পূর্বানাটের ব্রিক লেন '৭৮

ব্রিক লেন ’৭৮ নাটকের দৃশ্য অভিনয়শিল্পীরা। ছবি: বিগ ফ্রগ ফিল্ম লিমিটেড
ব্রিক লেন ’৭৮ নাটকের দৃশ্য অভিনয়শিল্পীরা। ছবি: বিগ ফ্রগ ফিল্ম লিমিটেড

ব্রিটেনে মিডল্যান্ড হিসেবে বার্মিংহাম বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বৈচিত্র্যে ভরা এই শহর ঘুরলে চোখে পড়ে নানা দেশের মানুষ, শোনা যায় বিভিন্ন দেশের ভাষা। এই শহরেই বছর চারেক আগে গড়ে উঠেছে নাটকের দল পূর্বানাট। মূল উদ্যোক্তা মুরাদ খান। সিলেটের দর্পণ থিয়েটার ও ঢাকার প্রাচ্যনাটের একনিষ্ঠ কর্মী বলেই পরিচিত তিনি। প্রাচ্যনাটের কইন্যা তাঁরই রচনা।

পূর্বানাট পেশাদারির ভিত্তিতে নাট্যচর্চার প্রত্যয় নিয়ে এ পর্যন্ত চারটি প্রযোজনা মঞ্চায়ন করেছে। নাটকগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, বিলেতে বাঙালিদের নোঙর ফেলা, কাজ-ব্যবসা, বসবাস ও সংগ্রামের ইতিহাস অনুসন্ধান। এই সূত্র ধরেই এবারের প্রযোজনা ব্রিক লেন ’৭৮। ‘ব্রেক্সিট’ এবং ‘ট্রাম্প’ বিতর্কে বিভক্ত পাশ্চাত্যে বাঙালি ডায়াসপোরার রাজনৈতিক ইতিহাস খননের স্মারক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে নাটকটি। গত ১১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বার্মিংহাম মিডল্যান্ড আর্টস সেন্টারে হলভর্তি বহুজাতিক দর্শক, টিকিট না পেয়ে ফিরে যাওয়া দর্শক এবং নাটক শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে ও ফেসবুকে অংশগ্রহণ করা দর্শক-আগ্রহ থেকেই নাটকটির তাৎপর্য বোঝা যায়। এই যাত্রায় সারথি হয়েছেন সম্প্রতি লন্ডন পড়তে আসা দেশের তরুণ নাট্য নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী।

ষাট-সত্তরের দশকে বর্ণবাদ বিস্তৃত ছিল ব্রিটেনজুড়ে। সহিংসতার ঘটনাও ঘটত প্রায়ই পথে-ঘাটে, কর্মক্ষেত্রে। পীড়াদায়ক এসব অভিজ্ঞতার কথা আজ স্মরণ করতে চান না অনেকেই। তাঁরা বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শ্রমিক শ্রেণি, আমাদের পূর্বপুরুষ। তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ ও বঞ্চনার দাগ অনেক গভীর। এসব একসময় বিস্ফোরণ ঘটায়। নাটকের বিষয়বস্তু চার দশক আগের সেই উত্তাল সময়ের বিস্ফোরিত সাহস, প্রতিরোধ, পরিচয় ও স্বীকৃতি ঘিরে আবর্তিত।

১৯৭৮ সালের ৪ মে পূর্ব লন্ডনের ব্রিক লেনে বাংলাদেশি এক কাপড়শ্রমিক কাজ থেকে ঘরে ফেরার পথে তিনজন শ্বেতাঙ্গ যুবকের আক্রমণের শিকার হয়ে প্রাণ হারান। এই হত্যা সংবাদ খুব দ্রুত শহরে ছড়িয়ে পড়ে, বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। বলা যায়, ভিনদেশে ওখানেই রোপিত হয় আত্মপরিচয় উন্মেষের বীজ। নিহতের স্তব্ধ দেহ কাঁধে বহুবর্ণের ও ভিন্ন মতের ক্ষুব্ধ মানুষের প্রতিবাদী অবস্থান স্পষ্ট করে দেয় ডায়াসপোরা ঐক্য ও অধিকার। ২৫ বছরের যুবক আলতাব আলী তাঁর জীবন দিয়ে খুলে দেন দূরদেশে সাহসের জানালা। নির্দেশক বলেন, এই জানালা দিয়েই নাটকটি উপলব্ধি করার চেষ্টা ছিল আমাদের।

সহিংসতার জবাবে প্রতিরোধ, আন্দোলন ও ধর্মঘটে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে ও লন্ডনের রাজপথে নেমে স্বীকৃতি আদায় করতে নাটকে প্রায় ১৩টি দৃশ্যমান ও সক্রিয় চরিত্র নিয়ে আসেন নাট্যকার। বিভিন্ন দেশের বংশোদ্ভূত সাতজন ব্রিটিশ অভিনেতা চরিত্রগুলো রূপায়ণ করেন। ইতিহাসভিত্তিক যে গল্প থিয়েটারে রূপায়িত হয়, সে গল্পে চরিত্রের মধ্যকার সংলাপের বাইরেও আরও বিস্তারিত জানার আগ্রহ থাকে দর্শকের। সে ক্ষেত্রে ব্রিক লেন ’৭৮-এর দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে প্রচলিত মৌখিক বর্ণনা পদ্ধতির সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। নিরাভরণ মঞ্চকে মাত্র চারখানা আয়তাকার কাঠের বাক্সের বহুমাত্রিক ব্যবহার, মেঝেতে আনুভূমিক সাদা কার্পেট, পেছনে-দুপাশে কালো পর্দার উল্লম্ব অবস্থান এবং দৃশ্য ও শব্দযন্ত্রের উপযুক্ত প্রয়োগ নাটকে অসাধারণ দ্যোতনা তৈরি করেছে। সংগীত পরিকল্পনায় রাধারমনের ধামাইল, বাংলার বিরহ ও পারস্যের শূন্যতার হাহাকার জড়ানো বাঁশির সুর, সত্তরের দশকের বলিউড

ছায়াছবি ডন-এর ‘খায় ক্যা পান বানারসওয়ালা’ গান ও ব্রিটেনের জনপ্রিয় লেড জেপলিনের ‘ইমিগ্র্যান্ট’ গানের সুর এবং রবিঠাকুরের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’র কয়েক চরণ মিলনায়তনকে মুগ্ধ করে তোলে। নাটকে আলো ও দ্রব্য প্রয়োগে পরিমিতির ছাপ সুস্পষ্ট। তবে পোশাকে আরও যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। একই অভিনেতাকে একাধিক চরিত্রে অভিনয় করতে পোশাক ও রূপসজ্জা বেশ সহায়তা দিতে পারে।

নাটকে প্রতিভা, জাস স্টিভেন, টম হেনড্রিক, কার্তিস টালবট, রনিকা সৈয়দ, মুরাদ খান ও রাজীব জেবতিকদের সাবলীল অভিনয়ের সঙ্গে পাভন সিংয়ের সংগীত, জায়েদ খানের মঞ্চ ও দ্রব্য, আফরিন হুদা ও সুমিতা খানের পোশাক, সুদীপ চক্রবর্তীর আলো এবং অরূপ বাউলের প্রকাশনা পরিকল্পনা মিলিত হয়ে মুগ্ধ করেছে। নাটক শেষে পূর্বানাটের সদস্য ও অভিনেতা রাজীব জেবতিক বলছিলেন, ব্রিক লেন ’৭৮-এর জন্য তাঁরা ব্ল্যাক থিয়েটার এবং বার্মিংহাম সিটি কাউন্সিলের সহযোগিতা পেয়েছেন।

নাটকটি নিয়ে এই বছর ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে এবং আগামী বছর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করছে পূর্বানাট।

লেখক: আইনজীবী ও সংস্কৃতিকর্মী, লন্ডন