আলোর পথ দেখিয়েছে পড়াশোনা

>

ঠিক যেখানে মিথিলা এখন দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে পেছনে তাকালে নিজের ভবিষ্যৎকে খুব সহজ মনে হয় তাঁর। কাজ, পড়াশোনা, সংসার, অভিনয়—সব সামলেও সবশেষ যে স্নাতকোত্তর করলেন তিনি, তাতে সাফল্যের জন্য পেয়েছেন স্বর্ণপদক। তখন জীবনের কঠিন একটা সময় পার করছিলেন অভিনেত্রী রাফিয়াত রশীদ মিথিলা। তাঁর ভাষায়, সেই সংকটের সময় তাঁকে আলোর পথ দেখিয়েছে পড়াশোনা। পড়ার অভ্যাসটা সব দ্বিধা ঠেলে এগিয়ে যেতে গতি দিয়েছে তাঁকে। আজ নারী দিবসে মিথিলার গতিশীল এগিয়ে যাওয়ার কথা জানাচ্ছেন আদর রহমান

জীবনটা সহজ নয় বললেন মিথিলা। ছবি: আনন্দ
জীবনটা সহজ নয় বললেন মিথিলা। ছবি: আনন্দ

ব্র্যাক সেন্টারে কাজের ফাঁকে সময় বের করলেন মিথিলা। সেখানে আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট বিভাগে কর্মরত তিনি। কোনো কার্যদিবসে তাঁর সঙ্গে আলাপের জন্য অফিসের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাঁকে নাগালে পাওয়াই মুশকিল। তা-ও তো এবার দেশে পাওয়া গেল। তা না হলে ইদানীং তাঁকে কখনো তানজানিয়া, কখনো সিয়েরা লিওন, কখনো আবার কাজের জন্য ছুটতে হয় চীনে। দেশে যেটুকু সময় পান, সেখানেও পরিবার, বন্ধু আর অভিনয়ের জন্য কিছু সময় বাধা। আর ছুটির দিনগুলো শুধু আয়রার। মিথিলার মেয়ে আয়রা, তাঁর রাজকন্যা আয়রা।

না না ভুল বললাম। রাজকন্যা নয়। মিথিলা মেয়েকে রাজকন্যা বানাতে চান না, মানুষ বানাতে চান। যে কিনা সব পরিস্থিতিতে নিজের ব্যক্তিত্বকে অটুট রাখবে, যেকোনো ক্ষেত্রেই অধিকারের কথা বলতে সোচ্চার ও দৃঢ় হবে আর স্বাধীন থাকবে সব সময়। শুধু সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা কোনো পুতুলের মতো মেয়েকে সযত্নে তুলে রাখতে চান না মিথিলা। তাই তো নিজের সঙ্গে মেয়ে আয়রাকে নিয়ে মিথিলা ঘোরেন দেশ-বিদেশ। কাজের জন্য যে দেশেই যান, সুযোগ হলে মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। আর নেওয়ার সুযোগ না হলে মেয়ের জন্য সেই দেশ থেকে বই নিয়ে আসেন। আয়রাকে তিনি পৃথিবীর নানা দেশের মানুষ এখন থেকেই চেনাতে চান।

কিন্তু এখন থেকেই কেন? মিথিলা বললেন, ‘আমি অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় বিয়ে করেছি। তখনো আমি খুব নাজুক-নমনীয় ছিলাম। ভাবতাম আমার একটা মেয়ে হবে, তাকে আমি রাজকন্যার মতো সাজাব। মাথায় তুলে রাখব। রূপকথা শোনাব। কিন্তু সময় যত গড়াতে থাকল, জীবনের বাস্তবতা যত দেখতে থাকলাম, আমার ভাবনাগুলোও বদলে যেতে শুরু করল। ওকে প্রথম কোলে নেওয়ার দিনই ঠিক করলাম, রাজকন্যা নয়, ওকে আমি মানুষ হিসেবে বড় করব। ওর ব্যক্তিত্ব হবে দৃঢ়, কণ্ঠ হবে বলিষ্ঠ। নরম-নাজুক-কোমল আর একটুতেই আপস করার মতো না।’

জীবনটা সহজ নয়—এই বাস্তবতা কখন থেকে বুঝতে শুরু করলেন? মিথিলার কথার পর এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। জবাব দিলেন মিথিলা। বললেন, ‘আমার মায়ের বিয়ে হয় ১৭ বছর বয়সে। বিয়ের পর তিনি এইচএসসি, অনার্স, মাস্টার্স, বিএড ও এমএড করেছেন। বলতে পারেন আমি বিয়ের পর, মা হওয়ার পর আরও বেশি করে আমার মায়ের সংগ্রামটা বুঝতে পারি। আমি বুঝতে পারি, কেন আমার মা আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলতেন, লেখাপড়া চালিয়ে যেতে বলতেন। একজন নারীর নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আত্মনির্ভরশীল হওয়া প্রয়োজন। তাই ফুলটাইম চাকরি, সংসার, সন্তান, অভিনয়—সবকিছুর পাশাপাশি আমি পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। থেমে যাইনি কখনো। একটা সময় দেখলাম, এই পড়াশোনাই আমাকে সব সংকট থেকে উদ্ধার করেছে।’

মিথিলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। এরপর যোগ দেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকে। ২০১৪ সালে মেয়ে আয়রার বয়স যখন ১, তখন শুরু করেন দ্বিতীয় স্নাতকোত্তর। শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে কঠিন সংগ্রামের সময় ছিল সেটা। মিথিলা তাঁর সেই সময়ের রুটিনটা বলেন এভাবে: সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত অফিস। সাড়ে ৫টা থেকে ক্লাস। ৪ ঘণ্টা সেখানে। বাড়ি ফিরে রান্না করা, টেবিলে খাবার দেওয়া, আয়রাকে খাওয়ানো, এরপর রাত ১১টার পর পড়তে বসা।

২০১৫ সাল থেকে সময়টা আরও অস্থির হয়ে ওঠে মিথিলার জন্য। সেই বছর থেকে স্বামী তাহসানের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ (সেপারেশন) শুরু হয়। মানসিক চাপ এবং দিনের ছোটাছুটির পর তখন পড়তে বসলেই মিথিলা কিছুটা শান্তি পেতেন। যদিও অনেক সময় মাকে ক্লান্ত হয়ে বলতেন, ‘আর পারছি না। ছেড়েই দেব পড়া।’ কিন্তু মনের জোর আর পড়ার অদম্য চেষ্টা তাঁকে থামতে দেয়নি। বরং সব সংগ্রাম ২০১৬ সালের শেষ দিকে ভালো ফল নিয়ে আসে। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তরে সবচেয়ে ভালো ফলাফলের জন্য জেতেন চ্যান্সেলরস গোল্ড মেডেল।

এখন পেছনের দিকে তাকালে মিথিলার সবকিছুই সম্ভব বলে মনে হয়। ওই কঠিন সময়েও সাফল্যের সঙ্গে পেরিয়ে আসার পর হাল না ছাড়ার যে তাগিদ পেয়েছেন, তা এখন সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান তিনি।

সেদিন নাকি এক অনুষ্ঠানে মিথিলার কাছে এসে অচেনা এক তরুণী বললেন, ‘আপনি আমার জীবন বদলে দিয়েছেন।’ পরে কথায় কথায় জানতে পারলেন, বিয়ের পর থেকে সেই তরুণী নানাভাবে মানসিকভাবে হীনমন্যতায় ভুগছিলেন, কিন্তু ভয়ে আর সামাজিকভাবে কানকথার চিন্তায় মুখ খুলতেন না। মিথিলা গত বছর এক অনুষ্ঠানে নিজের জীবনের সংগ্রাম নিয়ে অনুপ্রেরণাদায়ক একটি বক্তৃতা দেন। সেদিন ওই বক্তৃতা শুনে বদলে যায় ওই তরুণীর জীবন। মেয়েটি এরপর নিজের জীবনকে ঢেলে সাজান। মিথিলা বলেন, এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় অর্জন। তাঁর কথায় অন্তত একটা জীবন তো বদলে গেল, একটা জীবন অন্তত সব ভয়কে হারিয়ে বাঁচতে শিখল। এটাই গতিশীল করে মিথিলাকে, চলার পথে আরও অনুপ্রেরণা দেয়।