একটি ব্যতিক্রমী নাট্য রূপায়ণ

যা ছিল অন্ধকার নাটকের দৃশ্য
যা ছিল অন্ধকার নাটকের দৃশ্য

রাষ্ট্রনায়কেরা কখন কে কী উদ্দেশ্যে কী করে থাকেন, তা বলা মুশকিল। বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের পর ১৯৭৩ সালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো একটি কমিশন গঠন করেন। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হামুদুর রহমানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের টার্মস অব রেফারেন্স ঠিক করে দেওয়া হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয়ের কারণ নির্ণয় করাই তাদের কাজ। কমিশন ইস্টার্ন কমান্ডের জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার, কর্নেল মর্টান, প্রায় সব কমান্ডারকে ডেকে পাঠান এবং তাঁদের জবানবন্দি গ্রহণ করেন। বিচারপতি হামুদুর রহমান একটি দীর্ঘ রিপোর্ট প্রণয়ন করে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সরকারকে প্রদান করেন।

কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো তা দ্রুতই বাক্সবন্দী করে ফেলেন। সে রিপোর্ট কোথায়, কেউ জানেনি। ক্ষমতার হাতবদল হওয়ার পরও তা সূর্যালোক দেখেনি। কিন্তু ২৭ বছর পর কীভাবে যেন তা অন্ধকার ঘর থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যায় এবং ভারতীয় একটি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হতে থাকে। তবে তা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট নয়, আংশিক। এই আংশিক রিপোর্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সমরনায়কদের ভয়ংকর সব তথ্য বেরিয়ে আসে। তাঁদের দুর্নীতি, নৃশংসতা, কাপুরুষতার একেকটা চিত্র লোমহর্ষ।

সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এবং বিদেশে অবস্থানরত অবসরপ্রাপ্ত কিছু সচিবও হামুদুর রহমান কমিশনকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। যতটা মনে পড়ে, এই রিপোর্ট আমাদের হাতে আসে ২০০২ সালে একুশে টিভির সাইমন ড্রিংয়ের মাধ্যমে। রিপোর্টটি নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। আমরা ভাবতে থাকি, এটির একটি নাট্যরূপ সম্ভব। এই বিবেচনা থেকেই বাংলাদেশ টেলিভিশনের বর্তমান মহাপরিচালক হারুন-অর-রশীদকে অনুবাদ ও নাট্যরূপের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অতি দ্রুতই তিনি তা করে ফেলেন। এর মধ্যে একুশে টিভির টানাপোড়েন শুরু হয় এবং একধরনের মতানৈক্যের কারণে তা পিছিয়ে যেতে থাকে। একুশে টিভির প্রযোজক প্রয়াত আহির আলম বিষয়টি নিয়ে উৎসাহ দেখান। কিন্তু দুর্ঘটনাজনিত তাঁর অকালমৃত্যুতে তা আবার অন্ধকারে চলে যায়। কিন্তু হারুন-অর-রশীদ বিষয়টিকে আগলে রাখেন অত্যন্ত মমতায় এবং কমিশনের রিপোর্টকে নতুন করে নাট্যরূপ দিয়ে প্রচারের আয়োজন করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন মেধাবী প্রযোজক আওয়াল চৌধুরীকে এর নির্দেশনার দায়িত্ব দেন। উপস্থাপনাটি সরল কিন্তু প্রযোজনা দুরূহ। প্রচুর তথ্য-উপাত্ত, দুর্ঘটনার বিবরণ, কমিশনের প্রশ্নোত্তর জটিল বিষয়কে নিয়ে এর কর্মতৎপরতা। হারুন-অর-রশীদের তত্ত্বাবধানে, আওয়াল চৌধুরীর নির্দেশনায় একদল প্রযোজনাকর্মী, চিত্রগ্রাহক সম্পাদনাকর্মী আলোকবিন্যাসকর্মীকে নিয়ে সম্পন্ন হয়েছে এই যা ছিল অন্ধকারেরকাজ। এটি একটি নিছক নাট্যরূপ নয়, এটি যেমন ঐতিহাসিক দলিল, তেমনি এর প্রযোজনা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সামরিকায়ন এবং ব্যর্থ রাষ্ট্রের কারণগুলো চিহ্নিত করবে।

যা ছিল অন্ধকারেরএকটি চরিত্রে (হামুদুর রহমান) অভিনয় করতে গিয়ে বারবার শিউরে উঠেছি সেনা কমান্ডারদের আচরণে আর আমরা সবাই ভেবেছি কী ভয়াবহ একটা দেশপ্রেমহীন রাষ্ট্রে আমরা ২৪টি বছর বসবাস করেছি। যাঁর জন্ম ১৯৭১ সালের পর, তিনি হয়তো তা কল্পনাও করতে পারবেন না। তাঁর সেই কল্পনার একটি দিকনির্দেশনা হবে এই ধারাবাহিক। যাঁরা অভিনয় করেছেন, প্রত্যেকেই নিজেদের একটা ইতিহাসের অংশ হিসেবে ভেবেছেন। নেপথ্যের কর্মীরাও তাই ভেবে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। এই ধরনের একটি প্রযোজনার সাহস দেখিয়েছে বাংলাদেশ টেলিভিশন।

বাংলাদেশ টেলিভিশনই পারে, কারণ বিপণন তাকে বিধ্বস্ত করে না। যিনি ১৭টা বছর ধরে বুকের গভীরে, মননে, চিন্তায় এই অন্ধকারের বিষয়কে আলোয় এনেছেন, সেই মানুষটি হারুন-অর-রশীদকে জানাই কৃতজ্ঞতা।

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব