জয়ার সাফল্যের পরশকাঠি

>

দুই বাংলার সফল অভিনেত্রী জয়া আহসান। নারী দিবসের আয়োজনে তিনি জানালেন তাঁর সাফল্যের সূত্রগুলো। বাদ যায়নি একান্ত ব্যক্তিজীবনের কথাও।

প্রায় বছর দুই ধরে অভিনেত্রী জয়া আহসানের বৃহস্পতি তুঙ্গে।  ছবি: কবির হোসেন
প্রায় বছর দুই ধরে অভিনেত্রী জয়া আহসানের বৃহস্পতি তুঙ্গে। ছবি: কবির হোসেন

সার্কাসের রিংয়ের ওপর বসে আছেন। কালিঝুলি মাখা মুখ। ফাল্গুনের বিকেল বেলায়ও সূর্য মাথার ওপর গনগনে। তিনি বসে আছেন তো আছেনই—এক-দু মিনিট নয়, পাক্কা চল্লিশ মিনিট। ‘অ্যাকশন...কাট...রোলিং...ওয়ান, টু, থ্রি...’—দৃশ্য ধারণ চলেছে বটে, এর মধ্যে সার্কাস-রিংয়ে বসে কয়েক দফা ঘামও মুছেছেন তিনি, ঝাঁজালো রৌদ্রে খানিক সময় বিরক্ত হয়ে বলেছেনও ‘এ্যাই, আমাকে এখান থেকে নামাও’, কিন্তু নামেননি, নামতে চাননি শেষ পর্যন্ত।
স্থানীয় লোকজন মুঠোফোনের ক্যামেরায় তাঁর ছবি তুলছেন হরদম। তবে কোনো দিকেই বুঝি তাকানোর জো নেই তাঁর। তিনি আছেন রিংয়ের ওপর, সূর্যমুখা হয়ে। শুটিং করছেন মাহমুদ দিদার পরিচালিত বিউটি সার্কাস চলচ্চিত্রের।
অভিনয়শিল্পী জয়া আহসানের সাফল্যের সূত্র জানার আগে এই দৃশ্যটি মাথায় রাখুন, বিবেচনায় রাখুন তাঁর এই নিষ্ঠা।

দৃশ্য থেকে দূরে
গেল প্রায় বছর দুই ধরে এই অভিনেত্রীর বৃহস্পতি তুঙ্গে। সুঅভিনেত্রী হিসেবে বাংলাদেশে তো আগেই পাকা করেছেন অবস্থান। ২০১৩ সালে জড়ালেন টালিউডের সিনেমায়। বেশি সময় লাগেনি ওপার বাংলা মাত করতে। এই মাতামাতির স্বীকৃতিও মিলেছে হাতেনাতে। ভারত থেকে হাতে উঠেছে সেরা বাঙালি সম্মাননা, জি সিনে অ্যাওয়ার্ড ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। ভালোবাসার শহর, বিসর্জন—এসব ছবি নিয়ে ছিলেন যথেষ্ট আলোচনায়।
আর এ সময় বাংলাদেশের জিরো ডিগ্রি সিনেমার জন্য বাংলাদেশ থেকে আবারও পেয়েছেন ২০১৫ সালের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। স্বল্প সময়ে এত স্বীকৃতি এল যখন, তখন তাঁকে সফল না বলে উপায় আছে?
সাফল্যের সূত্রগুলো কী, জয়া?
: তথাকথিত সাকসেসে আমি বিশ্বাসই করি না। সাফল্যের অর্থ কী? এটা কোনো গন্তব্য নয়, এটা অনেকটা যাত্রার মতো। রাস্তায় চলতে গেলে অনেক সময় মণিমুক্তা কুড়িয়ে পাওয়া যায়, আমার কাছে পুরস্কার বা স্বীকৃতি এমন।
এমন বিনয়-বাক্য শোনার পর হয় আপনি নিশ্চুপ হয়ে যাবেন, নয়তো কিছুটা ধাঁধায় পড়ে যাবেন। কারণ প্রায় নিয়মিত বিরতিতে যিনি হরেক স্বীকৃতিতে বাক্স ভারী করছেন, পরের প্রজন্মের কেউ কেউ যখন আদর্শ মানছেন তাঁকে, তাঁর মুখে এই বুলি মানায়!

জয়া না জয়ার ইমেজ?
চার মার্চের ফাল্গুনী বিকেল ততক্ষণে সন্ধ্যা। বসে আছি মানিকগঞ্জের গোপালপুর গ্রামের ধু ধু মাঠে, মাইক্রোবাসের ভেতর। চোখে ভাসছে বিকেলে দেখা সার্কাস-রিংয়ে সেই মেয়েটি...।
সেই মেয়ে জয়া আহসান এখন আমাদের সামনে। একটু আগে যিনি শুটিং করেছেন প্রবল সূর্যের তাপে, তাঁর তো ক্লান্তি থাকবে, কিন্তু কোথায়? শুটিংয়ের সার্কাস-রিং থেকে নেমে উঠলেন মাইক্রোবাসে। সহকারীকে বললেন, ‘গাড়ির দরজা বন্ধ করে দাও, কথা বলব।’
সাফল্যের সূত্র বলতে গিয়ে নিজের অর্গল কিছুটা আলগা করলেন জয়া।
: হা হা হা। সাফল্য! আমাদের দেশে এখন দুটো কালচার গড়ে উঠেছে। সেলিব্রেটি কালচার ও ভিআইপি কালচার। এত বেশি সেলিব্রেটি ও ভিআইপি কিন্তু সমাজের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়। আমি সেলিব্রেটি নই, সংস্কৃতিকর্মী মাত্র। আর আমি কিন্তু আদতে মেধাবী নই, হার্ড ওয়ার্কার। নিজেকে কখোনোই নায়িকা মনে করি না। আমার ভেতরে আরেকটি সত্তা আছে। যে জয়া ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে হাসে-কাঁদে, সে প্রকৃত জয়া নয়, জয়ার একটি ইমেজ।
তাঁর কথায় সচকিত হতেই হলো, কে কথা বলছেন এই ঘন সন্ধ্যায় মাইক্রোবাসে, জয়া না জয়ার ইমেজ? তাঁর চোখে তাকাই। সন্ধ্যার মিহি অন্ধকারে চোখগুলো নাচে।
: আজকাল অনেক অভিনয়শিল্পী বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করেন, জীবন থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে নিজের মতো জগৎ গড়তে চান অনেকে। আসলে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেউ শিল্পী হতে পারে না। সাধারণত ত্রিশের পর মানুষ তাঁর ভালো অভিনয়টি করতে পারেন। কারণ জীবন দেখার অভিজ্ঞতা জমা হয় তাঁর ঝুলিতে...।

সাফল্যের চাবিকাঠি
জয়ার কথাবার্তা কোন দিকে যাচ্ছে? নিজের সফল হওয়া নিয়ে কিছু কি বলবেনই না? প্রশ্নটি কেবল বুদ্বুদ তুলছিল মনে, সেটি বুঝে যেন কথার মোড় ঘোরালেন তিনি।
: আমি সফল কি না জানি না, তবে মানুষ হিসেবে নিজেকে সাহসী মনে করি। যখন যে চ্যালেঞ্জ আসে, গ্রহণ করি। কাজের প্রতি সৎ থাকার চেষ্টা করি। নিজের চেয়েও কাজটাকে বেশি ভালোবাসি। আমি আমার কাজের প্রতি দায়িত্বশীল।
অনেকে বলেন, আপনি খুব হিসাবি।
কথাটি শুনে ভাবলেন পল মুহূর্ত। এরপর গাঢ় হলো তাঁর স্বর, কোনো দ্বিধার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না সেখানে।
: আমি বোহেমিয়ান, মোটেই হিসাবি নই। হিসাবি হলে অনেক কিছু করতাম, অনেক বেশি বিজ্ঞাপন করতাম, টাকা কামাতাম, ওসব তো করিনি...তবে হ্যাঁ, আমি জানি আমার কখন কী করা উচিত, আর কী উচিত নয়।

ব্যক্তিগত বসন্ত

সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে যখন তিনি বলছিলেন ‘যে চ্যালেঞ্জ আসে তা গ্রহণ করি’, সেই কথার পুচ্ছতে আনমনেই ভেসে উঠলেন এক ঝলক ব্যক্তিগত জয়া। জয়ার ইমেজ নয়, আসল জয়া। সেই জয়ার কণ্ঠই শোনা গেল এবার।
: জীবনে অদ্ভুত অদ্ভুত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে, ব্যক্তিগত জীবনে পার করেছি দুর্যোগপূর্ণ সময়, যে সম্পর্ককে চিরস্থায়ী ভেবেছিলাম, ওই সম্পর্ক ভেঙে গেছে। মুষড়ে পড়েছি। শূন্য থেকে শুরু করেছি আবার। এই সময় কাজই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
আবার নতুন কোনো সম্পর্কে জড়াবেন...বিয়ে?
: এটা বলা যায় না। এমন হতে পারে, যেকোনো সময় করেই ফেলতে পারি। আবার যেভাবে আছি সেভাবেও থাকতে পারি। বিয়ে নিয়ে আমার ভীতি আছে। একটা সম্পর্ক তো ওয়ার্কআউট করেনি। কিন্তু যত দিন আমরা ছিলাম, ভালোবেসেই ছিলাম। আসলে একজন শিল্পী যদি একটি পরিবার, একটি সম্পর্ক এবং ভালোবাসার মধ্যে থাকেন, তবে তাঁর জন্যই ভালো।
ধু ধু মাঠের ভেতর সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত বাড়ছে, থেকে থেকে দুলে উঠছে বসন্তের হাওয়া। সার্কাস-রিংয়ের সেই মেয়েটিকে আমাদের এখন আর মনেই পড়ছে না!

জয়ার দেওয়া সাফল্যের ৭ সূত্র
 সামনে যে চ্যালেঞ্জ আসুক তাকে হ্যাঁ বলতে পারা।
 নিষ্ঠা, নিষ্ঠা, নিষ্ঠা। কাজের প্রতি সৎ থাকা। কাজকে ভালোবাসা।
 নিজের জন্য শিল্পী স্বার্থপর হবেন ঠিক আছে, তবে সেটি যেন পাশের মানুষকে ক্ষতি না করে।
 জীবন দেখা, জগৎ দেখা এবং সাধারণ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়া।
 কী করছি, কেন করছি—এগুলো ভেবে দেখা।
 পড়া, পড়া, পড়া। যত না ছবি দেখা, তার চেয়ে বেশি বই পড়া। ফলে ভেতরের কল্পনাশক্তি বিকশিত হয়, অভিনয়ে এটা খুব কাজে দেয়।
 সেলিব্রেটি নয়, শিল্পী হতে চাইলে অবশ্যই তাঁকে সাধারণ জীবন যাপন করতে হবে।