চলচ্চিত্রের জন্যও এলসি চালু হোক

>
গৌতম ঘোষ।
গৌতম ঘোষ।

আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকায় এসেছিলেন প্রখ্যাত বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ। সম্মেলনের ফাঁকেই বাংলা একাডেমিতে তাঁর সঙ্গে একান্তে কথা হলো প্রথম আলোর। কথা বললেন আমাদের ত্রিপুরা প্রতিনিধি তরুণ চক্রবর্তী

শঙ্খচিলচলচ্চিত্রের পর নতুন কোনো ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় ছবির কথা কী ভাবছেন?

আমি শঙ্খচিল-এর পর চুক্তি করেছিলাম একটা ইংরেজি কো-প্রোডাকশনে। এটা নিয়ে কাজ চলছে। গত বছর খানিকটা শুটিং করেছি। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ছবি। ইতালির একটি ছবি নিয়ে কাজ চলছে। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছবি। তিনটি ভাষায় ছবিটির কাজ হচ্ছে। মানে ছবির চিত্রনাট্যের মধ্যেই রয়েছে তিনটি ভাষা। ইংরেজি, হিন্দি এবং খানিকটা ইতালি। এই ছবির কাজ শেষ হলে অবশ্যই বাংলা ছবিতে হাত দেব। আর বাংলা ছবি করার ক্ষেত্রে আমি অবশ্যই ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় কাজ করতে ভালোবাসি।

কারণ কী?

বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আমার ভালো লাগে। বহু আগে থেকেই করছি। ভালো লাগাটা একটা কারণ। আরও একটা কারণ হলো, বাংলা ছবির বাজারটি বাড়াতে হবে! তামিল-তেলেগু ছবি যদি গোটা দুনিয়ায় বাজার বিস্তৃত করতে পারে, আমরা কেন পারব না? সেদিকেও ভাবতে হবে। আমাদের যে সংস্কৃতি আছে, পরম্পরা আছে, সেটাকেও তুলে ধরতে হবে। বর্তমান সময়টাকে তুলে ধরাও একজন ফিল্ম মেকারের বড় কাজ। স্থানীয় বিষয়বস্তুকে তিনি সব সময়ই প্রাধান্য দেন। সেই সঙ্গে অতীতকে রিলেট করা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। দেখা যাক নতুন কোনো ছবি করতেই পারি।

যৌথ প্রযোজনা নিয়ে সরকারের প্রতি আপনার কোনো প্রস্তাব রয়েছে কি?

এখানকার সরকার বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে। ভারত সরকারকেও ভাবতে হবে যৌথ প্রযোজনা নিয়ে আমরা আরও সহজে কীভাবে কাজ করতে পারি। এখানে একটা সমস্যা হচ্ছে পুরোনো নীতিমালা নিয়ে। আমাকে ইনু ভাই (বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী) বললেন, তাঁরা অনেকটাই সহজ করেছেন, এটা খুবই আশাব্যঞ্জক।

পুরোনো নীতিমালায় সমস্যা কী ছিল?

পুরোনো নীতিমালা অনুযায়ী যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের খরচ এ দেশের প্রযোজকেরা দেন। আর ভারতের খরচ আমরা দিই। কিন্তু কোনো জয়েন্ট ফান্ড নেই। এটা ইউরোপ-আমেরিকায় থাকে। একটা জয়েন্ট ফান্ড যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রে বেশ জরুরি। এটা হার্ড ক্যাশে হতে হবে। নয়তো খুব মুশকিল।

এখানে মুশকিলের কী আছে?

মুশকিল হলো, যৌথ প্রযোজনায় হার্ড ক্যাশ না থাকলে হিসাব করে ছবির চিত্রনাট্য রচনা করতে হবে। এমন তো হতেই পারে যে আমার ছবির চিত্রনাট্য পুরোটাই সিলেট অঞ্চলে। বা যৌথ প্রযোজনার কোনো ছবির পুরোটাই মেদিনীপুরে। এ ক্ষেত্রে যৌথ অ্যাকাউন্ট না থাকলে ছবির খরচটা তো এক পক্ষকেই বহন করতে হবে। না হলে হিসেব করে চিত্রনাট্যকে করতে হবে লোকেশনভিত্তিক। এতে ছবির ক্ষতি হচ্ছে।

এর জন্য কী করা উচিত?

এর জন্য প্রয়োজন একটা অ্যাস্ট্রো অ্যাকাউন্ট। কমন অ্যাকাউন্ট। যেটা ইউরোপীয় দেশগুলোতে রয়েছে। হার্ড কারেন্সিতে তা হবে। তাহলে কিন্তু লগ্নির বিষয়টি সহজ হয়ে যাবে। লগ্নিকারকেরাও উৎসাহিত হবেন। আরেকটা ভাববার বিষয়, বেশির ভাগ যৌথ প্রযোজনাই কিন্তু ভারতীয়রা বাংলাদেশে এসে করেছেন। বাংলাদেশ থেকে কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি। এটা ভাবতে হবে। এটাও বাড়াতে হবে।

কেন এগিয়ে আসছেন না বাংলাদেশের চলচ্চিত্র উদ্যোক্তারা?

হয়তো গল্প বা বিষয়বস্তুর অভাব রয়েছে। হয়তো তাঁরা নিজের দেশেই ছবি করতে বেশি পছন্দ করছেন। কিন্তু তাঁদের এগিয়ে আসাটা অত্যন্ত জরুরি। তাহলে বাংলা ছবির জগৎটা অনেক বড় হয়ে যাবে। তাহলে আমরা সারা বিশ্বে বাংলা ছবি রিলিজ করতে পারব।

বাণিজ্যিক ভাবে ভারতীয় সিনেমা বাংলাদেশে দেখানো যায় না। আবার বাংলাদেশের সিনেমাও ভারতে দেখা যায়না। কী বলবেন?

এটা তো ভয়ংকর খারাপ ব্যাপার। সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে অনেক দিন ধরে এবং সেটা করতে গেলে আপনাকে হার্ড কারেন্সির ব্যবস্থা করতে হবে। হার্ড কারেন্সিতে যেমন অন্যান্য পণ্য আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে, তেমন করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে যেমন কোনো পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে কী হয়? আগে একটা এলসি ওপেন করতে হয়। ডলারের মাধ্যমে। ঠিক একই জিনিস যদি বাংলা ছবির ক্ষেত্রে না করা হয়, তাহলে এক্সচেঞ্জ কখনো সাকসেসফুল হবে না।

সিনেমাও কি তাহলে পণ্য?

সিনেমাও তো একটা পণ্য। অন্য পণ্যের ক্ষেত্রে যদি হতে পারে, সিনেমার ক্ষেত্রে কেন হবে না? না হলে, ভারতে যদি বাংলাদেশের কোনো সিনেমা হিট করে বা এখানে যদি আমাদের কোনো সিনেমা হিট করে, তবে লাভের টাকা প্রযোজক পাবেন কী করে? আমাদের তো মুদ্রা বিনিময়ের সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নেই। সিনেমার ক্ষেত্রেও যদি এলসি ওপেন করা যায়, তবেই এই প্রচেষ্টা সফল হবে। না হলে খুব মুশকিল।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিচালক বা কলাকুশলীদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন?

অনেক ইয়ং ছেলেমেয়ে কাজ করছে। খুব ভালো কাজ করছে। আমি তিনটা যৌথ প্রযোজনায় কাজ করেছি। তিনটাতেই বাংলাদেশের শিল্পীদের নিয়ে কাজ করে খুব আনন্দ পেয়েছি। তাঁরা অত্যন্ত মন দিয়ে কাজ করেছেন। কলাকুশলীরা মন দিয়ে কাজ করেছেন। সিনেমা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ডিজিটাল হলগুলো তৈরি হয়নি। সিনেমা হলগুলোকে ডিজিটাল করা দরকার। এর জন্য সময় লাগবে। রাতারাতি সম্ভব নয়। ফিল্ম ডিজিটাল হয়ে গিয়েছে তো।

ভারতে বর্তমানে মানুষ ফের সিনেমা হল মুখী হচ্ছেন। মাল্টিপ্লেক্সগুলো ভালো ব্যবসা করছে। কিন্তু সিনেমা হলে ছবি দেখার প্রবণতা দেশে কমছে। কেন?

ছবি তৈরি করার পর সেই ছবি যদি মানুষ হলে না দেখে, তাহলে সেই ছবির ইমপ্যাক্টটা থাকে না। শুধু ইউটিউবে দেখলে তো হবে না! ইউটিউব একটা মাধ্যম। ডিজিটাল মাধ্যম। কিন্তু হলে না দেখলে কখনোই সিনেমা পূর্ণতা পায় না। তাই হলগুলোকে আরও সুন্দর করতে হবে।

সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছেই। বাড়ছে অসহিষ্ণুতা। এ বিষয়ে চলচ্চিত্রের কী করা উচিত?

আক্রমণ একটা চলছে। এটা প্রতিহত করতে প্রয়োজন প্রতি-আক্রমণ। আর এর জন্য সিনেমা একটা ভালো মাধ্যম। আমার ধারণা, চলচ্চিত্র নির্মাতারা উভয় দেশেই সেটা করে চলেছেন। সুস্থ সমাজের স্বার্থেই এটা জরুরি।