তোমরা যখন ডাকবে আমি আসব

এই তো দুই বছর আগে জন্মদিনে এফডিসিতে এসে কেক কেটেছিলেন, একজীবনে নায়করাজ হওয়ার গল্প শুনিয়েছিলেন, কেঁদেছিলেন, কাঁদিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে ডেকো, অন্তত এক কাপ চা খাওয়ার জন্য হলেও...তোমরা যখন ডাকবে আমি আসব।’ এখন তিনি জীবন-নদীর ওপারে। ২৩ জানুয়ারি তাঁর জন্মদিন। এ বছর আর জন্মদিনের আয়োজনে তাঁকে পাওয়া যাবে না। আসবেন না এফডিসিতে, থাকবেন না গুলশানের বাড়ি লক্ষ্মীকুঞ্জতে। নায়করাজের জন্মদিন সামনে রেখে আরেকবার রাজ্জাককে স্মরণ করলেন মাসুম আলী
বাবা রাজ্জাকের জন্মদিন উপলক্ষে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন দুই ছেলে সম্রাট ও বাপ্পারাজ। ছবি: খালেদ সরকার
বাবা রাজ্জাকের জন্মদিন উপলক্ষে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন দুই ছেলে সম্রাট ও বাপ্পারাজ। ছবি: খালেদ সরকার

‘তুমি বেঁচে থাকো, বেঁচে থাকবে আমার সন্তানের প্রথম রাঙা শার্টের মতো সযতনে আজীবন। আদরে, সোহাগে, ভালোবাসায় স্নেহের লক্ষ্মীতে...।’ গত সোমবার সন্ধ্যায় গুলশানের লক্ষ্মীকুঞ্জ নামের বাড়িটিতে ঢুকেই দৃষ্টি আটকে গেল এই বাঁধাই ছবিতে। একজন ভক্তের দেওয়া উপহার। সযত্নে দেয়ালে টাঙানো। মনে ধরল কথাগুলো। একজন ভক্তের এই কথাগুলো যেন দেশের অগণিত মানুষের মনের কথা। যে বাড়িতে ঢুকেছি, সেখানকার প্রতিটি প্রাণের উচ্চারণও নিশ্চয়ই।

গুলশানের বাড়িগুলো যেমন নীরব থাকে, লক্ষ্মীকুঞ্জ কি তার চেয়ে বেশি নীরব? মনে মনে এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে খুঁজতে তৃতীয় তলায় পৌঁছে যাই। দেয়ালে নতুন রঙের গন্ধ। সুন্দর পরিপাটি সবখানটায়। সবকিছু ঠিকঠাক, শুধু একজন মানুষ নেই। তিনি আছেন ফ্রেমে বাঁধাই ছবিতে। এই বাড়ির সবখানে তাঁর স্মৃতি, সব মানুষের স্মৃতিতে, মননে তিনি আছেন।

বাড়ির বড় ছেলে বাপ্পারাজ স্বাগত জানালেন। তাঁকে কোলে করেই ১৯৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল ঢাকায় এসেছিলেন বাবা রাজ্জাক। এসেছিলেন শরণার্থী হিসেবে। এ নিয়ে একটা সত্য গল্প শোনালেন বাপ্পারাজ। গল্পটা রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনের কিংবা এর সব অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের লোগোর। ল্যাম্পপোস্টের নিচে একজন মানুষ বসে আছেন, পাশেই একটা ডাস্টবিন-লোগোটা এমন। নায়করাজ রাজ্জাকের সব প্রতিষ্ঠানের লোগো।

বাপ্পারাজ বললেন, ‘১৯৬৪ সালে বাবা শূন্য থেকে জীবন শুরু করেছিলেন। চেনাজানা কোনো ঠিকানা ছিল না ঢাকায়। শূন্য হাতে ঢাকায় এসে আমাদের নিয়ে স্টেডিয়াম এলাকার একটি ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসেছিলেন। এই ল্যাম্পপোস্টের নিচ থেকেই ঢাকায়, বাংলাদেশে বাবার নতুন জীবন শুরু। এ বিষয়টিকে প্রতীকী অর্থে বোঝানো হয়েছে লোগোটিতে।’ বাপ্পারাজ বলেন, ‘আব্বা যখন প্রথম রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনের যাত্রা করেন, তখন এই লোগোটা করা হয়। বাবার পরিকল্পনামতো এটার নকশা করেছিলেন সুভাষ দত্ত। আমাদের সব কটি প্রতিষ্ঠানে, সাইনবোর্ডে, প্যাডে এই লোগো ব্যবহার করা হয়েছে।’

মাঘের হিমেল সন্ধ্যায় চা, নাশতার পরে যোগ দেন সম্রাটও। বাবা নেই, বাবার ছবি নিয়ে ছবি তুললেন দুই ভাই। তাঁদের মা খায়রুন্নেসা লক্ষ্মী ক্যামেরার সামনে তেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তিনি এলেন না। শোক কাটিয়ে তাঁরও কেটে যাচ্ছে দিনমান। একটা বড় শূন্যতা নিয়ে। বসার ঘরে যে ছবিটি টাঙানো, সেটি শেষ দিকের তোলা। ছবিটির দিকে তাকিয়ে বাপ্পা বললেন, ‘বাবা বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু চলে গেলেন হুট করেই। তখন শরীর অতটা খারাপ ছিল না, যতটা থাকলে জীবন-মরণ নিয়ে ভাবতে হয়। কিছুই বুঝতে দিলেন না আব্বু, হঠাৎ করেই চলে গেলেন।’-বড় শ্বাস ফেলে বললেন বাপ্পা। আফসোস আরও, রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনের শেষ ছবিটা করা হলো না রাজ্জাকের।

একজীবনে রাজ্জাক সিনেমা ছাড়া অন্য কিছুই স্থায়ীভাবে করেননি। যতক্ষণ শক্তি ছিল পুরোদমে ক্যামেরার সামনে, পেছনে কাজ করে গেছেন। ২০১৪ সালে অভিনয় করেছেন বাপ্পারাজ পরিচালিত কার্তুজ ছবিতে। এরপরই তারছেঁড়ার পরিকল্পনা করেন বাপ-বেটা মিলে। বাপ্পারাজ জানালেন, ছবিটি তাঁরই পরিচালনা করার কথা। স্ক্রিপ্ট হয়েছিল। কথা ছিল এই ফেব্রুয়ারিতে বাবাকে নিয়ে তারছেঁড়া নামের ছবিটি শুরু করবেন। হলো না।

সম্রাট ও বাপ্পা-দুজনই ব্যবসা করছেন। সম্রাট নিয়ম করে প্রতিদিন সকালে উত্তরার রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সে অফিস করেন। মাঝখানে কথা উঠেছিল, রাজ্জাক সিনেমা হলের নাম করে মার্কেট করেছেন। অনুমতিটা সিনেমা হলের নাম করে নিয়েছেন। এর আগে একবার এফডিসিতে শোকসভায় এ প্রসঙ্গ নিয়ে বলেছিলেন বাপ্পারাজ। আবারও বললেন, ‘মোটেও না। মার্কেটের কথা বলেই অনুমতি নেওয়া। পরে আমরা সিনেমা হল করার চেষ্টা করেছিলাম, রাজউক কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয়নি। ওখানে বিসিকের একটা মিলনায়তন ছিল, ওটাও আমরা নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম সিনেমা হল করার জন্য। একটি স্কুলের পাশে হওয়ায় সেটাও করা যায়নি।’

২০১৬ সালে এফডিসিতে এসেছিলেন রাজ্জাক। নিজের জন্মদিন উদ্‌যাপনে। অনেক কথা বলেছিলেন সেদিন। এই প্রতিবেদক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অকপটে জানিয়েছিলেন নিজের একজীবনের কথা। সেই কথাগুলোই মনে পড়েছিল বারবার। সেদিন রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘সকলের ভালোবাসা পেয়ে আজ আমি পরিপূর্ণ। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অনেক সময় অর্ধাহারে দিন কেটেছে আমার। সপ্তাহে ৬৫ টাকা পেতাম টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠান করে, সেই ৬৫ টাকা দিয়ে আমার সংসার চলেছে। একটা সময় পর আমি বেহুলার নায়ক হলাম। ৫০০ টাকা সাইনিং মানি নিয়ে খুশিতে বাড়ি এলাম। তারপরের কাহিনিটা অনেকেই জানেন।’ সেদিন কথা বলার এক ফাঁকে বারবার কেঁদেছিলেন তিনি। অশ্রুসিক্ত রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘আজকে আমি এই যে নায়করাজ, এটা আমার একার পক্ষে সম্ভব হয়নি।...আমার যাঁরা শ্রদ্ধেয় পরিচালক ছিলেন, তাঁরা আমাকে এবং তিনজন নায়িকা নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সেই যুদ্ধে আমি একজন সৈনিক হিসেবে কাজ করেছি তাঁদের সঙ্গে। শুধু রোববার দিন বাড়ি যেতাম আমি, অন্য দিনগুলোতে মেকআপ রুমের ফ্লোরে শুয়ে থাকতাম।’

নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে সেদিন নতুনদের উদ্দেশে নায়করাজ রাজ্জাক বলেন, ‘তোমরা যারা নতুনরা আছ, এভাবে তোমরা একটা চলচ্চিত্রশিল্পকে ধ্বংস হতে দিয়ো না, তাহলে আমি মরেও শান্তি পাব না। অনুরোধ করছি, তোমরা আবার কাজ শুরু করো। আবার আমাদের মতো যুদ্ধ ঘোষণা করো। সেই হাসান ইমাম হও, আমজাদ হোসেন হও, কাজী জহির হও।’

বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে ডেকো, অন্তত এক কাপ চা খাওয়ার জন্য হলেও। আমি তোমাদের মধ্যে থাকতে চাই। কারণ আমার আত্মার মধ্যে এফডিসি, আমার রক্তের মধ্যে এফডিসি। তোমরা যখন ডাকবে আমি আসব।’

এবারের জন্মদিনে ডাকলে কি আর তাঁর আসা হবে!