হৃদির হৃদ মাঝারে দেশ

হৃদি শেখ ছবি: কবির হোসেন
হৃদি শেখ ছবি: কবির হোসেন

বাবা-মা দুজনই বাংলাদেশি। কিন্তু আশির দশকে দুজনই পাড়ি জমান রাশিয়ায়। তাঁদের ছোট মেয়ে হৃদি শেখের জন্ম হয় সেখানে, সেখানেই বেড়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু আগাগোড়া বাংলাদেশি হয়ে পার করেছেন অনেকগুলো বৈতরণি। দেশে ও দেশের বাইরে নানা প্রতিযোগিতায় ‘বাংলাদেশি হৃদি’ হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছেন। বিদেশে জন্ম নেওয়া দেশি হৃদি কথা বলেছেন আনন্দ-এর সঙ্গে।

অল্প কিছুদিন আগে ভারতের মুম্বাই থেকে এসেছেন হৃদি। অংশ নিয়েছিলেন ভারতীয় চ্যানেল স্টার প্লাসের নাচবিষয়ক প্রতিযোগিতা ‘ডান্স প্লাস’-এর তৃতীয় মৌসুমে। যদিও আগের দুটি মৌসুমে ডাক পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাংলাদেশে চ্যানেল আইয়ের সেরা নাচিয়ে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আর ও পথ মাড়াননি। কিছুদিন আগে আমরা বসে যাই সেসব গল্প শুনতে। এখনো ডান্স প্লাসের স্মৃতি হৃদির মনে তরতাজা। সেই গল্পগুলো গরম-গরম পরিবেশন করলেন পাঠকদের জন্য। তবে তার আগে হৃদি শোনালেন তাঁর পথচলার শুরুটা হয়েছিল কীভাবে।

জন্মসূত্রে রুশ হওয়ার সুবাদে হৃদি প্রথমে পরিচিত হন রাশিয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে। সেটা তো স্বাভাবিকভাবেই শিখেছেন। কিন্তু বাবা-মায়ের মুখে মুখে শোনা বাংলাদেশের যে গল্পটা নিজের মধ্যে এঁকেছেন হৃদি, সেটা ভুলে যাননি কখনো। জানালেন, হৃদির বাবা বৃত্তি নিয়ে ১৯৮৩ সালে রাশিয়ার মস্কোতে যান। তার ঠিক তিন বছর পর ১৯৮৬ সালে বৃত্তি নিয়ে সেখানে পড়তে যান তাঁর মা। তারপর সেখানেই থিতু হন দুজন। স্বাভাবিকভাবে হৃদির জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, নাচ শেখা—সবই রাশিয়ায়। কিন্তু রক্তটা বাংলাদেশের।

ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন হৃদি। বাবা-মায়ের আগ্রহ তো ছিলই। সঙ্গে নিজের ইচ্ছাটাও। মজার ব্যাপার হলো টানা আট বছর মিউজিক স্কুলে গান ও পিয়ানো শিখেছেন। একসময় মা-বাবাই তাঁকে ঠেলে নাচের স্কুলে পাঠিয়েছেন। বলেছেন, ‘যাও, দেখো, শেখো! ভালো লাগতে পারে!’ তারপর দাবার দানের মতো সবকিছু উল্টে যায়। হৃদি বুঝতে পারেন তাঁর আসল টান আসলে নাচের দিকে। নাচই সঙ্গী হয়ে যায় হৃদির।

২০১২ সালে ইউক্রেনের একটি নাচের প্রতিযোগিতায় (রিয়েলিটি শো) অংশ নিয়েছিলেন হৃদি শেখ। কিন্তু মাঝে ইনজুরির কারণে ছিটকে পড়েছেন। ২০১৪ সালে সেই একই শো রাশিয়ায় হলে সেরা ১৫-তে জায়গা পান এই নাচের শিল্পী। এই অনুষ্ঠানের পরের কিস্তিগুলোয় কোরিওগ্রাফার হিসেবেও কিছুদিন যুক্ত ছিলেন তিনি। হৃদি বললেন, ‘আমার জার্নিটা অনেক দীর্ঘ। আমি দেশের বাইরে অনেক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। কিন্তু সব সময় বাংলাদেশ আমার সঙ্গেই ছিল। কারণ, আমাকে সারা জীবন বলা হয়েছে তুমি যেখানেই যাও তোমার চেহারা, তোমার রক্ত সবই বাংলাদেশের। সেভাবেই থাকবে। বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে। এ কারণেই আমার প্রথম মঞ্চে নাচের পরিবেশনাটি ছিল বাংলা গান দিয়ে। সেই গানটি হলো ‘ও মুই না শুনং’। এই একটা গান দিয়ে কত যে পরিবেশনা করেছি তার ঠিক নেই।’
নাচ নিয়ে এত রাজ্য জয়। তাহলে পড়াশোনায় কি তেমনভাবে মন বসাতে পারেননি? এ প্রশ্নের জবাবে হৃদি বিস্ময় উপহার দিলেন। পড়াশোনাতেও এই মেয়ে অনেক এগিয়ে। রাশিয়ার সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশনের ওপর স্নাতক করেছেন। চাকরিও করেছেন বেশ কিছুদিন। পরে নাচের টানে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে এসেছেন বাংলাদেশে। তবে সামনে সময়-সুযোগ করে অর্থনীতি বিষয়ে আরও উচ্চতর পড়াশোনার ইচ্ছা আছে তাঁর।
হৃদির কাছে জানতে চাই কোথায় কাজ করতে চান? বাংলাদেশ, মুম্বাই নাকি রাশিয়া?
হৃদি হেসে চারপাশ দেখে নিয়ে বলেন, ‘সব জায়গায়। আমার তো ইচ্ছে একদিন বাংলাদেশের নাচ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাব। প্রতিদিন তো নতুন নতুন সুযোগ সামনে আসছে। কেন আমি আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করব না?’

কথা শেষ করতে হয়। সবশেষে জানতে চাই, সম্প্রতি অনলাইনে একটা খবর ঘুরে বেড়াচ্ছে। জনপ্রিয় টিভি সিরিজ গেম অব থ্রোনস-এ নাকি অভিনয়ের সুযোগ পেয়েও করেননি? জবাবে হৃদি জানালেন, রাশিয়ায় থাকার সময় গেম অব থ্রোনস-এর কাস্টিং ডিরেক্টর জুলি সুবার্ট যোগাযোগ করেছিলেন হৃদির সঙ্গে। রাশিয়ার একটি অ্যাক্টিং এজেন্সির মাধ্যমে হৃদির তথ্য পেয়েছিলেন তিনি। জানতে চেয়েছিলেন গেম অব থ্রোনস-এর শেষ মৌসুমে অভিনয় করতে চান কি না। হৃদি রাজি ছিলেন। কিন্তু শেষমেশ আর করা হয়নি। কারণটাও বললেন, ‘আসলে গেম অব থ্রোনস কী ধরনের টিভি শো, এটা তো সবাই জানে। এর কিছু সংবেদনশীল দৃশ্যে অভিনয় করার জন্য আমি রাজি ছিলাম না। জানতে পারি যে সেই দৃশ্যে কোনো ডামি ব্যবহার করেন না তাঁরা। শিল্পীকেই সংবেদনশীল দৃশ্যে অভিনয় করতে হয়। এ কারণে পিছিয়ে গেছি।’
তবে পিছিয়ে গেলেও হৃদি এগিয়ে যেতে চান নাচ নিয়ে। সেটা কত দূর তা-ই এখন দেখার বিষয়।