এক শ গোলাপের শুভেচ্ছা, অভিনন্দন

পঞ্চনারী আখ্যান–এর পঞ্চাশতম মঞ্চায়নে রোজী সিদ্দিকী
পঞ্চনারী আখ্যান–এর পঞ্চাশতম মঞ্চায়নে রোজী সিদ্দিকী

‘মঞ্চ নাটকের সেই সূবর্ণকাল আর নেই।’ অনেক সময় অনেক মানুষকে এমন কথা বলতে শোনা যায়। যাঁরা বলেন, তাঁদের মন হয়তো তেমন কথা বলায়। বাস্তব চিত্র হচ্ছে, থিয়েটারের জন্য মানুষের ভালোবাসা কমে যায়নি। সময় বদলে গেছে। অনেক কিছুই আগের মতো নেই। জীবনের নানান বদল মুখ বুজে মেনে নিচ্ছে মানুষ। আফসোসের ঢঙে শুধু ‘মঞ্চ নাটক আগের মতো নেই’ বললে সঠিক বলা হয় না।

চারপাশে তাকালে দেখা যায়, জীবনোন্নয়নের ইঁদুর দৌড়ে প্রত্যহ বিপুল আগ্রহে শামিল হয়ে পড়ছে সব পদের মানুষ। বিবেক থাকা ঝামেলা মনে করে তা আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে বুদ্ধির ধার বাড়িয়ে চলেছে। চালাকির ইস্তেমাল করে যখন একদল মানুষ প্রতিনিয়ত জীবনের গৌরব বাড়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত, তখন অসংখ্য মানুষ সন্ধ্যায় এক কাপ চা ও সামান্য আকৃতির একটা শিঙাড়া খেয়ে সাগ্রহে, সানন্দে মঞ্চ নাটকের মহড়ায় মেতে আছে। এমন অসংখ্যের একাগ্রতা, নিষ্ঠায় মঞ্চের মহত্ত্ব এখনো আলোকিত থাকে। সেই আলোর জন্য দর্শকের আগ্রহ কমে যায়নি। তার উদাহরণ অসংখ্য, মন চাইলে দেখা হয়ে যায়।

২৬ জানুয়ারি মহিলা সমিতি মঞ্চে অভিনীত হলো ঢাকা থিয়েটারের পঞ্চনারী আখ্যান। কোনো উদ্‌যাপন হয়নি, কিন্তু উদ্‌যাপন করার মতো ঘটনাই ছিল সেই সন্ধ্যা। রোজী সিদ্দিকীর একক অভিনয় সেদিন নতুন গৌরব স্পর্শ করেছে। পঞ্চনারীর পঞ্চাশতম প্রদর্শনী নিশ্চয়ই সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। একসময় মঞ্চনাটককে অশেষ প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে। মঞ্চকর্মীরা দাবি করতে পারবেন না সেই পরিস্থিতির তেমন উন্নতি ঘটেছে। তবু থিয়েটারের ঘোর এখনো জোর হারায়নি। সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করে মঞ্চনাটক সগৌরবে এগিয়ে চলেছে। তার উদাহরণ পঞ্চনারী আখ্যান-এর পঞ্চাশতম প্রদর্শনী।

একক অভিনয়ের নাটক। তাই পঞ্চাশতম প্রদর্শনীর গৌরব বেশিমাত্রায় রোজী সিদ্দিকীরই প্রাপ্য হয়ে ওঠে। মঞ্চে বিরতি ছাড়া পরপর পাঁচটি চরিত্রে অভিনয় করতে হয় তাকে। চরিত্রগুলোর প্রেক্ষাপট ভিন্ন ভিন্ন, সবার শ্রেণিচরিত্রও আলাদা আলাদা। অতএব, চরিত্রের বিন্যাস সহজসাধ্য মোটেও নয়।

অভিনয়শিল্পীদের জন্য তা বিশেষ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অবশ্যই। সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কতটা সফল হতে পেরেছে রোজী সিদ্দিকী? প্রশ্নের উত্তর মেলে প্রদর্শনীর সংখ্যায়। নাটকের দল প্রদর্শনীর সংখ্যা বাড়াতে পারে না, সংখ্যা বাড়ে দর্শকের আগ্রহে। একক অভিনয়ের কথা শুনে কৌতূহল বাড়ে দর্শকের। সেই কৌতূহলের একটা মন্দ দিকও রয়েছে। নাটক যদি সন্তুষ্ট না করতে পারে, সব দোষ গিয়ে পড়ে একজনের কাঁধে। এই দোষের ভার পড়েনি রোজীর কাঁধে, এতগুলো প্রদর্শনীর পর নির্দ্বিধায় তা বলে দেওয়া যায়। প্রথম ও পঞ্চাশতম প্রদর্শনীর অভিনয় দেখে একটা বিশ্লেষণ মনে জাগেই। কী ছিল অভিনয়শিল্পী, এখন কোথায় দাঁড়িয়ে। যখন একক অভিনয়ের মতো ভয়াবহ দায়িত্ব নিতে রোজী মঞ্চের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তখনো আগ্রহ সৃষ্টিকারী মঞ্চের অভিনয়শিল্পী হিসেবে তার পরিচয় গড়ে ওঠেনি। টেলিভিশনের অভিনয়ে তার প্রতিভার ঝিলিক দেখা গেছে, কিন্তু তা নিয়মিত দেখানোর জন্য চরিত্রের প্রয়োজন পড়ে। তেমন চরিত্র সব সময় মেলে না। সুতরাং মাঝেমধ্যে অসাধারণ, বাকি সময়টা স্বাভাবিক অভিনয় করে যাওয়া, এমনটাই ছিল অসংখ্যজনের মতো রোজী সিদ্দিকীরও নিয়তি। পঞ্চনারী আখ্যান বলা চলে রোজীর ভাগ্য বদলের অধ্যায়। অন্যভাবেও বলা যায়, এই নাটকের অভিনয়ে দর্শক তাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পেরেছেন।

ব্যাপারটা সহজ নয়। দুঃসাহসী। মঞ্চনাটকের পুরোটা একা অভিনয় করতে হবে। এমন কথা বুক ধড়ফড় করানোর মতোই। প্রথম প্রদর্শনী দেখে মনে হয়েছিল রোজী ‘করব অথবা মরব’ এই বোধ নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছে। মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তির জোগানদাতা প্রতিজ্ঞা। এমন প্রতিজ্ঞায় অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। রোজী তা দেখিয়েছে। অভিনয়গুণ থাকলেও পাঁচটি চরিত্রে সু-অভিনয়ের জন্য সবচেয়ে জরুরি জুতসই কণ্ঠস্বর। প্রথম অভিনয় সন্ধ্যায় তার কিছুটা ঘাটতি অনুভূত হয়েছিল। হয়তো সে বিষয়ে সচেতনতা অভিনয়শিল্পীর ছিল। লড়াইয়ে জেতার দৃঢ় মন সত্ত্ব থাকলে যা হয়, পুরোটা লক্ষ করা গেল পঞ্চাশতম অভিনয়ে। একাগ্রতা, নিষ্ঠা দিয়ে দুবর্লতাকে অতিক্রম করতে পেরেছে রোজী সিদ্দিকী। দেশে-বিদেশে এই নাটকের ক্রমাগত অভিনয় এবং দর্শকের করতালি মিলে দীর্ঘদিনে আত্মবিশ্বাস হয়েছে সুদৃঢ়। দ্বিধাহীনতা, আত্মবিশ্বাস অভিনয়ে যুক্ত করে নবমাত্রা। দীর্ঘকাল অনুশীলনে চরিত্রের গভীরে পৌঁছানোটা সহজ হয়ে ওঠে, অভিনয় করা চরিত্রটাকে দর্শকের মনে হয় অভিনয় নয় সত্যি, আসল চরিত্রটাকেই দেখছি। পরাজয় ঘটেনি শিল্পীর। রোজী সার্থক এবং সফল।

অতিসংবেদনশীলতায় পঞ্চনারী আখ্যান লিখেছেন হারুন রশীদ। খুবই সময়োপযোগী বিষয়। মানুষের মনোযোগ আকর্ষণকারীও। কিন্তু ইতিহাসের পাতা থেকে এসময়কাল পর্যন্ত সময় বিস্তর গড়িয়ে গেলেও নারী ও পুরুষের সম্পর্ক, পরস্পরের প্রতি আচরণ, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি যে তিমিরে ছিল, রয়ে গেছে সেই তিমিরেই। নাট্যকার তা পরিষ্কারভাবে অতি বিশ্বস্ততায় উপস্থাপন করেছেন।

পঞ্চনারীর প্রথম নারী সাধারণ এক জোলেখা আর শেষ নারী ইতিহাসের মমতাজ। দুজনের সময়কাল ভিন্ন হলেও দর্শক আবিষ্কার করতে পারেন তাদের অস্তিত্বের অভিন্নতা। জোলেখা বলে, ‘আইজ বিচার বসাইছেন আমারে নিয়া? যারা আমার স্বপ্ন ভাঙল, দৈত্য-দানবের কাছে বিক্রি কইরা দিল, চাউল-গমের মতো যারা আমার শরীরটারে যাঁতায় উঠায়া পিষায়া তছনছ করল, তাগো বিচার করবেন না?’ একই মেজাজে সম্রাট শাহজাহানের প্রিয়তম পত্নী বেগম মমতাজকেও বলতে শোনা যায়, ‘তোমরা ব্যবসা করো নারীকে নিয়ে, তার ত্যাগ, মহিমা আর দাসত্ব নিয়ে। ব্যবসা করো তোমরা ইতিহাস নিয়ে।......এবার আমাকে মুক্তি দাও, মুক্তি দাও।’

জগৎ-সংসার থেকে এই মুক্তির আকুতি কোনো দিন উধাও হবে কি না, কে জানে। কিন্তু পঞ্চনারী দেখতে আসা অসংখ্য দর্শক সেই আকুতিতে অসহায় বোধ করেন। ভাষাহীন হওয়ার বদলে একান্ত অনুভব করায় নাটক শেষে হাততালি পড়ে। তা এক সার্থকতা। এই নাটক মানুষের বোধে গ্লানির বিস্তার ঘটিয়ে দেয়, তা-ও আর এক সাফল্য। অভিনয়ের পাশাপাশি এই সার্থকতা ও সাফল্যের দাবিদার ভাবা যায় নির্দেশক শহীদুজ্জামান সেলিমকেও। তার নির্দেশনা, উপস্থাপনারীতি নাটককে কখনোই ভারাক্রান্ত করেনি। সে জন্য নাটকের কৌশল নয়, আস্ত নাটকটার অনুভবকে অস্তিত্বে গেঁথে দর্শক ঘরে ফিরতে পারেন। সৃজনকালে লোভ সংবরণ করতে পারা সবচেয়ে বড় যোগ্যতা। একটা ভালো নাটকের পাণ্ডুলিপি হাতে পেলে তা অতি চমৎকারভাবে উপস্থাপনার তাগিদ মনে জেগে ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু সেলিম কোনো কিছুকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে শুধু নাটকের ভেতরে যে শক্তিকে নির্দেশক হিসেবে অনুধাবন করেছে, তা-ই যেন হুবহু দর্শকের প্রাণেও সঞ্চারিত হতে পারে তার জন্য যেমন নির্মোহ হওয়া প্রয়োজন, এতটাই নির্মোহ থাকতে পেরেছে। সহজিয়া পথটা বেঁছে নেওয়ার জন্য শহীদুজ্জামান সেলিমকে অজস্র ধন্যবাদ। এই নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনা করে দেওয়ার জন্য যখন আমাকে বলা হয়েছিল, খুশি হয়েছিলাম। বহুদিন পর আবার মঞ্চ পরিকল্পনা করতে পারব। রোজী একক অভিনয় করবে, সেলিম নির্দেশনা দেবে। দুজনেই অনুজপ্রতিম। তাদের সৃজনশীলতা, উত্তেজনায় নিজের অংশগ্রহণের সুযোগ বিশেষ আনন্দেরও। আলাদা কিছু করার তাগিদ মনে ছিল এবং মনে বিশ্বাস জন্মেছিল যে নাটকটা অনেক দিন ধরে মঞ্চস্থ হতে পারে। মঞ্চ পরিকল্পনার বেলায় ভাবা হয়েছিল, যেন সহজে ব্যবহারের উপযোগী হয় এবং অতিব্যবহারের পর মঞ্চের রূপ যেন জীর্ণ না হয়ে পড়ে। অতিকায় একটা যন্ত্রণাকাতর মানবমুখ ও প্রতিরোধের ঢঙের দুখানা হাতের তালু তৈরি করে দিয়েছিল চিত্রকর জুইস। পঞ্চাশতম প্রদর্শনীতে মনে হলো মঞ্চরূপ প্রথম দিনের মতোই যন্ত্রণাকাতর রয়েছে। এই যন্ত্রণাকাতরতা থেকে মুক্তির সাধ জাগিয়ে দেয় নাটকের শেষে মঞ্চকুসুম শিমুল ইউসুফের কণ্ঠে ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ গানটি। দর্শক গানের সঙ্গে আনমনে নিজেরাও গাওয়া শুরু করেন সেই মুক্তির গান। নাটকে আলোর ব্যবহারেও খুব চমক প্রদানের আকাঙ্ক্ষাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। শুধু স্থান-কালের পরিবর্তনের প্রয়োজনে যতটুকু প্রয়োজন ছিল, ততটুকুরই ব্যবহার দৃশ্যমান হয়। মূল বিষয়কে ছাপিয়ে অন্য কোনো কিছুই প্রধান হয়ে ওঠেনি। আলোর জন্য ওয়াসিম আহমেদ তাই বিশেষ করে তালি পাওয়ার মতো। পোশাক পরিকল্পনায়ও একই স্বাভাবিকতা বজায় ছিল। সে জন্য নাসরীন নাহারও কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। নাটকে সংগীত সংযোজনা করেছে মঞ্চকুসুম শিমুল ইউসুফ ও চন্দন চৌধুরী। একক অভিনয়ে সবচেয়ে বড় সাহায্যকারীর ভূমিকা বোধকরি আবহসংগীতের। তা শিল্পীর অনুভূতিতে চরিত্রের সমগ্র অস্তিত্বের অনুরণন ঘটিয়ে দিতে পারে। দর্শকের উপলব্ধিতেও পুরো সময়জুড়ে নাটকের ভাব অনুযায়ী আবহসংগীত যথার্থ ক্রিয়া করে। শিমুল ও চন্দন তার জন্য অকুণ্ঠ চিত্তে প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।

মানুষের ক্রিয়াশীল মন রয়েছে। দুঃখ কষ্ট বঞ্চনা—এসবের পীড়ন নিত্য সয় মানুষ, আবার মানুষের বেয়াড়া স্বভাবই সমগ্র অনাসৃষ্টির কারণ। এই দ্বৈততা থেকে মুক্তি কে দেবে, যদি মানুষ নিজেই মুক্ত হতে না চায়? পঞ্চনারী আখ্যান-এর মতো নাটক সার্থক উপস্থাপনার জন্য অর্ধশত প্রদর্শনী পূর্ণ করবে, মানবজীবন সার্থক করে তোলার জন্য নিজেদের যে ভূমিকা, তাতে অসম্পূর্ণতা থাকলে ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ ভালো লাগবে। এই গান ঠোঁট মিলিয়ে গাওয়া হবে, সুখ অনুভব হবে—মুক্তি কি মিলবে?

অর্ধশত প্রদর্শনীর জন্য সবাইকে এক শ গোলাপের শুভেচ্ছা, অভিনন্দন।

লেখক: অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, লেখক, নির্দেশক

afzalhossain1515@yahoo. com