অনুষ্ঠান উপস্থাপনাও একটি বড় মাপের শিল্প

‘সময় কাটুক গানে গানে’ অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন ডলি সায়ন্তনী
‘সময় কাটুক গানে গানে’ অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন ডলি সায়ন্তনী

টেলিভিশনে পুরোনো অনুষ্ঠানগুলোর পুনঃ প্রচার কখনো কখনো নতুন অনুষ্ঠানের চেয়েও তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। অতীতের স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, সাধনা সবই ফুটে ওঠে সেসব অনুষ্ঠানে। ১৯ জানুয়ারি সকাল ১০টায় নিমা রহমানের উপস্থাপনায় ইটিভিতে প্রচারিত হলো ‘আর্কাইভ থেকে...’ শিরোনামে একটি পুরোনো অনুষ্ঠান ‘আমাদের কথা’। আধা ঘণ্টার এ ছোট্ট অনুষ্ঠানে প্রথমেই তুলে ধরা হয়েছে আমাদের নিকট অতীতের তিনজন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শওকত ওসমান, কলিম শরাফি ও আবুল খায়েরের সাক্ষাৎকার। একে একে তুলে ধরলেন তাঁদের জীবনসংগ্রাম, সাধনা ও অধ্যবসায়ের কথা। শওকত ওসমান জানালেন সে সময়ে আমাদের সমাজে কীভাবে উদারনৈতিক শিক্ষা ও মুক্তচিন্তার বিকাশ হলো। কলিম শরাফি বললেন, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিকূলতার মাঝে সংগীত সাধনার কথা। আর আবুল খায়ের বললেন, অবরুদ্ধ পরিবেশে নাটকের অগ্রযাত্রায় তাঁদের অবদানের কথা। এভাবে স্বল্প সময়ে ও স্বল্প কথায় যেন উন্মোচিত হলো অতীতের তিনটি ভুবন। এরপর অনুষ্ঠানের সংযোজন ছিল সেই সময়ের গৃহসজ্জা, রান্নাবান্না ও সবশেষে অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারের অভিনয়জগতে আবির্ভাবের গল্প। 

এই স্বল্প পরিসরের অনুষ্ঠানে এসব ব্যক্তিত্বের অভিজ্ঞতা, জীবনসংগ্রাম ও সাধনার বিবরণ বর্তমান প্রজন্মের জন্য হতে পারে পরম শিক্ষণীয়, হতে পারে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সেতুবন্ধ। অনুষ্ঠানটি দেখে মনে হয়েছে, সব চ্যানেলই সপ্তাহে অন্তত একটি এমন তাৎপর্যময় অনুষ্ঠানের পুনঃ প্রচার করতে পারে।
বৈশাখী টিভি আয়োজিত সরাসরি গানের অনুষ্ঠান ‘সময় কাটুক গানে গানে’। নাবিলার উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হলো ১৯ জানুয়ারি রাত ১১টায়। এবারে শিল্পী ছিলেন ডলি সায়ন্তনী। বেশ কিছুদিন পর ডলি সায়ন্তনীকে এমন অনুষ্ঠানে দেখা গেল। শিল্পী একটানা প্রায় দুই ঘণ্টা গান করেছেন। অধিকাংশই করেছেন নিজের গান। তিনি অনুষ্ঠান শুরু করেছেন সদ্যপ্রয়াত শিল্পী শাম্মী আখতারের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁরই একটি গান দিয়ে—‘ভালোবাসলে সবাইকে...’। তারপর একে একে গেয়েছেন ‘পরানের বান্ধব রে বুড়ি হইলাম তোর কারণে’, ‘ও আমার রসিয়া বন্ধু রে’, ‘ঘুমাইয়াছিলাম ছিলাম ভালো’, ‘কালিয়া রে কালিয়া’, ‘নয়ন ঘুরাইয়া খুঁজি তোমারে’সহ বেশ কয়েকটি গান।
তাঁর এ দিনের পরিবেশনার বৈশিষ্ট্যের কথা বললে প্রথমেই বলতে হয়, সব গানই তিনি করেছেন একটু দ্রুত লয়ে। যে কারণে দর্শকশ্রোতার কাছে তাঁর পরিবেশনার বৈচিত্র্য ফুটে ওঠেনি। আরেকটি বিষয় খুবই হতাশ করেছে, সেটি হলো উচ্চারণ। কখনো তাঁর উচ্চারণে অস্পষ্টতা এবং কখনো শব্দ সংযোজনে ত্রুটির কারণে অনেক গানেই অনেক স্থানে বাণী স্পষ্ট বোঝা যায়নি। তবে তাঁর কণ্ঠ ও সুরের মাধুর্য নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তাঁর পরিবেশনা ও উপস্থাপনাও ছিল আন্তরিকতাপূর্ণ। বিশেষ করে দর্শকের সঙ্গে কথোপকথনে তাঁর বিনয় ও আন্তরিকতা আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। তবে উপস্থাপনায় যথেষ্ট আনাড়িপনা লক্ষ করা গেছে। যেমন গান নিয়ে কথা বলা, শিল্পীকে প্রশ্ন করে আবার নিজেই উত্তর দেওয়া অথবা উত্তর না নিয়েই অন্যদিকে সরে যাওয়া। সবকিছুর মধ্যে যেন একটা অস্থিরতা ও অস্বাভাবিকতা লক্ষণীয়। উপস্থাপনা যে একটি বড় মাপের শিল্প, এটি বুঝতে হবে। এ ধরনের সরাসরি গানের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা তাঁর আরও দেখার ও শেখার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয়েছে আমাদের।
১৯ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে জহির করিমের রচনা ও রাহাত মাহমুদের পরিচালনায় মাছরাঙা টিভিতে প্রচারিত হলো নাটক আমার বেলা যে যায়। নাটকের গল্পটি সংক্ষেপে এ রকম—শ্রাবণ ও মেঘলা দম্পতি বৃষ্টি ও আকাশের বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে জানাজানি হয় মেঘলার স্বামী শ্রাবণ বৃষ্টির স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। বৃষ্টি শ্রাবণকে পছন্দ করত সেটাও সে বলে ফেলে। তারপর পুরো নাটকজুড়ে দেখানো হয় বৃষ্টি ও শ্রাবণ উভয়ে স্বামী ও স্ত্রীকে ফাঁকি দিয়ে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। শেষে যেদিন বৃষ্টি স্বামীর ঘর ছেড়ে এসে শ্রাবণের বাসায় ওঠার কথা, সে মুহূর্তে মেঘলা ঘুম ভেঙে পাশের ঘরে এসে দেখে, সবাই তার নব মাতৃত্ব লাভের সংবাদে কেক কাটার আয়োজন করেছে। মেঘলা নিজে তখন বুঝতে পারে, বৃষ্টি ও শ্রাবণের প্রেমের ঘটনাটি সে আসলে স্বপ্নে দেখেছে। শেষের এই সারপ্রাইজের ভেতর দিয়ে গল্পের যবনিকা।
পুরো নাটকটি দেখার পর মনে হয়েছে, নাট্যকার ও নির্মাতা পুরো গল্পের শেষে যে চমক দিতে চেয়েছেন, তা চমকই হয়েছে, বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দৃশ্যের পর দৃশ্য প্রেম, লুকোচুরি, সলা-পরামর্শ সবই দেখানো হলো অথচ শেষে বলা হলো স্বপ্ন। বাস্তবে এমন স্বপ্নও কি দেখা সম্ভব! এর চেয়ে বরং মেঘলা পুরো বিষয়টি কল্পনা করছে দেখালেও কিছুটা মানানসই হতো। তা ছাড়া স্বপ্ন এবং কল্পনারও তো একটা বাস্তব ভিত্তি লাগে, এখানে তো সেটিও নেই। কেবল বৃষ্টি ও শ্রাবণ একসঙ্গে পড়ত আর বলা হয়েছে বৃষ্টি শ্রাবণকে মনে মনে পছন্দ করত। এ দিয়ে এত বড় স্বপ্ন বা কল্পনা এখনকার ছেলেমেয়েরা করে না, দেখেও না। তাই বলা যায়, এই স্বপ্নের বাস্তব কোনো ভিত্তিও নাটকের ঘটনায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে দর্শকের কাছে গল্পটি সারপ্রাইজই হয়েছে, বিশ্বাসযোগ্য একটি নাটক হয়ে উঠতে পারেনি।
এ ছাড়া চিত্রনাট্য ও সংলাপও আকর্ষণীয় হয়নি, বরং কোথাও কোথাও দুর্বলই হয়েছে। আর নামকরণ আমার বেলা যে যায় কেন দেওয়া হলো বুঝলাম না, সে কি কেবল ওই গান সংযোজনের জন্য!
তবু শেষে বলব, গতানুগতিক ঘটনাকে অভিনব করার চেষ্টা প্রশংসনীয়। আর নতুন শিল্পী হিসেবে সানজিদা কোয়েল ও উজ্জ্বল চৌধুরীর অভিনয় ভালো হয়েছে। বিশেষ করে সানজিদা কোয়েলের অভিব্যক্তি ছিল মনে দাগ কাটার মতো।