিয়ে লেখা হচ্ছে, প্যাড ম্যান-এর ট্রেলার মুক্তির পর সামাজিক মাধ্যমেও স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে কথা হচ্ছে। সবাই খোলা মনে এ ব্যাপারে কথা বলেছে। এমনকি ছেলেরা ন্যাপকিন নিয়ে কথা বলছে। আমি এখনই তো অনেক পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি।

প্যাড ম্যান ছবিতে অক্ষয় কুমার ও সোনম কাপুর
প্যাড ম্যান ছবিতে অক্ষয় কুমার ও সোনম কাপুর



আপনি কি মনে করেন, ‘প্যাড ম্যান’ পারিবারিক ছবি হয়ে উঠতে পারে?

একদমই তাই। আমি সবাইকে বলতে চাই যে নিজের সন্তানদের নিয়ে এই ছবিটা দেখুন। প্রেমিক-প্রেমিকারা একসঙ্গে ছবিটা যেন দেখে। প্যাড ম্যান-এর মাধ্যমে খুব সুন্দর বার্তা দেওয়া হয়েছে। একটা মানুষের ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে। ছবিতে এ বিষয়কে ঘিরে কোনো নোংরামি দেখানো হয়নি।

এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে কি আপনি সরকারের কাছে সাহায্য চাইবেন?

টয়লেট: এক প্রেমকথার সময় সরকার অনেক সাহায্য করেছিল। ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযানের সঙ্গে আমার ছবির নাম জুড়ে দিয়েছিল। গ্রামে গ্রামে গিয়ে তারা পেনড্রাইভে করে ছবিটি দেখিয়েছে। সরকার যদি মনে করে এ ক্ষেত্রেও এগিয়ে আসবে, তাহলে আসবে। আমি মনে করি, কাউকে দিয়ে কিছু জোর করে করানো যায় না। সামনের মানুষটা যদি অনুভব করে সে নিজেই করবে। আমি আমার ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রেও একই নীতিতে চলি।

আপনি নিজে এ ব্যাপারে কিছু উদ্যোগ নেবেন?

দেখুন, আমার সিনেমা করা কাজ। আমি তা করেছি। বাকি কাজ সরকারের।

স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার মতো সামর্থ্য আমাদের দেশে বহু নারীর নেই। তাই এ ক্ষেত্রে কি এই সামগ্রীর ওপর থেকে জিএসটি (পণ্য ও সেবা কর) তুলে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন?

জিএসটি কেন, আমার তো মনে হয়ে যাদের ন্যাপকিন কেনার ক্ষমতা নেই, তাদের বিনা মূল্যে এটা দেওয়া উচিত। প্রতিরক্ষা খাতে যে বাজেট নির্ধারণ করা হয়, তার থেকে ১ কিংবা ২ শতাংশ কেটে এ ক্ষেত্রে খরচ করা যায়। কবে যুদ্ধ হবে, তার জন্য দুটি বিস্ফোরক অথবা অস্ত্র কম কিনে আমাদের দেশের মেয়েদের জন্য খরচ করা প্রয়োজন। সবার আগে আমাদের দেশের মেয়েদের শক্তিশালী করতে হবে। আর আমি শুধু সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে এ বিষয়ে আবেদন রাখতে পারি। আমি এবং বাল্কি একটা ভিডিও বানিয়েছি। এই ভিডিওর বার্তা হলো, একটা সিগারেটের খরচ বাঁচিয়ে ওই টাকায় প্যাড কিনতে সাহায্য করুন।

আপনি তো বেশ কিছু সময় ঢাকায় ছিলেন...

হ্যাঁ, ঢাকায় আমি ছয় মাসের মতো ছিলাম। ঢাকায় আমি কাজ করতাম।

ভারতের মতো বাংলাদেশেও এ বিষয়ে অনেক কুসংস্কার আছে। তারাও এ ব্যাপারে রক্ষণশীল। আপনি তাদের জন্য কিছু বলতে চান?

হ্যাঁ, আমি জানি। ভারতের মতো বাংলাদেশ, পাকিস্তান আজও এ বিষয়ে অনেক রক্ষণশীল। আমি খুব কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষদের দেখেছি। তাদেরও অনেক ট্যাবু আছে। আমি শুধু ওপার বাংলার মানুষদের বলতে পারি, আমার এই ছবিটি দেখুন। না, আমার ছবি বলে দেখতে বলছি না। আমি এই ছবির মাধ্যমে সবার কাছে সুন্দর একটা বার্তা পৌঁছে দিতে চাই। তাই ছবিটি দেখতে অনুরোধ করছি।

আপনি নিজে কবে মেয়েদের মাসিকের বিষয়ে জানলেন?

আমি ১৮-১৯ বছর বয়স থেকে এ ব্যাপারে জানি। তবে মাসিকের বিষয়ে অনেক গভীরভাবে জেনেছি বছর দুই আগে থেকে। প্যাড ম্যান সিনেমাটি করার সূত্রে। এ বিষয়ে অনেক পড়াশোনা করেছি। আর মেয়েদের মাসিককে ঘিরে যত জেনেছি, ততই অবাক হয়েছি। মেয়েদের শারীরিক কষ্টের থেকে বেশি তার আশপাশের মানুষেরা তাদের বেশি যন্ত্রণা দেয়। ছেলেরা এ বিষয়ে নানান কটু কথা বলে।

এই সময়ে আপনার বাড়ির পরিবেশ কী রকম থাকত?

আর পাঁচটা পরিবারের মতো আমার বাড়িও এ বিষয়ে রক্ষণশীল ছিল। আমি কিছুই বুঝতে পারতাম না। তবে আমি এখন আমাদের সন্তানদের এ বিষয়ে জানিয়েছি। এই নয় যে আমি আপনাকে এক বলছি আর বাড়িতে আরেক রকম থাকছি।

‘প্যাড ম্যান’ সিনেমার সূত্রে অরুণাচালাম মুরুগানান্থামের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। তাঁর দ্বারা কীভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন?

প্রথমে তো অরুণাচালাম আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন না। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, কী ব্যাপার? আপনি আমাকে এড়িয়ে চলছেন। কথা বলছেন না। তার জবাবে উনি বলেন, ‘আমি ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসি না। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে। ছেলেরা খুব ধীরগতিতে চলে। আমার এত ধীর ভালো লাগে না। ছেলেদের কোনো কিছু সহজে বোঝানো যায় না। মেয়েরা চটজলদি সব বুঝে নেয়।’ আমি সত্যিই অরুণাচালামকে দেখে অবাক হয়েছি। একজন মানুষ তাঁর কমনসেন্স কাজে লাগিয়ে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। যেখানে কোটি টাকা খরচ করে স্যানিটারি ন্যাপকিনের মেশিন তৈরি করা হয়, সেখানে অরুণাচালাম মাত্র ৬০ হাজার টাকা খরচ করে ন্যাপকিন উৎপাদনের মেশিন বানান। পেঁয়াজ কাটার সময় নিজের স্ত্রীর চোখে জল দেখে তিনি থাকতে পারেননি। তাই একটা ড্রাম বাজানো খেলনাকে পেঁয়াজ কাটার মেশিনে পরিবর্তন করেন। নিজের স্ত্রীকে একটা মানুষ কতটা ভালোবাসতে পারে, তা অরুণাচালামকে না দেখলে জানতে পারতাম না। তিনি শুধু নিজের কমনসেন্স ব্যবহার করে অসাধারণ সৃষ্টি করেছেন।

সেলিম খান একবার বলেছিলেন, আপনি সবাইকে ছাপিয়ে অনেক আগে এগিয়ে যাবেন। গত বছর ‘গোলমাল অ্যাগেইন’, ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’ বাদ দিলে বড় বড় তারকার বড় বাজেটের ছবি সেভাবে সফলতা পায়নি। সেখানে আপনার একের পর এক হিট ছবি। এর কারণ কী?

প্রথমেই সেলিম স্যারকে এ ব্যাপারে ধন্যবাদ জানাতে চাই। তিনি অনেক বড় মনের, তাই এ কথা বলেছেন। আর গোলমাল অ্যাগেইন, টাইগার জিন্দা হ্যায়-এর কথা কেন বাদ দেব? তবে আমার ছবি হিট হওয়ার কারণ একটাই বলে মনে হয়, আমি ভিন্নধারার ছবিতে অভিনয় করছি। আমার আগের ছবিটার সঙ্গে পরের ছবির মিল নেই। এ বছরই রজনী কান্তের সঙ্গে ২.০ ছবিটি মুক্তি পাবে। এই ছবিতে আমি ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করেছি। অনেকের মনে এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল যে আমি ভিলেন কেন? কিন্তু আমি চাই নানান চরিত্রে নিজেকে মেলে ধরতে।

প্রযোজক হিসেবে টুইংকেল ম্যাম সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

প্রযোজক হিসেবে টুইংকেল খুব ভালো কাজ করছে। ওর সেন্স খুব ভালো।